সত্যিই কি পুতিনের ক্ষমতা বাড়ছে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত?1 min read
Reading Time: 3 minutesদুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারতেন না, মাঝে তাই খুব বিশ্বস্ত মানুষকে বসিয়েছিলেন প্রেসিডেন্টের আসনে। এই সময়টায় নিজে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। চার বছর পরে আবার বসলেন প্রেসিডেন্টের আসনে। সাংবিধানিক মেয়াদ ছিল ৪ বছর, সেখান থেকে বাড়িয়ে করা হলো ৬ বছর। বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতা থাকছে এবছর পর্যন্ত। তবু যেন ক্ষমতার পিপাসা মিটছে না ভ্লাদিমির পুতিনের। নতুন সংবিধান সংস্কার করে ক্ষমতা বাড়াতে চলেছেন ২০৩৬ পর্যন্ত।
সম্প্রতি রুশ পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেন পুতিন। এরপর এই সংশোধনীর উপর সাত দিনব্যাপী ভোটও গ্রহণ করা হয়। ফলাফল ঘোষণায় রাশিয়ার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধনীর পক্ষে ভোট পড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। আর বিপক্ষে ভোট গিয়েছে ২১ শতাংশ।
মূলত সংবিধানের মোট ১৪টি অনুচ্ছেদে সংশোধনের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাকি সব কিছু ছাপিয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বর্ধনের প্রস্তাবনা। নতুন পাস হওয়া সংশোধনীর আলোকে পুতিন ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। আর সেই নির্বাচনে জয়ী হলে এরপর আরও দুই মেয়াদে ৬ বছর করে মোট ১২ বছর অর্থাৎ ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন তিনি। তাই যদি হয়, পুতিনের বয়স তখন হবে ৮৩ বছর।
রাশিয়ার বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, এক ব্যক্তি একটানা দুবারের বেশি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কিন্তু ব্যক্তিগত ইচ্ছে আর গণভোট দুইই পক্ষে থাকায় সেই পুরাতন নিয়ম ভাঙতে চলেছেন স্ট্যালিন পরবর্তী যুগে রাশিয়ার সবচে দীর্ঘ এই শাসক।
বিতর্কিত ভোট!
বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ মহামারী। এরমাঝেও ২৫ জুন থেকে সংবিধান সংশোধনীর উপরে ভোট দিয়েছে রাশিয়ান জনগণ। যেখানে লোক সমাগম এড়িয়ে চলাই মুখ্য, সেখানে রাশিয়ানদের মাঝে এহেন আচরণ কেন? বলে রাখা দরকার, বিশ্বব্যাপী কোভিড আক্রান্তের তালিকায় রাশিয়া আছে তালিকার দুই নং স্থানে।
যদিও ভিড় এড়াতে একদিনের বদলে ৭ দিনে ভোট নিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু কেন এত তড়িঘড়ি? পুতিনের ক্ষমতা বাড়াতে কেন এই সময়েই ভোট নিতে হল? রাশিয়ার প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি গণভোটে প্রাপ্ত ফলাফলকে বলেছেন ‘বড় মিথ্যা’। যদিও নাভালনির এই দাবী সত্য কি মিথ্যা সেটি যাছাই করারও কোন উপায় ছিল না। মহামারীর এই সময়ে কোন পর্যবেক্ষক দলই ৭ দিন রাশিয়ার মতো একটি দেশে থাকতে রাজি ছিল না। নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল না থাকায় সত্যিই কি পরিমাণ ভোট জমা পড়েছে বা কতটা স্বচ্ছতা ছিল তাও বলা মুশকিল ছিল।
প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানী মস্কো এবং পশ্চিম রাশিয়ার বিভিন্ন অংশে ভোটদানের হার ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ। আবার কিছু কিছু অঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলেও দাবী করেছে রাশিয়ান নির্বাচন কমিশন। অথচ করোনাকালীন সময়ে সত্যিকার অর্থেই এত রাশিয়ান বের হয়েছেন এটা ভাবা কষ্টকর। এছাড়াও ভোটাররা যাতে ভোটদানে উৎসাহী হন, সে লক্ষ্যে নেওয়া হয় ব্যতিক্রমী কিছু পদক্ষেপ। যেমন: র্যাফল ড্র। পুরস্কার হিসেবে ছিল নগদ অর্থ, ফ্ল্যাট ইত্যাদি। এসবের জন্য লোক সমাগম হলেও রেখে গিয়েছে বিতর্কের বড় ছাপ।
যদিও স্বাধীন ভোট পর্যবেক্ষকরা সেই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তেমনই একজন গ্রিগরি মেলকোনয়ান্তস সংবাদসংস্থা এপিকে জানান, অনিয়মের ছবিটা স্পষ্ট। অনেক জায়গাতেই ভোটদানের হার বেশি দেখানো হয়েছে।
বলে রাখা দরকার, নতুন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে রয়েছে, সমকামী বিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, আন্তর্জাতিক আইনের উপর রাশিয়ার আইনের আধিপত্য এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বাড়ানো এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মত বিষয়গুলো।
আরও পড়ুন- ভ্লাদিমির পুতিন: স্পাই থেকে প্রেসিডেন্ট
কেন এই সংশোধন?
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিন ২০০০ সালে প্রথম রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। সেই থেকেই ক্ষমতার মূল পদে আছেন সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ২০০০ সাল থেকে দুই মেয়াদে চার বছর করে মোট আট বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০৮ সালে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালন করতে অনুগত রাজনীতিবিদ দিমিত্রি মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ২০১২ সালে মেদভেদেভের মেয়াদ শেষ হলে পুতিন আবার প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন। সেবার মেদভেদেভ হন প্রধানমন্ত্রী। এরপর পুতিনের সংবিধান সংশোধনীর বিপক্ষে গিয়ে মেদভেদেভ সহ পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ২০১২ সালের সেই মেয়াদেই আছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এবং জোরালো সম্ভাবনা আছে, সামনে আবারো প্রেসিডেন্ট হবেন এই নেতা।
২০৩৬ সাল পর্যন্ত যে ক্ষমতায় থাকতে চান এ কথা গণমাধ্যমে বেশ খোলাখুলিভাবে বলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তবে সারাবিশ্বের মানুষের প্রশ্ন একটাই, কেন এই সিদ্ধান্ত? উত্তরে পুতিন ছিলেন বেশ কৌশলী। তার ভাষ্যমতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের রাশিয়ান সংবিধান ছিল একটি ‘ধীরগতির মাইন’। এবং দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল সাংবিধানিক বিভিন্ন নীতি। কাজেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দুঃখজনক পরিণতি রোধ করতেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এক কথায়, তিনি চান রাশিয়ান সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে। পুতিনের মতে, যে সংবিধান বিশেষ একটি শ্রেণিকে নিজেদের ও কমিউনিস্টদের ভাগ্যকে গোটা জাতির ভাগ্যের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার অনুমতি দেয় তাকে ধীরগতির মাইন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এই মাইনের বিস্ফোরণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য সংবিধান সংশোধন ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না বলেও ব্যাখ্যা দেন তিনি। যদিও এসবের সাথে প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ক্ষমতার সম্পর্ক কতটুক বা কেনই বা তিনি প্রেসিডেন্সি মেয়াদ বাড়িয়েছেন তা নিয়ে সরাসরি কোন জবাব দেননি।
প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল
প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছেন, রাশিয়ার মানুষ জাতিগতভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের মানুষ নিজেদের মন থেকে এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিন ওই গণভোটকে পুতিনের বিশাল বিজয় হিসেবে উল্লেখ করছেন।
অন্যদিকে, দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা নাভালনি বলেন, তারা নির্বাচনের ফলাফল কখনোই মেনে নেবেন না, যদিও করোনাভাইরাস মহামারির সময় কারণে আপাতত কোনও প্রতিবাদ করা হচ্ছে না, তবে তারা লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় এনে বিক্ষোভের মাধ্যমে পুতিনিকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও প্রস্তুত।
রাশিয়ার নিরেপেক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা গলোস অবশ্য এই নির্বাচনের সমালোচনা করেছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের ব্যাপক লঙ্ঘন ঘটেছে। তাদের বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে ছিল বিরোধীদলকে মিডিয়া ব্যবহার করে প্রচারণায় নামতে না দেয়া, অনৈতিকভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং এর নিয়ন্ত্রণ করা এবং সরকারীভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক নিয়ন্ত্রণ করার মত বড় কিছু অভিযোগ। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়ান নির্বাচন কমিশন।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ