রক্তাক্ত ছাত্ররাজনীতি (দ্বিতীয় পর্ব): ঢাবি মুহসীন হলের সেভেন মার্ডার1 min read
Reading Time: 4 minutesস্বাধীন বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি সর্বপ্রথম রক্তের লালে রঞ্জিত হয় ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাত্রলীগের খুনের রাজনীতির শুরুও তখন থেকেই। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে নির্মমভাবে খুনের শিকার হন ছাত্রলীগ করা ৭জন শিক্ষার্থী। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে এই সাত খুন ঘটনার মূল কারিগর ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। পুরো দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি “মুহসীন হলের সেভেন মার্ডার” নামে পরিচিতি পায়।
১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে সূর্যসেন হলে ২/৩ রাউন্ড গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে ঢাবির সুনসান ক্যাম্পাস। এর কিছুক্ষণ পরে তৎকালীন ছাত্রলীগ সম্পাদক প্রধানের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী সূর্যসেন হলে প্রবেশ করে। তাদের মূল টার্গেট ছিল ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হক কোহিনুরকে হত্যা করা। খুনিরা সূর্যসেন হলের পঞ্চম তলার ৬৩৪ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে কোহিনুরের নাম ধরে ঢাকতে থাকে। কিন্তু সে রুমে কোহিনুরকে না পেয়ে তারা ৬৩৫ নম্বর রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে কোহিনুরকে ডাকতে থাকে। একসময় ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন কোহিনুর, তার সাথে ছিলেন আরও তিনজন। অস্ত্রধারীরা এই চারজনকে “হ্যান্ডস আপ” করিয়ে নিয়ে আসেন মুহসীন হলে টিভি রুমের সামনে। একই কায়দায় অস্ত্রধারীদের আরেক দল ৬৪৮ নম্বর রুম থেকে আরও তিন জনকে মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনে নিয়ে আসেন। এই সময়ের মধ্যে অস্ত্রধারীরা সূর্যসেন হলের ২১৫ নম্বর রুমে আরও এক ছাত্রের খোঁজ করেন। কিন্তু সে ছাত্র বিপদ আঁচ করতে পেরে জানালা দিয়ে দোতলা থেকে থেকে লাফ দিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন।
রাত ২টা ১১ মিনিটে মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনের করিডরে দাঁড়া করিয়ে ওই সাত ছাত্রকে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। সবার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ২টা ২৫ মিনিটে ফাকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে অস্ত্রধারীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। ঘটনার প্রায় আড়াই ঘন্টা পর ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠায়।
এই ঘটনায় যারা খুন হন তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থক। সাত খুন হত্যা মামলার প্রধান আসামী শফিউল আলম প্রধান ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩-৭৪ সালের ছাত্রলীগের সম্মেলনকে ঘিরে দুইটি কমিটির প্রস্তাব ছাত্রলীগের কর্মীদের মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি মনির-প্রধান (মনিরুল হক চৌধুরী- শফিউল আলম প্রধান) পরিষদ, অপরটি রশিদ-হাসান (এমএ রশিদ- রাশিদুল হাসান) পরিষদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের সমর্থন ছিল মনির-প্রধান পরিষদের পক্ষে, অন্যদিকে যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থন ছিল রশিদ-হাসান পরিষদের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয় মনির-প্রধান পরিষদ। প্রতিপক্ষের উসকানিতে শফিউল আলম প্রধান শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থক সেই শিক্ষার্থীদের হত্যা করেন বলেন অভিযোগ আছে।
হত্যার পরের দিন হত্যার বিচারের দাবিতে ছাত্রলীগ মিছিল বের করে। তারা সারা দেশে শোক দিবস আহ্বান করে। হত্যার দাবিতে করা মিছিলে প্রধানকেও নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এমনকি পত্রপত্রিকায় বিবৃতিও দেন তিনি। সাত খুন ঘটনার তিন দিন পর প্রধানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
প্রধান সেসময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। সাত খুন হত্যার বিচারের দাবির পাশাপাশি, শফিউল আলম প্রধানসহ ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে। খুনি প্রধানকে বাঁচাতে ছাত্রলীগের কর্মীরা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যায়। তারা সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয়।
আমাদের জাতীয় চার নেতার একজন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। কিন্তু তৎকালীন ছাত্রলীগ মনসুর আলীর বক্তব্যেরও বিরোধিতা করে প্রধানের মুক্তি দাবি করে। তবে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোন কিছুতেই দমে যায়নি। নিজ দলের ছাত্র সংগঠনের খুনি নেতাদের প্রতি কোন সহমর্মিতা দেখায়নি। পুলিশি তদন্তে এই হত্যাকান্ডে প্রধানের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে আসে। পুলিশি তদন্তে বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে(ডাকসু) কেন্দ্র করে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে। (এখানে একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগ জয় লাভ করতে পারেনি। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। সে নির্বাচনে সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স ছিনতাই করার মতো ঘটনাও ঘটায়।)
আওয়ামী সরকারের আমলেই সাত খুন হত্যা মামলার বিচারকার্য শেষ হয়। শফিউল আলম প্রধানের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়। প্রধান দাবি করেন তিনি বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের শিকার। ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীই সেসময় প্রধানের এই শাস্তি মেনে নিতে পারেননি। সেসময় প্রধান এতটাই প্রভাবশালী ছাত্র নেতা ছিলেন যে, তিনি ছাত্রলীগের এক প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা প্রকাশ করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সেই দুর্নীতিবাজদের বিচার দাবি করেন। প্রধানের এমন কর্মকান্ডে দলের ভেতরে ও বাইরে তার শত্রুর অভাব ছিল একথা যেমন সত্য, তেমনি সাত খুনের ঘটনায় জড়িত রাজসাক্ষীদের জবানবন্দীতে প্রধানের নাম উঠে আসাটাও ফেলে দেবার মতো নয়।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন হলে শাস্তি থেকে বেঁচে যান প্রধান। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপিতে যোগদানের শর্তে প্রধানকে মুক্তি দেন এবং তাকে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতিতে ব্যবহার করেন। প্রধানও জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) নামে একটি নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করে আজীবন বিএনপির পাশে থেকেছেন।