বিশ্ব

মুম্বাই হামলা ১৯৯৩- যে হামলায় মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছিল মুম্বাই!1 min read

এপ্রিল ২১, ২০১৯ 5 min read

author:

মুম্বাই হামলা ১৯৯৩- যে হামলায় মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছিল মুম্বাই!1 min read

Reading Time: 5 minutes

১২ মার্চ, ১৯৯৩। দুপুর দেড়টা। হঠাৎ কেঁপে উঠলো বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং। আগে থেকে বেসমেন্টের গাড়িতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে সেদিন ৫০ জন মারা গিয়েছিল। ২৮ তলা এ বিল্ডিং সহ আশেপাশের বিল্ডিং গুলোও সেদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভারতের দুঃস্বপ্নের মাত্র শুরু হয়েছিল তখন। আধা ঘণ্টা পর মাসজিদ-মান্ধবি কর্পোরেশন ব্যাংক শাখার সামনে আরেকটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরিত হয়। সেদিন ১.৩০-৩.৪০ পর্যন্ত বোম্বের  বিভিন্ন জায়গায় ১২টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। ২ ঘন্টা ১০ মিনিটের এ সিরিজ বোমা হামলায় ২৫৭ জন নিহত হয় এবং ১৪০০ জন আহত হয়। বিভিন্ন ব্যাংক, এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, সাহার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইত্যাদিতেও বোমা হামলা করা হয়। এমনকি একটি ডাবল ডেকার বাসেও হামলা করা হয়েছিল। এতে ৯০ জন নিহত হন। ১২ টি হামলার মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ানক।

সেদিন যেসব স্থানে হামলা হয়েছিলঃ 
১।মাহিমের জেলে পাড়া।
২।জাভেরি বাজার।
৩।প্লাজা সিনেমা।
৪। সেঞ্চুরি বাজার।
৫।কথা বাজার।
৬। হোটেল সি রক।
৭। তৎকালীন সাহার বিমানবন্দরের টার্মিনাল(বর্তমানে ছত্রপতি শিবাজি বিমানবন্দর)
৮। এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং।
৯।হোটেল জুহু সেন্টাউর।
১০। ওয়রলি।
১১। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ।
১২। মাসজিদ-মান্ধভি কর্পোরেশন ব্যাংক শাখা।

মার্চের ৯ তারিখে উত্তরপুর্ব মুম্বাইয়ের বেহরামপাড়া বস্তি থেকে নাভ পাড়া পুলিশ গুল মোহাম্মেদকে গ্রেফতার করে। এই গুল মোহাম্মেদ ছিলেন এ বোমা হামলা পরিকল্পনার অন্যতম সদস্য। মুম্বাই বোমা হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারি টাইগার মেমন নিজে ১৯ জনকে বেছে নিয়েছিলেন, গুল মোহাম্মেদ ছিলেন তাদের একজন। তাঁকে দুবাই হয়ে পাকিস্তানে ট্রেনিং এর জন্য পাঠানো হয়। ট্রেনিং শেষে সে ৪ মার্চ ভারতে ফিরে আসে। পরিকল্পনায় ছিল এপ্রিলে শিব জয়ন্তীর দিনে বোমা হামলা করার, কিন্ত গুল মোহাম্মদ ধরা পড়লে সময় এগিয়ে আনা হয়। অন্যদিকে গুল মোহাম্মদ পুলিশের কাছে বোমা হামলার পরিকল্পনার কথা বললেও তারা সেটাকে ধোঁকাবাজি হিসেবে উড়িয়ে দেয়। তাই যা হওয়ার ছিল শেষ পর্যন্ত তাই হল।

কেন এই মুম্বাই হামলা?

১৯৯২ এর ডিসেম্বরে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে কর সেবকরা। এর প্রতিবাদে ভারতীয় মুসলিম ও হিন্দুদের মাঝে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এ দাঙ্গা হয়েছিল শিব সেনা ও মুসলমানদের মাঝে। এ দাঙ্গায় প্রায় ৭০০ মানুষ মারা যায়। পরবর্তীতে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে এ দাঙ্গা পরিকল্পিত ছিল, কারণ শিব সেনাদের কাছে মুসলমানদের অবস্থান সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য ছিল। এছাড়া এও শোনা গিয়েছিল যে পুলিশেরও সায় ছিল শিব সেনাদের কর্মকাণ্ডে। এমনকি বিচারক শ্রীকৃষ্ণের দায়িত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হলেও এ কমিশনের কোনকিছুই মানা হয়নি। আর দাঙ্গাকারিদের ও কোন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়নি।

ধারণা করা হয়, আসলে শুধু ধারণা না মুম্বাই হামলার স্বতঃসিদ্ধ কারণ হিসেবে ধরা হয় এ দাঙ্গা কে।

১৯৯২-১৯৯৩ এর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা; Image Source: factswala.com

হামলার দায় কাদের? 

মুম্বাই হামলার জন্য সরাসরি দায়ী করা হয় ভারতের আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিমকে। তাঁর পাশাপাশি তাঁর ভাই আনিস ইব্রাহিমকেও দোষ দেওয়া হয়। যদিও আজ পর্যন্ত দু’জনের কেউই আইনের মুখোমুখি হয়নি। তাঁর বুদ্ধিতেই টাইগার মেমন মুম্বাই হামলার ছক কষে। সেসময় অনেক মুসলিমরাই দাঙ্গার জন্য ভারতীয় সরকারের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। আর ঠিক এই সেন্টিমেন্টকেই কাজে লাগায় টাইগার মেমন। এসব তরুণদের প্রথমে দুবাই পাঠানো হয়, সেখান থেকে তারা পাকিস্তানে যায় ট্রেনিং এর জন্য। এবং সেখান থেকে ফেরে মুম্বাই হামলার জন্য। পুলিশের হাতে যে গুল মোহাম্মেদ ধরা পরেছিল,সেও দুবাই-পাকিস্তান হয়ে ভারত এসেছিল। এমনকি এটাও বলা হয় যে পাকিস্তানের আই এস আই সাহায্য করেছে সন্ত্রাসীদের। শুধু তাই নয়,ধারনা করা হয় যে দাউদ ইব্রাহিম পাকিস্তানেই আছেন।

দাউদ ইব্রাহিম; Image Source: indiatoday.in

তবে এ হামলার জন্য দাউদের ‘ডি-কোম্পানি’ গ্রুপে ভাঙ্গন ধরে। তাঁর অন্যতম সহযোগী ছোটটা রাজন দল ভেঙ্গে বেরিয়ে যায়,সাথে আরও হিন্দু সহযোগীদেরও নিয়ে যায়। তাদের নিয়ে নতুন দল গঠন করে ও মুম্বাই হামলার জন্য প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে। ডি-কোম্পানির গ্যাং ও ছোটটা রাজনের গ্যাং এর মাঝে মারামারিতে একশোর বেশি গ্যাং এর সদস্য মারা যায়। এমনকি মুম্বাই হামলার ৭জন  অভিযুক্ত – সালিম কুরলা, মাজিদ খান, শাকিল আহমেদ, মোহাম্মেদ জিন্দ্রান, হানিফ কারাওয়ালা, আকবর আবু সামা খান ও আব্দুল লতিফকে – রাজনের হিট্ম্যান খুন করেছে বলে ধারণা করা হয়।

ছোটা রাজন; Image Source :assamtribune

মুম্বাই হামলা মামলা

এ হামলায় টেররিস্ট অ্যান্ড ডিসরাপ্টিভ অ্যাক্ট(টাডা) এর আওতায় মামলা হয়। ১৯৯৫ সালে শুরু হয় মামলার কাজ। ১২৯ জন অভিযুক্তর মাঝে ১০০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ২০০৬ সালে। যদিও অনেকে ধরাই পরেনি, তবুও তাদেরকে পলায়িত দেখিয়ে রায় দেওয়া হয়েছে, যেমন মূল পরিকল্পপনাকারি টাইগার মেমন,তাঁর ভাই আইয়ুব মেমন, দাউদ ইব্রাহিম নিজে সহ আরও অনেকে। কিন্ত  টাইগারের ভাই ইয়াকুব ধরা পরেছিল, তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৯৩ এর মুম্বাই হামলার মামলায় একমাত্র ফাঁসির আদেশ পাওয়া আসামি।

২০১৫ সালে ইয়াকুব মেমনের ফাসি কার্যকর করা হয়। এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র তার-ই ফাসি হয়েছে।

ইয়াকুব মেমন;; Image Source: the hindu

মেমন পরিবারের সংশ্লিষ্টতা

মুম্বাই হামলার পরে  ২৪ থেকে ৩৬ ঘন্টার মাঝে পুলিশ কোন তথ্য পাচ্ছিল না। তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন ডেপুটি পুলিশ চিফ রাকেশ মারিয়া। এর মাঝে দাউদ ইব্রাহিম ও টাইগার মেমনের নাম আসলেও কোন সুত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। এর মাঝেই ১২ মার্চ রাতে ওরলির দূরদর্শন কেন্দ্রের কাছে টহলরত পুলিশ একটি পরিত্যক্ত মারুতি ওমনি ভ্যান পায়। এ ভ্যানে করে হামলাকারীর একাংশ পালিয়েছিল। ভ্যানে অনেক একে-৫৬ ও গ্রেনেড ছিল। এ ভ্যানের মালিকের খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায় যে এটার রেজিস্ট্রেশন সুলাইমান মেমনের স্ত্রী রুবিনা মেমনের নামে করা।

এরপর পুলিশ মাহিমে মেমনদের বাসা – হুসেইনি বিল্ডিং-এ রেইড করলে মেমনদের সংশ্লিষ্টটা আরও স্পষ্ট হয়। এছাড়া আরও একটি পরিত্যক্ত স্কুটার দাদারে পাওয়া যায়, যেটাতে  আরডিএক্স ছিল, কিন্ত কোন কারণে তা বিস্ফোরিত হয়নি। মাহিম থেকে মেমনদের পাওয়া চাবির একটা দিয়ে রাকেশ মারিয়া এ স্কুটার চালু করতে পেরেছিলেন। এভাবে মুম্বাই এর অন্যতম মাফিয়া পরিবারের অংশগ্রহণ দেখা যায় বোমা হামলার ঘটনায়।

সঞ্জয় দত্তের সংশ্লিষ্টতা কি ছিল?

মুম্বাইয়ের দাঙ্গার সময়ের ভয়াবহতা দেখে নিজের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সঞ্জয় দত্ত বন্দুক রাখতে চেয়েছিলেন। সামির হিঙ্গরা ও হানিফ কারাওয়ালার ছবিতে কাজ করেছিলেন দত্ত। আর এদের দুজনের সাথেই দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক ছিল। দাউদ তাদের বলেছিলেন যেন সঞ্জয় দত্তকে এগুলো নেওয়ার কথা বলে। তাদের বলাতেই সঞ্জয় দত্ত একটি একে-৫৬ রেখে দেন পরিবারের কথা ভেবে।

কিন্ত মুম্বাই হামলার পর তাঁর সন্দেহ হলে তিনি এগুলো ফেলে দেন। কিন্ত ১৯৯৩ এর ১৯ এপ্রিল তাঁকে পুলিশ অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেফতার করে। পরে তাঁকে মুম্বাই হামলার সহ-ষড়যন্ত্রকারি হিসেবেও অভিযোগ দেওয়া হয়।  ২০০৬ সালে তাঁকে সে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্ত অস্ত্র রাখার অভিযোগের জন্য তাঁর সাজা হয়।এবং ২০০৭ সালে তাঁকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়, যা পরে ২০১৩ সালে কমিয়ে ৫ বছর করা হয়। সঞ্জয় দত্ত ইতিমধ্যে তাঁর সাজা কাটিয়ে ফিরে এসেছেন আবার  বলিউডে।

গ্রেফতারকৃত সঞ্জয় দত্ত; Image Source: the Indian Express

এত বছর পরেও এ হামলার মূল মানুষগুলোই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দাউদ ইব্রাহিম কিংবা টাইগার মেমন কেউই ধরা পড়েনি। যারা ধরা পড়েছে তারা সবাই পরিকল্পনার অংশ ছিল, কিন্ত পরিকল্পনা তাদের ছিলনা। ২০০৬ সালের দিকেও যখন প্রথম এক দফা রায় ঘোষণা শুরু হয় এ মামলার, তখন পর্যন্ত দাউদ ইব্রাহিমের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সম্পূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁকে নিয়ে অভিযুক্তদের একজন বলেছিলেন যে হামলার পরিকল্পনার জন্য তাঁর দুবাই এর বাসায় টাইগার মেমন সহ দেখা হয়েছিল। এর থেকে সরাসরি আর কোন যোগাযোগ পাওয়া যায়নি। তবে বছর পেরিয়ে অনেক কিছুই হয়েছে। এ মামলায় একজনের ফাসি হয়েছে, ৯৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এখন সব দোষীর সাজা নিশ্চিত করলে এ হামলার সকল হতাহতের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে।

লেখক়- আসমাউল হুসনা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *