বিশ্ব

বিতর্কিত নির্বাচন শেষে মিয়ানমারে আবারো সুচির জয়1 min read

নভেম্বর ১৪, ২০২০ 3 min read

author:

বিতর্কিত নির্বাচন শেষে মিয়ানমারে আবারো সুচির জয়1 min read

Reading Time: 3 minutes

মার্কিন নির্বাচনের ডামাডোলে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমার নির্বাচন সংক্রান্ত আলাপ কিছুটা অপাংক্তেয় ছিল অধিকাংশ বাংলাদেশীদের কাছে। অথচ মিয়ানমারের এই নির্বাচনের মাহাত্ম্য বাংলাদেশের কাছে অনেক বেশি। কেবল প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আঞ্চলিক সম্পর্ক বিবেচনাতেই না, বরং রোহিঙ্গা সমস্যা এবং সীমান্ত অস্থিরতার মতো বড় ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য এই নির্বাচনের প্রতি মনোযোগ ছিল বাংলাদেশ সরকারের। তবে আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের জন্য শুভ কিছুই বয়ে আনছে না। বিতর্কিত এক নির্বাচন শেষে আবারো ক্ষমতায় আসছে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির রাজনৈতিক দল। অনুমিতভাবেই এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এরই মাঝে এই নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তবে তাতে কোন প্রভাবই পড়েনি। মায়ানমারের দাবি মোতাবেক তাদের নির্বাচন নিরেপেক্ষ এবং ত্রুটিমুক্ত।

মায়ানমারের নির্বাচন পদ্ধতি

সংসদীয় পদ্ধতি বিবেচনায় মিয়ানমারের সংসদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট। সংসদের নিম্মকক্ষে আসন রয়েছে ৪৪০টি। আর উচ্চকক্ষে আসন ২২৪ টি। প্রায় ৫০ বছর পর সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিলেন অং সাং সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনডিএল)। জয় পেলেও সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেই দেশ পরিচালনা করতে হয়েছিল সু চিকে। এবারের নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেই অংশ নিয়েছে দেশটির ৯০টি রাজনৈতিক দল। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মিয়ানমারের সংসদে মোট ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, দেশটিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এখনো স্বৈর শাসনের গন্ডিতেই আবদ্ধ। এবং এখনো দেশটির সরকারি পর্যায়ে সেনাবাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েই গিয়েছে।

সাড়ে ৫ কোটি নাগরিকের দেশে চলতি নির্বাচনে ভোটাধিকার ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ভোটারের। ৮ নভেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৬ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। এই নির্বাচনে ১ হাজার ১৭১টি জাতীয়, আঞ্চলিক ও রাজ্য ভিত্তিক আসনে ৯০টি রাজনৈতিক দলের ৫ হাজার ৬৪৩ জন প্রার্থী অংশ নেন। আলজাজিরা সহ বিশ্ব মিডিয়ার দাবী, এবারের নির্বাচনে আরাকান রাজ্যের বেশিরভাগ কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণ করা হয়নি। প্রায় ১৫ লাখ ভোটার এর মাধ্যমে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবী তাদের।

সু চির জয় আর ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য সু চির আন্দোলন সংগ্রামের কথা সারাবিশ্বেই এক কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। একপর্যায়ে সেনা সরকার তাকে গৃহবন্দীও করে। সেখান থেকেই নোবেল শান্তি পুরষ্কারও আসে সু চির জন্য। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পরেই সু চির আচরণ যেন আচমকাই বদলে যেতে শুরু করে। সু চি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই আরাকান ও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন অতীতের সব বর্বরতা ছাপিয়ে যায়। যার ফলাফল হিসেবে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার আবাস হয়েছে বাংলাদেশে।

বলে রাখা দরকার, সু চির এনডিএল দেশটির সেনা শাসনের বিরোধী। কিন্তু তা স্বত্তেও রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতি সু চি এবং তার দলের নীরবতা সারা বিশ্বে তাকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে। চলতি নির্বাচনে সু চি জয় পেলেও তাই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ আসা কিছুটা দূরাশা। যদিও বাংলাদেশের সরকারি পর্যায় থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও তাদের প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে নতুন করে আলোচনা শুরু হবে। এ ব্যাপারে চীন থেকে কূটনৈতিক সহায়তা নিতেও প্রস্তুত বাংলাদেশ।

একইভাবে আশার সুরে কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি আশা করেন, বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে নিরাপত্তা ও মর্যাদা সহকারে মায়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া হবে। নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে এগিয়ে আছে কাচিন স্টেট পিপলস আর্মি। দলটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বেশ ঘনিষ্ঠ হলেও নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১০ সালে সেনাবাহিনীর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারাই জয়ী হয়েছিল। যদিও ২০১৫ সালের নির্বাচনে তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে।

ইউএসডিপির অভিযোগ এবং নতুন সংকট

নির্বাচন ঘিরে নিজেদের অভিযোগ জানিয়েছে আরেক সেনা সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলাপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। তারা দেশটির সেনাবাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছে নতুন করে ভোট আয়োজনের। এখনো পর্যন্ত মায়ানমারের প্রশাসনিক ক্ষমতার অনেকটাই সেনাবাহিনীর কাছে থাকায় এবং সু চির সাথে সেনাবাহিনীর বিরোধের জের ধরে আরো একদফা নির্বাচনের সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেয়া চলেনা।

গত মঙ্গলবার থেকেই প্রাথমিক ফলাফল আসতে শুরু করলে দেখা যায়, ব্যাপকভাবে এগিয়ে আছে অং সাং সু চির  নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি। এবারের নির্বাচনে সু চির জয় ঠেকাতে স্বয়ং সেনাবাহিনীই তৎপর রয়েছে। এনডিএল দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে ব্যাপক পরিসরে সংবিধান সংস্কার হতে পারে। সেক্ষেত্রে সংসদে ২৫ শতাংশ আসন হারাতে পারে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে সংসদের বাইরেও চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে সেনা বাহিনীর কাছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী আভাস বলছে, সংবিধান সংস্কার হলে এই চার মন্ত্রণালয় থেকে অন্তত এক বা দুই জায়গায় অধিকার হারাবে সেনাবাহিনী।

নতুন করে আসা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সত্যিই অং সাং সু চি ক্ষমতায় যেতে পারছেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সু চির ক্ষেত্রে বড় ভরসা তার দেশের জনগণ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার নীরবতার কারণে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ইমেজ সংকট হলেও, নিজ দেশে জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণে। মিয়ানমারে “বাঙালি মুসলিম” নামে পরিচিত এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি পুরো দেশেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। সব বিবেচনায় মিয়ানমার আপাতত সু চির কাঁধেই ভর করে এগুতে চলেছে। আর বিগত ৫ বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সরকারি ক্ষমতায় যেইই আসুক, রোহিঙ্গা সমস্যা সহসাই সমাধান করতে পারছেনা বাংলাদেশ।

-জুবায়ের আহাম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *