মার্টিন লুথার কিং : সাধারণ কৃষাঙ্গ থেকে মহানায়ক 1 min read
Reading Time: 5 minutesজর্জ ফ্লয়েড যখন পুলিশের হাঁটুর নিচে কাঁতরে উঠে বলছিলেন, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। তখন অন্যলোকে বসে হয়ত সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন মার্টিন লুথার কিং নামের আরেকজন মানুষ। “I have a dream” বলে যিনি আরো প্রায় ৬০ বছর আগেই জর্জ ফ্লয়েডদের জন্য সমতার পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েডের মতো তারও মৃত্যু হয়েছিল অপাঘাতে। একজন শ্বেতাঙ্গের গুলিতে। মার্টিন লুথার কিং, সাধারণ নিপীড়িত মানুষ থেকে যিনি হয়েছেন মহানায়ক। এক হাতে বদলেছেন পৃথিবীকে। নিজের রক্ত ঢেলে যিনি মুছতে চেয়েছেন বর্ণবাদের বিষ।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা
যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জর্জিয়ায় ১৫ই জানুয়ারি, ১৯২৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র এবং মা আলবার্ট উইলিয়ামস কিং। মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র ছিলেন একজন ব্যাপ্টিস্ট মন্ত্রী। মার্টিন লুথার কিং নিজেও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হয়েছিলেন ব্যাপটিস্ট মন্ত্রী। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ব্যাপ্টিস্ট পরিচয় মুছে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মানবাধিকার কর্মী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্ট এর নেতা।
মাহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সাথে নিজের খ্রিস্টীয় ধর্ম বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নাগরিক আন্দোলন। যার মূলে ছিল চামড়ার রঙে নয়, মানুষ বিবেচিত হবে চরিত্র ও কর্মগুণে।
১৯৫০ সালের মাঝামাঝি হতে আমৃত্যু তিনি আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্টের নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। সাদা কালোর বিভেদ যে কতটা ভয়ানক হতে পারে সেটি তিনি বুঝেছিলেন একেবারে শৈশবে। যখন ৬ বছর বয়স তখন মার্টিন লুথার কিং এর সাথে এক সাদা বালকের বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হবার সময় সেই সাদা বন্ধুর বাবা কিং এর সাথে মিশতে দেয়নি তার ছেলেকে। এজন্য কিং মানসিকভাবে খুবই হতাশ ছিলেন। আটলান্টার বুকার টি ওয়াশিংটন হাইস্কুলে তার স্কুল জীবন শুরু। কালো চামড়ার ছিলেন বলে কালোদের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলে তাকে যেতে হয়েছিল। মার্টিন লুথার কিং ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। নবম এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে দুইবার অটো-প্রমোশন পেয়ে ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মোর-হাউজ কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান এর উপর স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শন শাস্ত্রে পিএইচডি, ডক্টর অব ফিলোসোফি ডিগ্রি লাভ করেন।
মাইকেল কিং থেকে মার্টিন লুথার কিং
একটি বিষয় এখানে পরিষ্কার হওয়া দরকার। মার্টিন লুথার কিং কিন্তু আসলে এই ব্যক্তির আসল নাম নয়। বরং পরিবর্তিত। মার্টিন লুথার কিং এর প্রকৃত নাম ছিল মাইকেল কিং। মার্টিন লুথার কিং এর বাবা মাইকেল কিং সিনিয়র ধর্মযাজক থাকা অবস্থায়, ১৯৩১ সালে জার্মানিতে ভ্রমন করার সময় বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক মার্টিন লুথার এর সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তাঁর ধর্ম বিপ্লবের ইতিহাস জেনে এতটাই অভিভূত হন যে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিজের নাম এবং নিজের ৫ বছর বয়সী ছেলের নাম মাইকেল পরিবর্তন করে রাখেন মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।
ব্যাপ্টিস্ট মন্ত্রী থেকে জনমানুষের নেতা
মার্টিন লুথার কিংয়ের মূল আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসে এক নারীর বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। লুথার কিং ও অন্য নেতারা এ ঘটনার প্রতিবাদে বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩৮১ দিন এ অবস্থা চলার পর আলাবামা রাজ্যের সব যানবাহনে বর্ণবৈষম্য বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি, চাকরিতে সমতা অর্জন এবং সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লুথার কিং, বেয়ারড রাস্তিন এবং আরও ছয়টি সংগঠনের সহায়তায় ‘মার্চ অন ওয়াশিংটন ফর জব এন্ড ফ্রিডম’ নামে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশটি ছিলো আমেরিকার ইতিহাসে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ মহাসমাবেশ। এই সমাবেশের জন্য ২০০০ টি বাস, ২১ টি স্পেশাল ট্রেন, ১০ টি এয়ারলাইন্স এর সকল ফ্লাইট ও অগুণিত গাড়িতে করে ওয়াশিংটনে এসেছিল সাধারণ মার্কিনরা। সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল লিঙ্কন মেমোরিয়ালে। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল ঐ দিনটিতে। “I Have a Dream” নামে লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষণ এখনো বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাগ্মিতার দৃষ্টান্তগুলোর অন্যতম হয়ে আছে।
একটি ভাষণ, একটি প্রেরণা…
মার্টিন লুথার কিং সেদিন বলেছিলেন, কোন একদিন আসবে যেদিন তার সন্তানেরা নিজেদের গায়ের রঙে না বরং বিবেচিত তাদের নিজস্ব চরিত্র দিয়ে। সেদিনের সেই ভাষণ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বরং প্রেরণা জুগিয়েছে সারা পৃথিবীকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন আর বর্ণবাদের বিষে নিষ্পেষিত দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলাদের পাশেও ছিল মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই অনবদ্য ভাষণ।
“এক অর্থে আমরা আমাদের রাজধানীতে এসেছি একটা চেক ভাঙাতে। আমাদের প্রজাতন্ত্রের স্থপতিরা যখন সংবিধানের সেই দারুণ কথাগুলো লিখছিলেন এবং দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা, তখন তাঁরা এমন এক চেকে সই করছিলেন, প্রতিটি আমেরিকান যার উত্তরাধিকারী। সেটা ছিল সব মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, মুক্তি ও সুখ সন্ধানের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি। আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমেরিকা সেই প্রতিশ্রুতিপত্র খেলাপ করেছে, অন্তত তার কালো নাগরিকদের বেলায়। সেই পবিত্র দায়িত্ব মান্য করার বদলে আমেরিকা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের হাতে যে চেক ধরিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত এসেছে, ‘তহবিল ঘাটতি’র চিহ্ন নিয়ে। কিন্তু ন্যায়বিচারের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে—এ আমরা বিশ্বাস করতে রাজি না। আমরা মানতে রাজি না, এই জাতির সুযোগ ও সম্ভাবনার সিন্দুকে যথেষ্ট তহবিল নেই। তাই যে চেক চাইবা মাত্র মুক্তির দৌলত আর ন্যায়বিচারের নিরাপত্তা দেবে, আজ আমরা এসেছি সেই চেক ভাঙাতে। এখনই সময় ঈশ্বরের সব সন্তানের জন্য সুযোগের সব দ্বার অবারিত করে দেওয়ার। এখনই সময় বর্ণবৈষম্যের চোরাবালি থেকে আমাদের জাতিকে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনের পাথুরে জমিতে তুলে ধরার।
যত দিন না কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবে, তত দিন আমেরিকায় বিরাম ও শান্তি থাকবে না। যত দিন না ন্যায়ের সুদীপ্ত দিন আসছে, তত দিন বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় আমেরিকার ভিতকে কাঁপিয়ে দিতে থাকবে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এই জাতি জাগ্রত হবে এবং মানুষের এই বিশ্বাসের মূল্যায়ন করবে, সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান।”
মার্টিন লুথার কিং এর দেয়া সেই ভাষণের বয়স ষাট বছরের কাছাকাছি। কিন্তু এখনো অনেকভাবেই কৃষাঙ্গদের হেনস্তা হতে হচ্ছে। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্নটা কখনো পুলিশের হাটুর নিচে চাপা পড়ে, কখনো বালোতেল্লি কিংবা রাহিম স্টার্লিংদের মতো তারকাদের ফুটবল মাঠে কাঁদতে বাধ্য করে।
সম্মাননা
মানুষের পাশে থাকার কারণে জনমানুষের কাছ থেকে ব্যাপক ভালবাসা এবং সম্মানও পেয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন কেবল তিনজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় ছুটি বরাদ্দ। তাদের দুইজন হলেন আমেরিকান প্রথম প্রেসিডেন্ট, স্বাধীনতার কারিগর জর্জ ওয়াশিংটন এবং আমেরিকার আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস। অন্যজন মার্টিন লুথার কিং। আর এই তিনের মাঝে কিং-ই আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি যার সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়। আমেরিকার বাইরে টরন্টো (কানাডা) এবং হিরশিমাতে (জাপান) মার্টিন লুথার কিং দিবস পালন করা হয়। মার্টিন লুথার কিং এর নামে পুরো আমেরিকায় প্রায় ৭০০ টি রাস্তার নামকরন করা হয়েছে।
বর্ণিল জীবনে ১৯৬ত সালের ১৪ অক্টোবর তিনি তাঁর অহিংস আন্দোলনের জন্য, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার তার ঝুলিতে রয়েছে। কোন সঙ্গীতশিল্পী না হয়েও বেস্ট স্পোকেন ওয়ার্ড এ্যালবাম ক্যাটাগরিতে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন মানবতার এই মহান কর্মী। ১৯৭১ সালে তাঁকে এই মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হয়েছিল তাঁর “Why I Oppose the War in Vietnam“ এ্যালবাম এর জন্যে।
আততায়ীর হাতে মৃত্যু
১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। মেমফিসে অবস্থিত লরাইন মোটেলে অবস্থান করছিল মার্টিন লুথার কিং। সেখানকার সিটি স্যানিটেশন কর্মীদের ধর্মঘটকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
সেদিন সন্ধ্যা ছয়টা এক মিনিটে লুথার কিং মোটেলের ৩০৬ নাম্বার কামরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জেমস আর্ল রে নামক শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী যুবকের গুলিতে নিহত হন। হত্যাকান্ডে জেমস রেমিংটন ৩০-০৬ রাইফেল ব্যবহার করে, যা ছদ্মনামে দিন পাঁচেক আগে কিনেছিল সে। গুলি করার পর বুলেটটি লুথারের ডান গাল ভেদ করে, স্পাইনাল কর্ড হয়ে ঘাড়ের শিরা ছিড়ে ফেলে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় পড়ে যান। সাতটা পাঁচ মিনিটে সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকান্ডের প্রায় দুই মাস পরে, জুন মাসের আট তারিখে লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে জেমস ধরা পড়ে। হত্যাকান্ডের দায়ে তার ৯৯ বছরের কারাদণ্ড হয় এবং কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৯৮ সালে ৭০ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ফুটবল মাঠে প্রতিবাদ করেছেন জ্যাডন স্যাঞ্চো, আশরাফ হাকিমিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু পৃথিবীতে আবার ঠিক কবে জর্জ ফ্লয়েডের মতো মানুষরা হাসিমুখে বাঁচতে পারবে তার ঘোষণা কেউ দিতে পারছেনা। পরপারে তাই মার্টিন লুথার কিংয়ের অপেক্ষাও বাড়বে অনেকটা দিন। হয়ত কোন একদিন সত্যিকার অর্থে নতুন কেউ মার্টিন লুথার কিং এর মতো ‘I had a dream’ এর বদলে বলতে পারবে, ‘We made it’। যেদিন সত্যিকার অর্থেই জর্জিয়ার কোন খোলা মাঠে সাদাকালো বিভেদ ভুলে মানুষ পরিচয়ে একত্র হবে মানুষ। সে দিনের অপেক্ষায় ওপাশে মার্টিন লুথার কিং আর এপাশে পুরো পৃথিবী।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ