ইতিহাস বিশ্ব

ভ্যাটিকান সিটির আদি থেকে আজ1 min read

জানুয়ারি ২, ২০২০ 5 min read

author:

ভ্যাটিকান সিটির আদি থেকে আজ1 min read

Reading Time: 5 minutes

কখনো কি আপনার মনে হয়েছে ছোট এক শহর ভ্যাটিকান কিভাবে স্বাধীন স্বত্তা টিকিয়ে রেখেছ? কেন এই ছোট শহরটা হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বড় এক ধর্মের প্রধান কেন্দ্র? পোপ থেকে শুরু করে চার্চ এবং ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই শহরের গল্পটা নিছক একশ বা দুইশ বছর না গল্পটা হাজার বছরেরও বেশি পুরাতন আর স্বাধীন সার্বোভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভ্যাটিকানের প্রতিষ্ঠা সেই তুলনায় রীতিমতো আধুনিক কালে ১৯২৯ সালে ভ্যাটিকান স্বাধীন রাষ্ট্র অর্থাৎ বর্তমান রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় 

টাইবার নদীর পশ্চিম তীরের এই অংশটি পূর্বে অ্যাগার ভ্যাটিকানোস নামে পরিচিত ছিল রোমান সাম্রাজ্যের একেবারেই প্রথম দিকে বিলাসবহুল ভিলার সমন্বয়ে এই অঞ্চলটি প্রশাসনিকভাবে নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিত করে নেয় খ্রিস্টীয় ৬৪ সালে রোমে ব্যাপক অগ্নিকান্ড হবার পর তৎকালীন সম্রাট নিরো সেইন্ট পিটার সহ সকল খ্রিস্টানকে বলির পাঠা বানিয়ে ভ্যাটিকান পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্যুদন্ডের আয়োজন করেন আর আদেশ দেন সেখানেই তাদের কবর দেয়ার জন্য 

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে যায় ৩১৩ সালে মিলান চুক্তির আলোকে সম্রাট প্রথম কনস্ট্যানটিন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেবার পর ৩২৪ সালে সেইন্ট পিটারের কবরের উপর একটি ব্যাসিলিকা নির্মাণের কাছে হাত দেন ধীরে ধীরে সেইন্ট পিটারের সেই ব্যাসিলিকা হয়ে পড়ে খ্রিস্টানদের অন্যতম বড় তীর্থস্থান এরপর সেখানে বাণিজ্যিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করলে একে ইতালির বোর্গো শহরের অংশ করে নেয়া হয়     

সেইন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা

৮৪৬ সালে সেরাসান জলদস্যুদের আক্রমণে সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবার পর পোপ চতুর্থ লিও এই পবিত্র ব্যাসিলিকা এবং এর চারপাশের অঞ্চল রক্ষার জন্য একটি দেয়াল তৈরীর নির্দেশ দেন ৮৫২ সালে ৩৯ ফুট লম্বা এই দেয়ালের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এই দেয়ালটিই বর্তমান সময় পর্যন্ত বোর্গো শহর এবং বর্তমান ভ্যাটিকান শহরের বিভাজন হিসেবে কাজ করে চলেছে মজার ব্যাপার হলো, দেয়ালটির কাজ ১৬৪০ সালে পোপ অষ্টম আর্বানের সময় পর্যন্ত চলছিলো 

খ্রিস্টীয় ৬শ সালের গোড়ার দিকে সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা সংলগ্ন অঞ্চলে একটি আবাসিক এলাকা নির্মাণের ঘোষণা দেন পোপ সিমাচোস এর আগে পোপদের বাসস্থান ছিলো কাছাকাছি লিটেরান প্যালেসে পোপ সিমাচোসের সেই আবাসস্থল শত বছর পর পোপ তৃতীয় ইউজিন এবং তৃতীয় ইনোসেন্ট আরো বর্ধিত করেন ১২৭৭ সালে এই বাসস্থানটিকে অর্ধমাইল দূরের সেইন্ট অ্যাঞ্জেল ক্যাসলের সাথে যুক্ত করা হয় 

যাইহোক ১৩০৯ সালে ফ্রান্সের অ্যাভিগননে পোপের কার্যালয় সরিয়ে নেয়া হলে এর সবই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে 

১৩৭৭ সালে ক্যাথলিক চার্চ আবার ভ্যাটিকানে ফিরে আসে ১৪৫০ সালে পোপ পঞ্চম নিকোলাস অ্যাপোস্টিলিক প্যালেস নির্মাণের কাজ শুরু করেন এটিই পরবর্তী পোপদের বাসস্থান হয়ে পড়ে এখানে তিনি বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন যা কালের আবর্তে বিখ্যাত ভ্যাটিকান লাইব্রেরীর ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ১৪৭০ সালে চতুর্থ সিক্সটাস বিখ্যাত সিসটিন চ্যাপেলের কাজ শুরু করেন বত্তিচেলি এবং পেরুজিনোর বিভিন্ন ফ্রেসকো সেইসময়ই সিসটিন চ্যাপেলের শোভাবর্ধনে ব্যবহার হতে শুরু করে 

ভ্যাটিকান শহরের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে শুরু করে ১৫০৩ সালে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৫০৮ সালে বিখ্যাত চিত্রকর মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে সিসটিন চ্যাপেলের ছাদের অলঙ্করণের দায়িত্ব দেন দ্বিতীয় জুলিয়াস আর স্থাপত্যবিদ ডোনাতো ব্রেমেন্তেকে দায়িত্ব দেয়া হয় বেলভেদ্রে চত্বরের জন্য এছাড়াও তিনি ১২০০ বছরের পুরাতন সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা ভেঙে নতুন করে তৈরীর কাজ শুরু করেন 

কিন্তু ১৫১৩ সালে পোপ এবং তার পরের বছরেই ব্রেমেন্তের মৃত্যু এই কাজ বন্ধ করে দেয় অবশেষে সেই গেরো খুলেন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো নিজেই ১৫৪৭ সালে তিনি ব্রেমেন্তের করা নকশায় কাজ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন আর সেইন্ট পিটারের বিখ্যাত গম্বুজের কাজ শেষ হয় ১৫৯০ সালে সেটির দায়িত্বে ছিলেন গিয়াসোমো দেল্লা পোর্তা এর ভূমির কাজ শেষ হয় ১৬২৬ সালে কাজের শেষে এর উচ্চতা হয় ৪৫২ ফুট আর আয়তন ছিলো দশমিক একর ১৯৮৯ সালে আইভরি কোস্টে লেডি অফ পিসের ব্যাসিলিকা নির্মাণের আগে সেইন্ট পিটারের এই চার্চই ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় চার্চ

এখানে কিছু জিনিস উল্লেখ করা দরকার ভ্যাটিকান জাদুঘর মূলত শুরু করেন পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস তার সংগ্রহীত ভাস্কর্য থেকেই ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের জন্ম এর সবচেয়ে পুরাতন গ্যালারি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৭৭৩ সালে সেসময়কার পোপ চতুর্দশ ক্লেমেন্ত এই সিদ্ধান্ত নেন তার পরে পোপ চতুর্থ পায়াস একে আরো বর্ধিত করেন চতুর্থ পায়াস পরবর্তী সব পোপই মিউজিয়াম বর্ধনে অংশ নেন ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে যুক্ত হতে থাকে গ্রেগরিয়ান ইজিপশিয়ান জাদুঘর, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর সহ নানান ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরের সংগ্রহ সমূহ 

১৮৭০ সালের আগে এবং পরে ভ্যাটিকান ইতালিরই অংশ ছিলো কিন্তু পার্থক্য বলতে গেলে শাসনকর্তার হিসেবে মূল ইতালি এবং ভ্যাটিকানের শাসক ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা পোপরাই ছিলেন ভ্যাটিকানের সর্বেসর্বা কিন্তু ১৮৭০ সালে ইতালি ভ্যাটিকানের শাসন নিয়ে নেয় 

এই মুখোমুখি অবস্থানের অবস্থানের অবসান ঘটে ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ইতালির একানায়ক বেনিতো মুসোলিনি রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েলের পক্ষে এক চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাটিকানকে স্বাধীন দেশের মর্যাদা প্রদান করেন এই সময় ইতালি সরকার সেই যুগে প্রায় ৯২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে ভ্যাটিকান শহরকে এই ক্ষতিপূরণ মূলত দেয়া হয় বিগত ৬০ বছর ধরে পোপের মর্যাদা এবং কার্যাবলী ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে 

এরপর থেকেই বিশ্বের দশমিক বিলিয়ন ক্যাথলিক খ্রিস্টানের প্রধান তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হবার পাশাপাশি পোপের কার্যালয় এবং বাসস্থান হিসেবে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ভ্যাটিকান ভ্যাটিকান হয়ে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র 

সুইস গার্ড

মাইলের সীমানা ছাড়াও মোট ১০৯ একরের উপর দাঁড়িয়ে আছে ভ্যাটিকান সিটি রাষ্ট্রটি এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরো ১৬০ একরের মালিকানা রয়েছে এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রায় শত বছরের পুরাতন সব স্থাপনার পাশাপাশি ভ্যাটিকানের রয়েছে নিজস্ব সকল ব্যবস্থা ভ্যাটিকান নিজেই নিজের শহরের ব্যাংকিং, টেলিফোন সিস্টেম, পোস্ট অফিস, ফার্মাসি, পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের ব্যবস্থা করে রেখেছে রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১০০০ যার মাঝে সুইস গার্ড অন্তর্ভুক্ত ১৫০৬ সাল থেকে সুইস গার্ডই পোপের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব পালন করছে পোপ ছাড়াও সেইন্ট পিটার স্কয়ার এবং সেসব অঞ্চলের দায়িত্বে আছে সুইস গার্ড 

ভ্যাটিকান সিটির বর্তমান 

ভ্যাটিকানে দিনের শুরু হয় সকাল টা ৩০ মিনিটে প্রতিদিন ঠিক সময়েই ভ্যাটিকানের চাবির রক্ষক অ্যালেসিও সেনসোনি সালা রোটন্ডার দরজা খুলে দেন এবং ঘন্টাখানেকের মাঝেই তা পর্যটকে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে এর ঘন্টাখানেক আগে থেকেই চলে এর ধোয়ামোছা এবং পরিষ্কারের কাজ চার শিফটে বেশ কিছু কর্মীর সাথে কাজ করেন সেনসোনি সেই ভোরেই তার কাজ নেহায়েত কম নয় তাকে প্রায় ৩০০ দরজা নিখুঁতভাবে খুলতে এবং বন্ধ করতে হয় বছরের প্রতিটা দিন ২০১৩ সালে নির্বাচিত হবার পর পোপ ফ্রান্সিস সর্বপ্রথম দলে দলে ভ্যাটিকানের কর্মীদের নিজের অতিথিশালা কাসা সান্তা মার্তায় আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন সব মিলিয়ে ভ্যাটিকানে ৪৮০০ কর্মীর সবাইকে নিজের অতিথিশালায় থাকার সুযোগ দেন বর্তমান পোপ      

পোপ ফ্রান্সিস

পোপ ফ্রান্সিসই প্রথম পোপ হিসেবে নিজেকে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে এসেছেন বিষ্ময়কর হলেও সত্য, তিনিই প্রথম পোপ যিনি কিনাসমকামীশব্দটি পোপ থাকাকালীন সময় উচ্চারণ করেছেন তিনি বেশ কিছু পরিবর্তন তার কথার মাধ্যমে এরইমাঝে খ্রিস্টান সমাজে নিয়ে এসেছেন নারী পুরুষের ব্যবধান গড়াকে তিনিকলঙ্কবলে চিহ্নিত করেছেন তিনি ক্যাথলিকদের জন্মনিয়ন্ত্রণে উপদেশ দিয়েছেন  তিনিই প্রথম পোপ যিনি যেসব প্রিস্ট একক মায়েদের সন্তানকে ব্যাপ্টাইজ করাতে অস্বীকৃতি জানান তাদেরপশুবলে আখ্যা দিয়েছেন 

বিভিন্ন পরিষ্কার এবং ধোঁয়া মোছার কাজে নিযুক্তরা বলতে গেলে বংশ পরম্পরায় কাজ করে চলেছেন চাবি রক্ষক অ্যালেসিও সেনসোনি ১৪ বছর বয়সে ভ্যাটিকানে আসেন তার বর্তমান বয়স ৬২ বছর সেনসোনি মুলত গাড়ি ধোয়ার কাজ করতেন কৈশোরে যা থেকে দিনে দিনে নিজেকে নিয়ে এসেছেন আজকের অবস্থানে ৮০ জনের একটি দল ক্রমাগত ভ্যাটিকান মিউজিয়াম এবং বিভিন্ন স্থাপত্যের পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত থাকেন

পোপ ফ্রান্সিস বিগত আর যেকোন পোপ থেকে আলাদা হবার কারণে ভ্যাটিকানের হাজার বছরের ঐতিহ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এরইমাঝে এসে গিয়েছে ফাদার ফ্রেডরিকো লোম্বারডির মতে পোপ ফ্রান্সিস একজন বৈপ্লবিক মানুষ তিনি এসেছেন চার্চের হাজার বছরের পুরাতন ধারা ভাঙতে 

প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় ভ্যাটিকানের দিনের কাজ শেষ হয় দিনের কাজ শেষে সরকারী গাড়িগুলো পোপের বাসস্থানের উল্টোদিকে একটি ভবনের নিচে জড়ো হয় এমনকি পোপের জন্য আনা বাজারও এখানেই খালাস করা হয় পাশেই ফার্মেসি থেকে দর্শনার্থীদের ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম চলে 

প্রায় প্রতিদিনই একবার করে ভক্তদের কাছে যাবার চেষ্টা করেন পোপ ফ্রান্সিস সেইন্ট পিটার স্কয়ারে প্রায় বিকেলেই স্লোগানের মত করে শোনা যায়ফ্রানসিসকো, ফ্রানসিসকো ওদিকে কাজ শুরু হয় পরদিনের দর্শনার্থীদের জন্য সেনসোনির কাজ থাকে সবকটা দরজা ঘুরে ঘুরে বন্ধ করার 

সেই দরজা! যে দরজা আরো হাজার বছর আগে খুলে দিয়েছিলেন রোম সম্রাট নীরো নিরো কি জানতেন তার আদেশে যেখানে সেইন্ট পিটার সহ সব খ্রিস্টানকে কবর দিতে চেয়েছেন সেখানেই একদিন খ্রিস্টান ধর্মের কোটি মানুষ এসে প্রার্থনা করবে?

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *