featured বিশ্ব

ব্রেক্সিটঃ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়1 min read

ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০ 4 min read

author:

ব্রেক্সিটঃ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়1 min read

Reading Time: 4 minutes

গত সাড়ে তিন বছরে ইউরোপের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ব্রেক্সিট। এর পক্ষে-বিপক্ষে, ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনা কিংবা তর্ক ছিল অন্তহীন। অবশেষে তিন জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় গত ৩১ জানুয়ারি ব্রিটেনের স্থানীয় সময় রাত ১১ টায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। তবে আগামী এগারো মাস অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত “ট্রানজিশনাল পিরিয়ড” হিসেবে রাখা হয়েছে। এই এগারো মাসে যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রুপরেখা ঠিক করে নিতে হবে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের মুহূর্তটিকে আখ্যায়িত করেছেন “সত্যিকার জাতীয় পুনর্জাগরণ ও পরিবর্তনের মুহুর্ত” হিসেবে। বরিসের জন্য এটি আনন্দের মুহূর্ত হলেও  ব্রেক্সিট বিরোধীদের জন্য এটি ছিল নিঃসন্দেহে বিষাদের মুহূর্ত। যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড যেমন বেক্সিট মেনে নিতে পারে নি। স্কটল্যান্ডের চিফ মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জেন বলেছেন, স্কটল্যান্ড একদিন স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপের কেন্দ্রে ফিরে আসবে।

গত কয়েক বছরে ব্রেক্সিট নিয়ে এত বেশি জল ঘোলা হয়েছে যে ব্যাপারটি অনেকের কাছেই বেশ ধোঁয়াশার মতো এখনো। পাঠকদের এই ধোঁয়াশা থেকে বের করতে আমরা ব্রেক্সিটের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে আলোকপাত করবো।

ব্রেক্সিট

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে ব্রেক্সিট বলা হয়। ব্রেক্সিট শব্দটির ব্যবচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় “ব্রিটেন এক্সিট”।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন

ইউরোপের ২৮ টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে শান্তি এবং পরস্পর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করে। এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সদস্য দেশগুলোর মাঝে কোন সীমান্ত দেয়াল নেই। এসব দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে কোন রকম শুল্ক ছাড়া অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। একইভাবে এসব দেশের নাগরিকেরা কোন রকম ভিসা ছাড়াই সদস্য দেশগুলোতে গিয়ে থাকতে ও কাজ করতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের(ইইউ) অন্তর্ভুক্ত ২৮টি দেশের বাণিজ্য, কৃষি, অভিবাসন ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন যাবতীয় বিষয় ইইউর একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত। এই জোটের কোন দেশ ইইউর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অন্য কোন দেশের সাথে বানিজ্য চুক্তি করতে পারে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজস্ব পার্লামেন্ট ব্যবস্থাসহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইইউর নিজস্ব মুদ্রা ইউরো। ইইউর সদস্য ১৯টি দেশ ইউরো নিজেদের দেশে ব্যবহার করে।

১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। সেসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাম ছিল ইউরোপিয়ান ইকনোমিক কম্যুনিটি(ইইসি)।

কেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়েছে যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগের মূলে রয়েছে অভিবাসন নীতি, অর্থনীতি ও তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। বৃটিশ নাগরিকরা ইইউর অনেক নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারে বিরক্ত ছিলেন। লাগামহীনভাবে অভিবাসীদের যুক্তরাজ্যে চলে আসা বেশির ভাগ বৃটিশ নাগরিককে ব্রেক্সিট নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার প্রথম মেয়াদে ইইউর বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারলেও কমাতে পারেননি ইইউভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের অভিবাসন। ক্যামেরন তার দ্বিতীয় মেয়াদে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে আসতে নিরুৎসাহিত করতে অভিবাসীদের চার বছরের জন্য সুবিধাবন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এটি ছিল ইইউর “Free Movement of People” নীতির পরিপন্থী।

নিজ দলের এমপি এবং ব্রেক্সিটপন্থী নাইজেল ফারাজের ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির চাপের মুখে ডেভিড ক্যামেরন ইইউর নেতাদের সাথে আলোচনা করে ২০১৬ সালের জুন মাসের ২৩ তারিখ বেক্সিট নিয়ে গণভোটের আয়োজন করেন।

ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোট ও যুক্তরাজ্যের অন্তর্বিরোধ

ইংলান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত। ব্রেক্সিট নিয়ে যুক্তরাজ্যের গণভোটে তিন কোটির বেশি মানুষ ভোট দেন। ব্রেক্সিটের পক্ষে পড়ে ৫১.৯ শতাংশ ভোট, বিপক্ষে পড়ে ৪৮.১ শতাংশ ভোট।

যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সব রাজ্য কিন্তু ব্রেক্সিটের বিপক্ষে তাদের রায় দেয় নি। লক্ষ্য করার বিষয় হলো ব্রেক্সিটের পক্ষে ইংল্যান্ড, ওয়েলসে যথাক্রমে ৫৩.৪ এবং ৫২.৫ শতাংশ ভোট পড়লেও স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ডে বেক্সিটের বিপক্ষে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৬২ এবং ৫৫.৮ শতাংশ।

মোটের ওপর ব্রেক্সিটের পক্ষে বেশি ভোট পড়লেও এটি স্পষ্ট যে ব্রেক্সিট বিরোধীর সংখ্যাও কম ছিল না।

আরও পড়ুন- যুক্তরাজ্য, গ্রেট ব্রিটেন এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে পার্থক্য কি?

কেন সাড়ে তিন বছর ঝুলে ছিল ব্রেক্সিট?

ইউরোপ ও বৃটেনকে আলাদা করেছে ইংলিশ চ্যানেল এবং নর্থ সি। যুক্তরাজ্যের চারটি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র উত্তর আয়ারল্যান্ডরই ইইউভুক্ত কোন দেশের সাথে স্থল সীমান্ত আছে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউভুক্ত দেশ আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সাথে তাদের স্থল সীমান্ত ভাগাভাগি করেছে।

ব্রেক্সিটের ফলে ইইউ জোটের বাইরের দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের সাথে ইইউভুক্ত দেশের সীমান্ত এলাকা স্পষ্ট হওয়া বাঞ্চনীয় ছিল। ব্রেক্সিটের ফলে উত্তর আয়ারল্যান্ড ও আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত কীভাবে আলাদা করা হবে মূলত এটি নিয়েই গত সাড়ে তিন বছরে সমাধান হচ্ছিল না। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে “আইরিশ ব্যাক্সস্টপ” নামের একটি ধারণা সামনে এনেছিলেন, যেটিতে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ইইউর কিছু নীতিমালা বহাল থাকতো। তাই সে ধারণা বেশিদূর এগোয় নি।

২০১৬ সালে গণভোট হওয়ার পরে বৃটিশ পার্লামেন্ট প্রথমে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ইইউর সাথে সম্পর্ক ছেদ করার তারিখ নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু থেরেসা মের সাথে ইইউর চুক্তি বৃটিশ পার্লামেন্টে কয়েকবার প্রত্যাখাত হলে ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানো হয়। এর জেরে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বিদায় নেন। এরপরেই দৃশ্যপটে আসেন ব্রেক্সিটপন্থী নেতা বরিস জনসন। বরিস ২০১৯ এর ডিসেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হলে ব্রেক্সিট কার্যকরের সব বাধা দূর হয়।

ব্রেক্সিটের ভবিষ্যত

ব্রেক্সিট কার্যকর করা হলেও আপাতত যুক্তরাজ্যের সাথে ইইউর সম্পরক আগের মতোই থাকছে। “ট্রানজিশনাল পিরিয়ড” শেষ হলে যুক্তরাজ্য ও ইইউর মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ স্পষ্ট হবে। আগামী ডিসেম্ব্রর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ইইউর আইন মেনে চলবে, কিন্তু তারা ইইউর কোন কিছুতে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না। এ সময়ের মধ্যেই যুক্তরাজ্যকে ইইউর সাথে বাণিজ্য চুক্তি সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করতে হবে।

জাতীয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, পরস্পর সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদান, আইরিশ ব্যাকস্টপ এমন আরও অনেক বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে দুপক্ষের। যদিও মাত্র এগারো মাসে চুক্তির প্রক্রিয়া কতটুকু সম্পন্ন হবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন।

যদি কোন কারণে এই সময়ের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন না হয় তবে যুক্তরাজ্য ও ইইউর মধ্যে  বাণিজ্য হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের বিধি অনিযায়ী। যার ফলে দুপক্ষই বিপদে পড়বে। যেসব পণ্য এত দিন যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবাধে ব্যবসা করতো, সেগুলো পড়বে শুল্কের মুখে। যার ফলে পণ্যের দাম বাড়বে। এছাড়া দুপক্ষের নাগরিক জীবনের প্রভাব তো আছেই।

সব মিলিয়ে এটি স্পষ্ট যে সামনের এগারো মাসে দুপক্ষ সমঝোতায় না পৌছাতে পারলে আবার ব্রেক্সিট নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে। যদিও বরিস জনস্ন উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে ট্রানজিশনার পিরিয়ড বৃদ্ধি করতে পারবেন। তবে তিনি সেটি করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

লেখক- হাসান উজ জামান 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *