বিশ্ব

মুয়াম্মর গাদ্দাফির উত্থান এবং পতন1 min read

জুন ২৭, ২০১৯ 3 min read

author:

মুয়াম্মর গাদ্দাফির উত্থান এবং পতন1 min read

Reading Time: 3 minutes

৪২ বছর ধরে লিবিয়া শাসন করা লৌহ মানব নামে খ্যাত গাদ্দাফির জন্ম হয়েছি সাধারণ এক বেদুইন পরিবারে। তবে একদম গরীব পরিবারে জন্ম নেয়ার পরেও সেই ছোটবেলা থেকেই গাদ্দাফির মধ্যে ছিল বিদ্রোহ নামক আগুনের ছিটে। কিন্তু তখন কে জানত কালের আবর্তে মহানায়ক হিসেবে খ্যাত হয়ে এই গাদ্দাফির পতন হবে ইতিহাসের এক খলনায়ক হিসেবে?

গাদ্দাফির শৈশব ও কৈশোর

সেই স্কুলে পড়া গাদ্দাফি তার বন্ধুদের সাথে স্বপ্ন দেখছিল জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আবির্ভূত হওয়ার। ১৯৪২ সালে জুলাই মাসের ৭ তারিখ সিরত শহরে জন্ম নেয়া গাদ্দাফি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন ১৯৬১ সালের দিকে। পরবর্তীতে তিনি বেনগাজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সামরিক পরিষদে যোগ দেয়ার কারণে তার পড়ালেখার অধ্যায়ের সেখানেই সমাপ্তি হয় এবং শুরু হয় অন্য এক গাদ্দাফির উত্থান।

গাদ্দাফি কীভাবে লৌহ মানব হলেন?

গাদ্দাফি একদম রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন রাজা ইদ্রিসকে উৎখাত করে আবির্ভূত হন লিবিয়ান শাসন ক্ষমতায়। যে ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়ার স্বপ্ন গাদ্দাফি ছোটবেলা থেকেই লালন করতেন তার ভেতর, সেই উদ্দেশ্যেই তিনি পশ্চিমাপন্থী রাজা ইদ্রিস থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জন্য গোপনে এক সামরিক বাহিনী গড়ে তুলছিলেন তিল তিল করে। আর তার ফলাফল স্বরূপ ১৯৬৯ সালে ইদ্রিসকে উৎখাত করে লিবিয়ায় এক নায়ক তন্ত্রের সূচনা করেন।

এক নায়ক মনোভাবের কারণেই ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই দেশের ক্ষমতাধর অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে গাদ্দাফির বিবাদ শুরু হয়ে যায়। তবে ইতিহাস তাকে লৌহমানব উপাধি এমনিতেই দেয়নি। সব ধরনের বিবাদ দূর করে গাদ্দাফি লিবিয়াতে তার একক সম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তবে গাদ্দাফি লিবিয়াকে একটা সময়ে জনতার লিবিয়া বলে ঘোষণা দিলেও তার স্বৈরশাসন রক্ষার খাতিরেই নিজের ঘোষণা থেকে সরে আসতে হয়েছিল।

তবে তিনি লিবিয়ার জনমানুষদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলেন। গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রতি নাগরিককে একটি করে বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছিলেন এবং এটাকে তিনি মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন। এছাড়া লিবীয়দের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা সুনিশ্চিত করেছিলেন। এমনকি উচ্চ শিক্ষার জন্য যদি কাউকে দেশের বাইরে যেতে হতো, তবে সরকার সেই খরচ বহন করত। এই ধরনের সুযোগ সুবিধাকে পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন এক অসাধারণ উদ্যোগ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এছাড়া আরো অন্যান্য সুযোগ সুবিধার মধ্যে সন্তান জন্ম নিলে তাদের পাঁচ হাজার ডলার দেয়া ছিল অন্যতম। এখানেই সুযোগ সুবিধার শেষ নয়। লিবীয়দের কোন প্রকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হতো না, বিনা সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ পেত লিবীয়রা। এছাড়া ব্যবসা করার জন্যও সরকার থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেত লিবীয়রা। সব মিলিয়ে সাধারণ জনগণের জন্য লিবিয়াকে মোটামুটি এক ভূস্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলছিলেন গাদ্দাফি।

যেভাবে নায়ক থেকে খলনায়ক  

পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বিরোধ করে ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন আরব নায়ক টিকে থাকতে পারেনি। আর তারই আরেক উদাহরণ হওয়ার জন্যই যেন গাদ্দাফি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তার স্বৈর শাসনের কালো এক অধ্যায়ের দিকে। ক্ষমতায় এসেই গাদ্দাফি প্রথমে যে কাজটা করে পশ্চিমাদের রোষানলে পড়েন সেটা হল, লিবিয়া থেকে সকল পশ্চিমাদের বিদায় করে দেয়া। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল গাদ্দাফির উপর।

জমে থাকা বারুদের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ানর জন্যই যেন ১৯৮৬ সালে বার্লিনের এক নাইটক্লাবে তিনি বোমা হামলা করেছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় স্বীকার না করলেও ২০০৩ এর দিকে এসে তিনি স্বীকার করেছিলেন সেই হামলার কথা। তৎকালীন সময়ে এই জন্য গাদ্দাফিকে “পাগল কুকুর” বলে আখ্যায়িত করে পশ্চিমা বিশ্ব। নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু যায় এর সাথে সাথেই। ২০০৩ সালের দিকে গাদ্দাফি সেই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে এক কোটি ডলার করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করলেও পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সেই হামলার নায়ক লিবিয়ান গোয়েন্দা যখন মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসে তখন গাদ্দাফি তাকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করেন।

এছাড়া ১৯৮৮ সালের দিকে স্কটল্যান্ডের আকাশে এক যাত্রীবাহী বিমান হামলার পিছনের কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল গাদ্দাফিকেই। যাত্রীবাহী সেই বিমান হামলায় ২৮৯ জন ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন। পশ্চিমা রোষানলকে যেন আরো বিষিয়ে তুলতেই গাদ্দাফি ২০০৯ সালে জাতিসংঘের এক অধিবেশনে পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা করে প্রায় সুদীর্ঘ দেড় ঘণ্টার এক বক্তব্য প্রদান করেন।

গাদ্দাফির পতন

আরব বসন্তের মাধ্যমেই মূলত গাদ্দাফির সাথে সাথে ভূস্বর্গ লিবিয়ার পতন হয়েছিল। পশ্চিমা ইন্ধনে ২০১১ সালের দিকে আরব বিশ্বে এক গণ অভ্যুত্থানের সূচনা হয়, তাকেই মূলত আরব বসন্ত নামে আখ্যায়িত করা হয়। অন্যান্য আরব দেশের মত লিবিয়াতেও ছড়িয়ে পরে স্বৈর শাসন নির্মূলের আয়োজন। আর সর্ব প্রথম গাদ্দাফি বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার বেনগাজি শহরে। আর বিদ্রোহীদের পূর্ণ সমর্থন দেয়ার জন্য তো পশ্চিমা বিশ্ব এক প্রকার মুখিয়েই ছিল বলা চলে। এরই জের ধরে ১৯শে মার্চ লিবিয়ায় ন্যাটো জোটের ভয়াবহ আগ্রাসী বোমা হামলার মাধ্যমে গাদ্দাফির পতনের শুরু হয়।

গাদ্দাফি বলেছিলেন লিবিয়ার উন্নতির জন্য প্রয়োজনে তিনি তার জীবন উৎসর্গ করবেন। ইতিহাস সাক্ষী, তিনি চাইলেই পালিয়ে গিয়ে অন্য কোন দেশে আশ্রয় নিতে পারতেন। গাদ্দাফিকে আশ্রয় দেয়ার জন্য দেশের অভাব ছিল না। নিজের দেশেই আত্মগোপন করার পরে ২০ অক্টোবর, ২০১১ তে সিরত শহরে তিনি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পরেন এবং তাৎক্ষণিক অবস্থাতেই তাকে গুলি করা হয়, জনতার সামনে নিয়ে গিয়ে তার গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।

লেখক- ইকবাল মাহমুদ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *