ভিয়েতনাম যুদ্ধ- স্বাধীনতার লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস1 min read
Reading Time: 6 minutesবিংশ শতাব্দীর ঘৃণ্যতম ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল পার হলো এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪৪ বছর। কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এ পৃথিবীতে যতগুলো বর্বরোচিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সবগুলোর পিছনে তাকালে দেখা যায়, কিছু মানুষের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য বলি হতে হয় লাখো নিরীহ প্রাণের।
পৃথিবীর বুকে ছোট্ট একটি দেশ— ভিয়েতনাম। এ দেশটিকে কয়েকটি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বারবার নিষ্পেষিত হতে হয়েছে। যুগের পর যুগ এই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে গিনিপিগের মত ব্যবহার করা হয়েছে। ওরাও ওদের মত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে; কোথাও হয়তো সফলও হয়েছে। একের পর এক পরাশক্তিকে পরাজিত করে সর্বশেষ ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দুই যুগ ধরে বয়ে গেছে রক্তের স্রোতধারা। একাধারে ২১টি বছর ধরে পৃথিবী সাক্ষী হয়ে ছিল এই অবিরত প্রাণক্ষয়ের।
এই লেখাটি মূলত ‘দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ নিয়ে। হঠাৎ করেই এই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়নি। এ যুদ্ধের পটভূমি বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে আরো কয়েক যুগ পিছনে।
ভিয়েতনামের ভৌগোলিক অবস্থা ও রাজনৈতিক ইতিহাস
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষিপ্রধান ক্ষুদ্র একটি দেশ ভিয়েতনাম। এর আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৯৫ মিলিয়ন। দক্ষিণ চীন সাগরের তীরঘেঁষা উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এ দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত। উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম।
ভিয়েতনাম বহুকাল ধরেই বিভিন্ন দখলদারদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আসছে। ৫৪৪ সালে ভিয়েতনামের রণকুশল যোদ্ধা লাই বান প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ভান জুয়ান প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ৬০৩ সালে ভান জুয়ান পাশের পরাশক্তি চীনের হাতে চলে যায়।
এরপর আসে মঙ্গোলীয়রা। ১২৫৭ থেকে ১২৮৮ সাল পর্যন্ত মঙ্গোলীয়রা ভিয়েতনাম শাসন করে। ১২৮৮ সালে মঙ্গোলীয়দের থেকে মুক্ত হয় ভিয়েতনাম। তারপর চলছিল ভালোই। ভিয়েতনামিরা হয়ত ঔপনিবেশিক শাসনের কথা ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৪০০ বছর পর আবার ভিয়েতনাম চীন কর্তৃক অধীকৃত হয়।
পুনরায় কৃষক বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভিয়েতনাম শত্রু মুক্ত হয়। কিন্তু বিধি বাম! এবার ওদের উপর নজর পড়ে ফরাসীদের। ফরাসী সম্রাট ষোড়শ লুই এর আমলে ভিয়েতনাম চলে যায় ফরাসীদের কব্জায়। ফরাসীরা ভিয়েতনামকে দখল করেই ক্ষান্ত হয় নি। তারা লাওস ও কম্বোডিয়াকেও দখলে নেয় এবং এই তিন রাষ্ট্রকে নিয়ে তৈরি করে ইন্দোচীন।
ভিয়েতনামিরা এবার আরও চিন্তাভাবনা করে সামনে এগুতে থাকলো। এবার তারা আরও সোচ্চার। ফরাসীদের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা চালানোর জন্য তৈরি হয় ‘ভিয়েতনামিজ কমিউনিস্ট পার্টি’। কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আর ফরাসীরা পুঁজিবাদে। তাই স্বভাবতই এদের মধ্যে চরম বৈরিতা তৈরি হতে থাকে। ‘ভিয়েতনামিজ কমিউনিস্ট পার্টি’র সর্বাধিনায়ক ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা হো চি মিন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের ছায়াতলে এই সংঘটন আস্তে আস্তে আরও শক্তিশালী হতে থাকে। পরিসর বড় হওয়ায় এ পার্টির নাম হয় ‘ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি’।
ইতিমধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর তখন ইন্দোচীন চলে যায় জাপানীদের নিয়ন্ত্রণে। ‘ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি’ ছোট বড় বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলা চালায়। কিন্তু জাপানীরা তাদের ক্ষমতার বলয়ে ইন্দোচীনকে আটকে রাখতে সমর্থ হয়। জাপান ও ফ্রান্সের শোষণের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৪-৪৫ সালে ভিয়েতনামে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যাতে কয়েক লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। এই কষ্টে ভিয়েতনামীরা দিন দিন আরও ক্ষুব্ধ হতে থাকে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণের পর জাপান ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়। এ সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভিয়েতনাম জাপানের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়।
১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর হো চি মিন সরকার গঠন করে। এ সরকার গোটা ভিয়েতনামে মাত্র ২০ দিন স্থায়ী ছিল। ২৩ সেপ্টেম্বরে ফরাসীদের মদদে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সায়গন শহরে হো চি মিন সরকারকে উৎখাত করে রাজা বাও দাইকে নিয়ে নতুন সরকার গঠন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য কমিউনিস্ট বিরোধী দেশগুলো বাও দাইয়ের অধীনে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করে। অন্যদিকে, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েত মিন তথা উত্তর ভিয়েতনামের হো চি মিন সরকারকে সহায়তা করে। তাদের সহায়তায় ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি আরও শক্তিশালী হতে থাকে।
প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ
উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠতে থাকে। ১৯৫৪ সালের মে মাসে জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপের নেতৃত্বে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপর আঘাত হানে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের দখলদার ফ্রান্স যুদ্ধে পরাজিত হয়। প্রচণ্ড এ লড়াইয়ের পর ফরাসীরা তেজী ভিয়েতনামীদের কাছে হার মানে।
জেনেভা চুক্তি, ভিয়েতনামের ভাঙন ও দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধের আভাস
ভিয়েতনামের বিজয় যেন অধরাই থেকে যায়। ১৯৫৪ সালের ২১ জুলাই একরকম বাধ্য হয়েই ভিয়েতনাম জেনেভা শহরে এক চুক্তিতে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী ফরাসীরা বিদায় নেয় ঠিকই; কিন্তু ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণে দু’ভাগ হয়ে যায়। চুক্তি অনুযায়ী এ ভাঙন ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। বলা হয়েছিল, ১৯৫৬ সালে গোটা ভিয়েতনামে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং বিজয়ী সরকার পুরো ভিয়েতনামকে নেতৃত্ব দিবে। এ চুক্তি হো চি মিনের ভিয়েত মিন সরকার খুব সহজে মেনে নেয়। কারণ ঐ সময়ে সারা ভিয়েতনাম জুড়ে ভিয়েত মিনের যে জয়োধ্বনি ছিল, তাতে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। কিন্তু বাঁধ সাদলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মই হলো অন্যের সমস্যায় নাক গলানো আর সুযোগ বুঝে নিজ স্বার্থোদ্ধার।
যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের ধারণা ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমগ্র এশিয়াতে সাম্যবাদের জোয়ার বইবে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের মত কমিউনিস্ট বিদ্বেষী রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই আইজেনহাওয়ার দক্ষিণ ভিয়েতনামে নতুন সরকার গঠন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি জেনেভা চুক্তি অমান্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৫ সালে চরম কমিউনিজম বিরোধী নেতা দিন দিয়েম নোকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের গদিতে বসিয়ে দেয়। সেই সরকারকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। অন্যদিকে মার্কিনদের শত্রু রাশিয়া ও চীন হো চি মিন সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিতে থাকে। আর বিশ্ব অপেক্ষা করতে থাকে এক রক্তক্ষয়ী কালো অধ্যায়ের।
ভিয়েতনাম তথা গোটা বিশ্ব কাঁপানো দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ
দক্ষিণ ভিয়েতনামে শুরু হলো দিন দিয়েন নোর অমানুষিক নির্যাতন। যারাই তার বিরোধিতা করে তাদেরকেই কমিউনিস্ট বলে ধরে নিয়ে অত্যাচার করত। এভাবে দিয়েম নোর অত্যাচারে প্রায় ১ লক্ষ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারালো। তখন বাধ্য হয়েই ১৯৫৭ সালে ভিয়েতনামের জনগণ দিয়েমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে ভিয়েতনামের সকল জনগণ মার্কিন মদদপুষ্ট দিয়েম নোর হঠকারিতা বুঝতে পারল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে দুই ভিয়েতনাম একসাথে মিলিত হয়ে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট (এনএলএফ) গঠন করে। এটা দেখে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কায় পড়ে যায়। ভাবে, এখন আর ভিয়েতনামিদের কাজে লাগানো যাবে না। তাদেরকেই মাঠে নামতে হবে।
১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতা সরবরাহ করবে। যেকোন মূল্যেই হোক কমিউনিজম ধ্বংস করতে হবে। ভিয়েতনামে ভিড়তে লাগলো একের পর এক সুসজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। নেমে আসল ভিয়েতনামের জন্য আশনি সংকেত।
সেই সময়টায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ু যুদ্ধ তুঙ্গে। তাই রাশিয়া এনএলএফকে সব ধরণের সহায়তা দিতে থাকে। সেই সাথে চীনও। ১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিন দিয়েম নো সরকারের পতন ঘটে। ১৯৬৪ সালে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপর উত্তর ভিয়েতনাম বোমাবর্ষণ করে। সাথে সাথে ওয়াশিংটনও উত্তর ভিয়েতনামকে যে কোন উপায়ে ধ্বংসের নির্দেশ দেয়। হিংস্র জিঘাংসা আরও ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। মারা পড়তে থাকে হাজারো সৈন্য, সাধারণ জনগণ।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য ভিয়েতনামে প্রেরণ করে। যুদ্ধ প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র আরও সৈন্য পাঠিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাহিনী গঠন করে। কিন্তু তারপরও ভিয়েতনামের গ্রামীন পাহাড়ি অঞ্চলে অতটা কাঁবু করতে পারে নি। অন্যদিকে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে দিনে দুপুরে হামলা চালাত।
যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিশ্ব অসন্তোষ
১৯৬৮ সালে নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুদ্ধের নৃশংসতা আরও বেড়ে গেল। মার্কিনরা চিন্তা করল সবুজ ভিয়েতনামকে যদি মরুভূমি বানিয়ে ফেলা যায় তাহলে শত্রুর মোকাবেলা করাটা সহজ হবে। তাই তারা নিক্ষেপ করতে লাগল একের পর এক বিভিন্ন হারবিসাইড বোমা, রাসায়নিক বিস্ফোরক যা দ্বারা সমস্ত গাছকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় আট কোটি লিটারেরও বেশি বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বর্ষণ করে যার ফলে ভিয়েতনামের পরিবেশ চরম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ বোমা সাড়া পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হয়েছিলো তার চারগুণের বেশি বোমা ছোট ভিয়েতনামের বুকে বর্ষিত হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্র ডাই অক্সিন এজেন্ট নামের জৈব রাসায়নিক মরণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলো যার ফলে আজও ভিয়েতনামে মানসিক ভারসাম্যহীন, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে নাপাম বোমা ব্যবহার করে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। ধারনা করা হয়, এই সময় প্রায় পাঁচ শত লোক নিহত হয়।
ভিয়েতনামও থেমে থাকেনি। তারাও একের পর এক মার্কিন সেনাদের ঘায়েল করছিলো। সংবাদকর্মীদের সাহায্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল এ যুদ্ধের খবর আর বাড়ছিলো বিশ্ব অসন্তোষ। খোদ আমেরিকাতেই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তুমুল জনমত গড়ে উঠতে থাকলো। তারা তাদের সৈন্যদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাইলো। বিশ্ব অসন্তোষের চাপে যুক্তরাষ্ট্র উভয় সঙ্কটে পড়ে যায়। উপায় না দেখে তারা আলোচনায় বসতে চাইলো।
প্যারিস শান্তি চুক্তি ও যুদ্ধাবসান
১৯৭৩ সালের ২৩ জানুয়ারী প্যারিসে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে, যুদ্ধের কার্যবিরতি ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে নির্বাচন দেওয়া। চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও কোথাও কোথাও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও বোমা বর্ষণ চালাতে থাকে। ফলে উভয় পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করে। তারপর হেনরি কিসিঞ্জার এবং ভিয়েতনামের পক্ষে লি ডাক থো আবার প্যারিস চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাক্ষর করেন। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়ে সরকারিভাবে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করে।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
এ যুদ্ধে প্রায় ৩২ লক্ষ ভিয়েতনামি ও প্রায় ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারায়। এতে প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি মার্কিন সেনা আহত হয়েছিল। প্রায় পাঁচ হাজার হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছিল। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভিয়েতনামের ৪৫ শতাংশ কৃষি জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখনও ভিয়েতনামের মাটিতে যে পরিমাণ বোমা আছে তা নষ্ট হতে আরও ৫০০ বছর লেগে যাবে।
৪৪ বছর পর বর্তমান ভিয়েতনাম
এত বছর পরেও ভিয়েতনামের ঘরে ঘরে জন্মাতে দেখা যায় বিকলাঙ্গ শিশু। কেউ কেউ আবার মানসিক বিকারগ্রস্ত। এখনও কিছু কিছু জমি চাষের অনুপযোগী। কিছু জীনগত রোগ এখনও ভিয়েতনামিরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াচ্ছে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪৪ বছর পরে আজও ভিয়েতনামিরা ভুলতে পারে নি যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতাকে। কালের গহ্বরে হয়ত কোনদিন ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা তলিয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস ঠিক মনে রাখবে এর কথা। ভিয়েতনামের শান্তিকামী মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠবে যুদ্ধের বীভৎসতার কথা মনে করে।