মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীঃ বাঙালির স্বাধীনতার পথ রচনা করেছিলেন যিনি1 min read
Reading Time: 8 minutesব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলায় গ্রামভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তক মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভারতীয় উপমহাদেশের স্বনামধন্য ধর্মগুরু এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বাংলায় রাজনীতি ব্যাপারটাকে শুধুমাত্র শিক্ষিত এবং একটা নির্দিষ্ট মহলের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিলো। মাওলানা ভাসানী রাজনীতির আলোকবর্তিকা হাতে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এর আলো ছড়িয়ে দেন। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। ইতিহাসে তাই তাঁর নাম মজলুম জননেতা হিসেবেই অধিক পরিচিত।
জন্ম এবং বেড়ে উঠা
১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে পিতা হাজী শারাফাত আলী খান এবং মা বেগম শারাফাত আলীর কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন আবদুল হামিদ খান। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বাল্যকালের তাঁর ডাকনাম ছিলো চেগা মিয়া। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর শৈশব আর দশটা শিশুর মতো এতোটা সহজ ছিলো না। তিনি যখন খুব ছোট তখনই তাঁর বাবা শারফাত আলী মারা যান। এর কিছুদিন পর মহামারী রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা এবং অন্য দুই ভাই মারা যায়। ফলশ্রুতিতে অবর্ণনীয় দুঃসহ এক শৈশব পার করতে হয়েছিল মাওলানা ভাসানীকে।
পিতৃহীন আবদুল হামিদ প্রথমে চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে বেশ কিছুদিন থাকার পর ইরাকের তৎকালীন বিশিষ্ট আলেম ও ধর্মপ্রচারক নাসিরউদ্দিন বোগদাদীর আশ্রয়ে চলে যান। ওখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে জমিদার শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতে শুরু করেন। সেখানে তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসায় মোদাররেসের কাজ করতেন।
সেখান থেকে তিনি ১৮৯৭ সালে আসাম চলে যান এবং এরপর ১৯০৭ সালে ইসলামিক শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন। দুই বছর সেখানে পড়াশুনা করে তিনি পুনরায় আসাম চলে আসেন।
রাজনীতিতে পদার্পণ
১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিং ভ্রমণ করেন। মাওলানা ভাসানীও তখন ময়মনসিংহেই ছিলেন। সেখানে তাঁর ভাষণ শুনে মাওলানা ভাসানী ভীষণ অনুপ্রাণিত হন। এরপর ১৯১৯ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন। এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিযোগে তাঁকে দশ মাস কারাভোগ করতে হয়। কারাভোগ শেষে তিনি সক্রিয়ভাবে খিলাফত আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল অবধি চলা উত্তরবঙ্গের প্রলয়ংকরী বন্যার সময় তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর সাথে একযোগে ত্রাণকার্য চালিয়ে যান। মূলত সেসময়ই তিনি ভারত উপমহাদেশের বলিষ্ঠ নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন।
১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস “স্বরাজ্য পার্টি” গঠন করলে মাওলানা ভাসানী সেই দলকে সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মাওলানা ভাসানী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তাধারার। রাজনীতি নিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও পাঁচবিবির জমিদার শাসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর অনুরোধে তাঁর কন্যা আলেমা খাতুনকে তিনি বিয়ে করেন। তারপর ১৯২৬ সালে তিনি সহধর্মিণীকে সাথে নিয়েই তিনি আসাম চলে আসেন। বিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। সংসার এবং রাজনীতি উভয়ই সমান তালে চালিয়ে নিয়েছেন তিনি। তিনি আসাম গমনের কিছুদিনের মধ্যেই কৃষক-প্রজা আন্দোলনে সুত্রপাত হয়। এই আন্দোলনেও তিনি কৃষক-প্রজাদের হয়ে তাদের দাবী আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। আসাম এবং পূর্ব বাংলার কৃষক মজদুরদের স্বার্থ আদায়ে এবং জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্রতর করতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে তিনি প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সম্মেলনের পর তিনি সর্বমহলে ভাসানীর মাওলানা নামে পরিচিতি লাভ করেন। মূলত এরপর থেকেই তাঁর নামের শেষে “ভাসানী” টাইটেলটি যুক্ত হয়।
ভাসান চরের সফল সম্মেলনের পর কৃষক-মজদুর মহলে মাওলানা ভাসানী হয়ে উঠেন এক অবিসংবাদিত নেতা।
১৯৩১ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় তিনি বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে টাঙ্গাইলে আসেন। তখন তাঁর সাথে সন্তোষের জমিদারের বিরোধ দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে তিনি ময়মনসিংহ জেলা থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে তিনি সিরাজঞ্জে তিন দিন ব্যাপী বিশাল এক কৃষক-প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনের পর তাঁর জন্মভূমি পাবনা জেলা থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এতোকিছুর পরেও তিনি দমে যান নি। বরং আরও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে কৃষক-মজদুরদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। সেই সুত্রে ১৯৩৩ সালে পুনরায় আসামের ভাসানচরে এবং উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধায় কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন।
মুসলিম লীগ গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী ১৯৩৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগ দেন। মুসলিম লীগে যোগ দেওয়ার সাথে সাথেই তাঁকে আসাম ইউনিটের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সেই সময় আসাম সরকার “লাইন প্রথা” নামে এক বিতর্কিত আইন পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে বাঙালি বাসিন্দাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিসীমা বেঁধে দেওয়া হয়। আর এজন্য আসামে অবস্থানকারী বাঙালি বাসিন্দাদের চরম ভোগান্তির মধ্যে পরতে হয়। এছাড়া এই আইন পাস হওয়ার পর স্থানীয় আসামী বাসিন্দারা বাঙালিদের উচ্ছেদ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। স্থানীয় এবং বাঙালিদের মধ্যে পরিসীমা বিষয়ক দ্বন্দে বহু মানুষ হতাহত হয়। এই সময়টাতেই তিনি আসামে “আসাম চাষী মজদুর সমিতি” গঠন করেন এবং আসামে এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়লাভ করেন এবং তাঁর এই সদস্যপদ দেশভাগের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলো।
মুসলিম লীগকে জনগণের পার্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি গোটা দেশজুড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন এবং মুসলিম লীগের প্রতি জনগণের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৪০ সালে তিনি প্রাদেশিক সভাপতি হিসেবে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগ দেন। লাহোর সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাব সাবজেক্ট কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে পাকিস্তান প্রস্তাব প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৫ সালে আসামজুড়ে “বাঙাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গার উপদ্রব হয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য মাওলানা ভাসানী গোটা আসাম চষে বেড়ান। এরপরের বছর তিনি এবং তাঁর দল মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তীব্র নির্বাচনী আন্দোলন গড়ে তুলে। একই বছর মে মাসে আসাম থেকে বিতারিত বাস্তুহারা অসহায় মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি অনশনে যান।
১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমগ্র আসামজুড়ে আন্দোলনের ডাক দেন মাওলানা ভাসানী। কিছুদিন পর আসাম দিবস পালনের প্রস্তুতি সভায় তিনি এক সংগ্রামী ভাষণ দেন। এর পরপরই আসাম সরকার তাঁকে আসাম ত্যাগের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তিনি সেই নির্দেশ মানেন নি। এতে কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। একই বছর ২০ জুন তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি তাঁর জন্মস্থান পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। তাঁর দীর্ঘদিনের আসাম জীবনের সমাপ্তি ঘটে এভাবেই।
স্বাধীনতার পথ রচনায় মাওলানা ভাসানী
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে মাওলানা ভাসানী মুসলিম লীগের মনোনিত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যাবে, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতার ইস্যুকেও বারবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ তিনি পার্লামেন্টে সভার কার্যাক্রম বাংলা ভাষায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান। এই দাবি নিয়ে তিনি বিশেষ পীড়াপীড়িও করেন।
এরপর ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় দেওয়া ভাষণে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম নাকি ? এছাড়া তিনি আরও বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে সংগ্রহকৃত করের ৭৫% পূর্ব বাংলার রাজস্বখাতে জমা রাখতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব আদায় করা হতো এবং এই রাজস্বের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নেয়। এর ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। অবাক করার ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের সর্বমোট বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় দলের সিনিয়র সদস্যরা মাওলানা ভাসানীর উপর নাখোশ হয় এবং আদালতে তাঁর নামে মামলা দায়ের করা হয়। এই ঘটনার পর মাওলানা ভাসানীকে নানারকম হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মওলানা ভাসানী পার্লামেন্টের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা ভাসানী ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০০ এর অধিক কর্মী সম্মেলনে যোগ দেয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মওলানা ভাসানী। ঐদিনই পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ আত্মপ্রকাশ করে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রথম কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন শামসুল হক এবং যৌথভাবে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও খন্দকার মোশতাক।
১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ঐ বছর ১১ অক্টোবর ঢহহাকার আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা আয়োজন করা হয়। সভায় দুর্ভিক্ষ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী তোলা হয়। জনসভা শেষে এক বিশাল মিছিল বের হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী সেই মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এই ঐতিহাসিক মিছিলটি “ভূখা মিছিল” নামে খ্যাত। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তাঁকে ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় কারাগারে থেকে ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন পূর্ববঙ্গ যখন উত্তাল, ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে তাঁর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনে সহযোগিতা করার অপরাধে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে তাঁর উপর খুব বাজেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো।
নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রবল জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। প্রাদেশিক নির্বাচনের আগে ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টি আসনের মধ্য ২২৮ টিতেই জয়লাভের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ১৯৫৪ সালের ২৫ মে মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেন গমন করেন। তিনি সুইডেন যাওয়ার মাত্র ৫ দিন পর অর্থাৎ ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয় এবং গভর্নরের শাসন জারি করে। একই সাথে মওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকাকালীন এই ১১ মাস তিনি লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করেন। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পরের বছর পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ দমনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁর এই আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়ার পর সরকার দাবি মেনে নেয় এবং তিনি ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন।
১৯৫৭ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে বক্তৃতায় মাওলানা ভাসানী এক ঐতিহাসি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, “পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে।”
এছাড়াও তিনি ঐ ভাষণে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের তীব্র দাবি জানান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করেন। ফলশ্রুতিতে মাওলানা ভাসানী ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ঐ বছরই ২৫ জুলাই মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সিনিয়র এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু করেন। সেই সুত্রে ১২ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকেও কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। এবার গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি ৪ বছর ১০ মাস ধরে কারাবন্দী ছিলেন। বন্দী অবস্থাতেও তিনি বন্যাদূর্গতদের সাহায্য, পাটের ন্যায্যমূল্যের দাবিসহ নানান দাবিতে কারাগারেই অনশন ও ধর্মঘট করেন। দীর্ঘদিনের কারাবাস শেষে ১৯৬২ সালের ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন। জেল বের হয়ে তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর সাথে জড়িত হন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালে মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে তিনি চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবিতেও তিনি আন্দোলন করেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়। এরপর তাঁর দল ন্যাপ-এর প্রার্থীরা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। একই বছর ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় মাওলানা ভাষানী ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। এরপর ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। একই বছর ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি ভারতে চলে যান। তিনি মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এই বিবৃতিটি ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন যাতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির মূলমন্ত্র ছিলো, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিল্লি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করেন। তবে মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। এরপর তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে কিছুদিন গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।