ব্রিটেন রাজপরিবারের আর্থিক হালচাল1 min read
Reading Time: 4 minutesএকটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল, ‘ব্রিটিশ সূর্য কখনো অস্ত যায় না।’ বিগত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিশ্বের নানা দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির নাম ছিল গ্রেট ব্রিটেন। সেই খ্রিষ্টীয় ৩য় শতক থেকেই ব্রিটেন ছিল রাজকীয় শক্তি আর অসীম ক্ষমতার অধিকারী। নানা যুদ্ধ বিদ্রোহ ও সম্রাজ্য দখলের কেন্দ্রতে ছিল ব্রিটেনের রাজ পরিবার। ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই রাজা এডওয়ার্ড কিংবা রানী প্রথম এলিজাবেথ খুবই প্রতাপশালী আর চেনা মুখ হিসেবে হাজির হতে থাকেন বারেবারে। কিন্তু ব্রিটিশ সূর্য একসময় অস্ত গিয়েছে। স্বাধীনতার বাজনা বেজেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। রাজতন্ত্র থেকে ব্রিটেন পৌঁছে গিয়েছে গণতান্ত্রিক পন্থায়।
কিন্তু তাতে খর্ব হয়নি ব্রিটেনের রাজপরিবারের সম্মান বা গৌরব। টাল খায়নি তাদের অর্থনৈতিক শক্তিও। একবিংশ শতকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ব্রিটেন রাজপরিবারের অর্থনৈতিক উৎস নেহায়েত কম নয়। পৃথিবীর ৩২১তম ধনী ব্যক্তি, রাণী এলিজাবেথের ব্যক্তিগত সম্পদ ৩৬০ মিলিয়ন পাউন্ড (৪৭০ মিলিয়ন ডলার)। জুয়েলারি, বিভিন্ন প্রাসাদ, সম্পত্তির হিসাব যদি করা হয় তবে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পদ রয়েছে ৮৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কি আছে এর পেছন দিককার রহস্য?
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ
এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি বা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং কুইন এলিজাবেথের জ্যেষ্ঠকন্যা হিসেবে জন্ম। ১৯৫৩ সালে তিনি যখন সিংহাসনে বসেন তখন ব্রিটিশদের শক্তি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন। রাজপরিবারের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসীন।
ব্রিটেন রাজপরিবারের সদস্য নেহায়েত কম না। প্রত্যেকেই আলাদাভাবে সম্পদের মালিকানা ধরে রেখেছেন। সম্প্রতি স্ত্রীকে নিয়ে নিজের আয়ে নির্ভরশীল হতে রাজপরিবার থেকে আলাদা হয়েছেন প্রিন্স হ্যারি। এতেই বোঝা যায়, সম্মিলিত নয় বরং ব্যক্তিগত এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবেই নিজেদের সম্পদ রক্ষা করছেন বাকিংহাম প্যালেসের অধিবাসীরা।
ধনাঢ্য রাজপরিবারের সবচেয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পাশাপাশি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি রাণী নিজেই। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাণীর আয়ের উৎস প্রধানত তিনটি। একটি হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বাৎসরিক হারে পাওয়া সোভরেইন গ্র্যান্ট, ডুচি অব ল্যাংকেস্টার এস্টেট এবং তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন সম্পত্তি ও বিনিয়োগ। সোভরেইন গ্র্যান্টের মাধ্যমে একটি এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ রাজপ্রসাদের যাবতীয় খরচ সামলায়।
এই গ্র্যান্টের আওতায় রাণী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে করমুক্ত ৪২.৮ মিলিয়ন পাউন্ড পেয়েছিলেন। বাকিংহাম প্যালেসের সংস্কারের জন্য যা পরবর্তীতে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
রাণীর আয়ের আরেকটি বিরাট উৎস হলো দ্যা ডুচি অব ল্যাংকেস্টার। এর গোড়াপত্তন ১২৬৫ সালে। এটি মূলত একটি প্রাইভেট বাণিজ্যিক, কৃষিজাত ও আবাসিক সম্পত্তি। পরিবারিকভাবেই রাণী এর উত্তরাধিকারী। বছরে এই সম্পত্তি থেকে গড়ে আয় হয় ১৯ দশমিক দুই মিলিয়ন পাউন্ড। এই বিপুল অর্থের পুরোটাই ব্যয় হয় রাণীর ব্যক্তিগত খরচের খাতে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ক্রাউন এস্টেট থেকে রানী পেয়েছেন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। রাজপরিবারের সম্মান অনুযায়ী যার পুরোটাই করমুক্ত। ক্রাউন এস্টেটের বেশির ভাগ সম্পত্তি মূলত লন্ডনে। এর বাইরে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ডেও সম্পদ রয়েছে। রয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার একর খামার, আবাসিক সম্পত্তি, বাণিজ্যিক কার্যালয়, দোকান, পার্কসহ বিভিন্ন স্থাপনার রাজস্ব।
এটি ছাড়াও রাণীর নিজস্ব কিছু সম্পত্তিও আছে যার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসল এবং পূর্ব ইংল্যান্ডের সান্দ্রিগ্রাম এস্টেট। এই দুটি সম্পত্তিই রাণী উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তার পিতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে।
এ সব সম্পত্তি ছাড়াও রাণীর সংগ্রহশালায় আছে বহুমূল্য বিরল ডাকটিকেটের সংগ্রহ, এবং বিশ্বের খ্যাতনামা শিল্পীদের শিল্পকর্মের মূল কপি।
প্রিন্স চার্লস
প্রিন্স অব ওয়ালস হিসেবে পরিচিত প্রিন্স চার্লসই রাণীর পর সিংহাসনে আসীন হবেন। তার স্ত্রী ক্যামিলা, যিনি রাজকীয় পদবী অনুসারে পরিচিত ডাচেস অব কর্ণওয়াল হিসেবে। রাজপরিবারের জনপ্রিয় এই দম্পতির আয় অনেকটাই জনগণের অর্থের উপর নির্ভরশীল। যদিও তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রাচুর্য মোটেই ফেলনা নয়। রাজসিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লসের সম্পদের মূল্য ৩৭০ মিলিয়ন ডলার। যার সবচেয়ে বড় ও প্রধান উৎস ডাচি অব কর্নওয়াল এস্টেট। বর্তমানে রানীর মালিকানাধীন থাকা ১৩৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ডুচি অব কর্নওয়াল’ নামের প্রাইভেট এস্টেট থেকে লাভের পুরোটাই পান প্রিন্স চার্লস। এই প্রাইভেট এস্টেটটি ইংল্যান্ডের ওয়ালস এবং কর্নওয়েলের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় সম্পত্তি দেখাশুনাসহ বেশ কয়েকটি দ্বীপ এবং কটেজ ভাড়া দিয়ে থাকে। যদিও এখান থেকে প্রাপ্ত আয় মূলত ব্যয় হত চার্লস দম্পতির দুই সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারির পরিবারের নির্বাহে।
এছাড়াও রাণীর সোভরেইন গ্র্যান্ট থেকে বাৎসরিক এক দশমিক তিন মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ ছিল প্রিন্স চালর্স ও ক্যামিলা পার্কারের নামে। এই অর্থ ছাড়াও ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকেও বছরে চার লাখ একষট্টি হাজার পাউন্ড অর্থ অনুদান হিসেবে পান।
তাদের আয়ের অধিকাংশই খরচ হয় বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাজ ও ভ্রমণে। তবে রাণীর মত অতটা সুযোগ নিয়ে অর্থ ব্যয় করতে পারেন না প্রিন্স চার্লস। নিয়মিত কর দিতে হয় তাকে। যার কারণে মোট সম্পত্তির প্রায় এক চতুর্থাংশ ব্রিটিশ সরকারের কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয় তাকে।
সকল খরচ শেষে উদ্বৃত্ত ছয় দশমিক ছয় মিলিয়ন পাউন্ড যায় প্রিন্স চার্লসের সন্তান, অনানুষ্ঠনিক কেনাকাটা এবং রাজকীয় সেভিংস অ্যাকাউন্টের পেছনে।
প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি
প্রিন্স উইলিয়াম ও তার পত্নী কেট মিডলটন এবং প্রিন্স হ্যারি রাণীর পক্ষে কোনও আনুষ্ঠানিক কাজে অংশগ্রহণ করার বিনিময়ে অর্থ নিয়ে থাকেন।
শুধু পিতা প্রিন্স চার্লসের অনুদানের উপরই নয়, প্রিন্স উইলিয়াম এবং প্রিন্স হ্যারি দুই ভাইই তাদের মা প্রিন্সেস ডায়ানার সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুজনেই আলাদাভাবে ক্যারিয়ার গড়েছেন। যার মাঝে প্রিন্স উইলিয়াম একজন পাইল্ট ছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত রয়েল আর্মিতে কাজ করেছেন। আর প্রিন্স হ্যারি সম্প্রতি জনগণের অর্থের বাইরে গিয়ে নিজস্ব স্বাধীনতা পেতে ছেড়েছেন রাজপরিবারের পদবী। বর্তমানে ব্রিটিশ আর্মির স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে কর্মরত আছেন প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট সন্তান।
এছাড়া রাজপরিবারের বাকি সদস্যরা কীভাবে অর্থ পান সে বিষয়ে গনমাধ্যমের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই। প্রিন্স চার্লস ছাড়াও রাণী এলিজাবেথের আরও তিন সন্তান আছেন। এবং সেই তিন সন্তানেরও নাতি পুতি আছে।
রাজপরিবারের বাকি সদস্য
রাণীর সবচেয়ে ছোট দুই ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক বলে পরিচিত এন্ড্রু এবং আর্ল অব ওয়েসেক্স বলে পরিচিত এডওয়ার্ড রাজপরিবারের ফুলটাইম কাজ করে থাকেন। তাদের কাজের মধ্যে আছে তাদের মায়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা। রাণী এ কাজের জন্য তার এই দু্ই সন্তানকে বেশ মোটা অংকের অর্থ দিয়ে থাকেন।
রাজপরিবারের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা নিজেদের ক্যারিয়ার নিজেরাই গড়বে এবং অনেক বেশি স্বাধীনচেতা হবে বলে আশাবাদী রাজপরিবারের সিনিয়র সিটিজেন সদস্যরা। তার লক্ষণও এরইমধ্যে দেখা গেছে। এন্ড্রুর দুই মেয়ে প্রিন্সেস বিয়াত্রিস এবং প্রিন্সেস ইউজিন ব্যবসা ও শিল্পজগতে পূর্ণকালীন চাকরি করছেন। যদিও চাকরি থেকে পাওয়া অর্থের বাইরেও তারা তাদের পিতার কাছ থেকে নিয়মিত অর্থসাহায্য পেয়ে থাকেন।