মাও সে তুংঃ মাওবাদের প্রবর্তক1 min read
Reading Time: 4 minutesকর্মই একটা মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুকে সার্থক করে তুলে। মানুষের কর্ম তাঁর মৃত্যুর ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে এমন এক সত্তা তৈরি করে যা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে হাজার হাজার বছর। এমনই এক সত্তা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক মাও সে তুং। মাও সে তুং চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রাণ ভোমরা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তিনি আমৃত্যু চীনের কমিনিউস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মাও সে তুং (ইংরেজিতে মাও জেদং) ১৮৯৩ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর চীনের হুনান প্রদেশের শাং তান জেলার অন্তর্ভুক্ত শাউ শাং চুং গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র সাত বছর বয়স থেকেই তিনি জমিতে কাজ করা শুরু করেছিলেন। তাঁর বাবা মাও জেন শেং (শুন শেং) এক পর্যায়ে কৃষিকাজ ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।
১৯০১ সালে আট বছর বয়সে প্রথম স্কুলে ভর্তি করানো হয় মাও সে তুং-কে। ১৯০৬ সাল পর্যন্ত গ্রামের সেই স্কুলেই পড়াশুনা করেন তিনি। পড়াশুনার পাঠ চুকানোর পর মাত্র এগারো বছরের এক মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। তবে মাও কখনো এই মেয়ের সাথে বসবাস বা সংসার করেন নি। বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি চীনের বর্তমান রাজধানী বেইজিং চলে আসেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯১১ সালে চীনে রাজতন্ত্র বিরোধী গণআন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সান ইয়াত সেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে যোগ দেন মাও সে তুং। সেই আন্দোলনে জয়লাভের পরই সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় চীনা জাতীয়তাবাদী দল কউ মিঙ টাঙ।
১৯১৮ সালে মাও সে তুং চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহকারী হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। লাইব্রেরিতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং জীবন ধর্মী বই পড়তেন। এসময় তিনি এক বামপন্থি বুদ্ধিজীবীর লেখা বই পড়ে বিশেষ প্রভাবিত হন। এরপর তিনি মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, তখনকার প্রচলিত বৌদ্ধবাদ অথবা কনফুসিয়বাদ কেবলমাত্র ভ্রম ছাড়া কিছুই না। অল্পদিনেই তিনি মার্কসবাদ সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা করে একজন পাকা মার্কসবাদী হয়ে উঠেন। ধীরে ধীরে তিনি মার্কসবাদ মদদ পুষ্ট বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন মার্কসবাদী হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেন।
১৯১৯ সালে চীনে বুদ্ধিজীবীদের এক অভিনব আন্দোলন শুরু হয়। তাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো আধুনিক চীন গড়ে তুলা। হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীর সাথে ঐ আন্দোলনে নিজের বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন মাও সে তুং। ১৯২০ সালে তিনি শাংতান ফিরে আসেন এবং নিজের জন্মভূমি হুনান প্রদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হন। কিন্তু তার ডাকে কেউ সাড়া না দেওয়ায় তাঁর এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
ব্যর্থ মাও সে তুং ১৯২১ হুনান ছেড়ে সাংহাই চলে আসেন। তখন চীনের কমিনিউস্ট পার্টি গঠনের কাজ চলছিলো। চীনা কমিনিউস্ট পার্টি গঠনে তিনিও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগ দেন। কিছুদিন পর তিনি পুনরায় নিজের জন্মভূমি হুনান প্রদেশে ফিরে আসেন এবং সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি আঞ্চলিক শাখা খোলেন। মাও সে তুং সেখানে শ্রমিকদের শেখাতেন কীভাবে ধর্মঘট করতে হয়। ১৯২৩ সালে সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত চীনা কমিনিউস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে হুনান প্রদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন মাও। এই কংগ্রেসে সিংহভাগ প্রতিনিধি কুয়োমিনতাংয়ের নেতৃত্বে কাজ করার জন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন এবং মাও পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। এরপর তিনি সাংহাইয়েই নিজের থাকার ব্যবস্থা করেন। কারণ কেন্দ্রীয় দলের হয়ে কাজ করার জন্য এর কোন বিকল্প ছিলো না।
একই বছর চীনা কমিনিউস্ট পার্টি জাতীয়তাবাদী কউ মিঙ টাঙ দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে জোট বাঁধে। এই জোট গঠন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আর মূলত এজন্যই তাঁকে কউ মিঙ টাঙ দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্যপদ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯২৭ সালের দিকেই এই জোট ভেঙে যায়। কারণ কউ মিঙ টাঙ দলের নেতা চিয়াং কাই সেক ছিলেন কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল, যা কমিউনিস্ট পার্টির নীতিবিরোধী ছিলো। ফলে মাও এই দলের সদস্যপদ ত্যাগ করেন।
১৯২৫ সালের দিকে তাঁর নিজ গ্রামে একটি কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। ভবিষ্যৎ অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে মাও সেই সংগঠনে কৃষক এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এক সশস্ত্র বাহিনীও তৈরি করেছিলেন।
তৎকালীন চীনা সরকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেলে বেগতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে যান মাও। সারাদেশে কমিউনিস্টদের উপর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নেমে আসে। মাও তখন নিজ জন্মভূমি হুনান প্রদেশে তাঁর গঠিত সংগঠন নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই আন্দোলনও ভেস্তে যায়। কিন্তু কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না মাও সে তুং। হুনান ছেড়ে তিনি জিয়াংজি প্রদেশ চলে যান এবং সেখানে তরুণদের নিয়ে নতুন উদ্যমে পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। মাও-এর গঠিত এই সশস্ত্র বাহিনী “রেড আর্মি” নামে সর্ব মহলে খ্যাতি পায়। রেড আর্মির খবর পৌঁছে চীনা সরকারের কানে। চিয়াং শেক সৈন্যদল পাঠান মাও-এর রেড আর্মিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অতি কৌশলী মাও সেখান থেকে দলবল নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন। দীর্ঘদিন বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থেকে রেড আর্মি শক্তি বাড়াতে থাকে।
১৯৩৪ সালের শেষের দিকে মাও সে তুং এক ঐতিহাসিক লং মার্চের সূচনা করেন। উত্তর চীনের ইয়ানান প্রদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা এই লং মার্চ শুরু হয়েছিলো প্রায় ছয় হাজার মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে। এই লংমার্চেও সরকার পক্ষের একদল গেরিলা হামলা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। হাজার খানেক নারী ও শিশু আহত হয়। মাও সে তুং আহত এবং অসুস্থদের পেছনে রেখেই লং মার্চ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই লংমার্চের কল্যাণে গোটা চীন জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা ঈর্ষণীয়ভাবে বাড়তে থাকে। সমগ্র চীন জুড়ে রেড আর্মির সেনারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরকার দলীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য দলগুলো সম্মিলিতভাবে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৪৬ সালের দিকে এই মতবিরোধ চরমে পৌঁছালে চীনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। মাও সে তুং এর কৌশলী চিন্তাভাবনায় এই গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে কমিউনিস্ট পার্টি। জয়লাভের পর তার নেতৃত্বে চীনের বিশাল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বিজয়ীর বেশে কমিউনিস্ট পার্টির সেনারা ক্যান্টনে প্রবেশ করলে চিয়াং কাই শেক তার দলবল নিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে ফরমোজা দ্বীপে চলে যান। এভাবেই এই স্বৈরশাসককে পরাজিত করে চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন মাও সে তুং। উল্লেখ্য যে, তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরবর্তীতে মাওয়াবাদ নামে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরে।
১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি চীনকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হিসেবে ঘোষণা করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
বর্ণাঢ্য বৈপ্লবিক জীবনের শেষভাগে এসে মাও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থাতেই ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।