২০২০ এ কোন বইগুলো পড়ছেন বিল গেটস? 1 min read
Reading Time: 5 minutesকখনো নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছেন, বিল গেটসের সাথে আপনার পার্থক্য কোথায়?
এহেন বেরসিক প্রশ্নে কেউ কেউ মুচকি হাসবেন আবার কেউ তেড়ে আসবেন মারতে। ওটাই স্বাভাবিক, তবে ভুল বুঝবেন না। অর্থ বিত্তের তফাৎ দেখানোটা এই নাদান লেখকের উদ্দেশ্য নয় মোটেই। আমি বোঝাতে চাইছি, ব্যক্তিগত জীবন দর্শনে দুনিয়ার অন্যতম সেরা ধনীর সাথে আমাদের মতো সাধারণ লোকের প্রভেদটা।
Sense of Responsibility অর্থাৎ দায়বদ্ধতার উপলব্ধিই আমাদের আলাদা করে ফেলেছে বিল গেটস থেকে। ভেবে দেখুন, কোনভাবে ৫ কোটি টাকা আয় করে ফেললে কী করবেন আপনি? সিংহভাগই বেছে নেবেন আয়েশি জীবন। গোটা কয় বাড়ি আর ঝকঝকে বিএমডব্লিউ কিনেই নিজেকে সফল দাবি করে ফেলবেন।
ওদিকে ১১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পত্তি যার হাতে তিনি কিন্তু নিজেকে সবসময় সফলের কাতারে ফেলেন না। পৃথিবীর উন্নতির খাতিরে ক্রমাগত অবদান রাখাই তাঁর কাছে সাফল্যের পরিমাপক।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা ও বিল এন্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিল গেটসের ক্রমাগত সাফল্যের পেছনে রয়েছে বই পড়ার অভ্যাস। প্রতি বছর কমসে কম ৫০টি বই পড়েন গেটস। জ্ঞানের তৃষ্ণা ও নবীনকে বরণ করবার আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে নিয়ে গেছে উন্নতির শিখরে।
প্রতি বছরই নিজস্ব ব্লগে প্রিয় বইয়ের তালিকা ছাপেন তিনি। এবছরের মে মাসেও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানিয়েছেন পাঁচ বইয়ের লোভনীয় লিস্ট।
The Choice– লেখক ড. এডিথ এভা এগার
২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পেঙ্গুইন অস্ট্রেলিয়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় এডিথ এভা এগারের ‘The Choice: Embrace the Possibilities’. হলোকাস্টের স্মৃতিচারণ থেকে সেই আঘাত কাটিয়ে উঠবার বিশাল পরিভ্রমণ খন্ডে খন্ডে উঠে এসেছে এতে।
১৯৪৪ সাল, এডিথ এভা এগারের বয়স মাত্র ১৬। সেই কিশোরী ব্যালেরিনার সমান্তরাল জীবনে তখন মঞ্চজুড়ে প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়াবার কথা। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয় পরিবারের কাছ থেকে। কুখ্যাত জোসেফ মেনগেলের নির্দেশে তাঁর বাবা মা ও অন্যান্য আত্মীয়দের Auschwitz এর গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। প্রহসনের এই কিন্তু শেষ ছিল না, এই মেনগেলের সামনেই তাঁকে ব্যালে নৃত্য প্রদর্শনও করতে হয়েছিল সেসময়।
নাৎসিদের হাতে মৃত্যুই হয়তো নিয়তিতে ছিল। কিন্তু বেঁচে যান তিনি। তাঁকে যখন উদ্ধার করা হয়, পর্বতের মতো লাশের নিচে চাপা পড়েছিল দেহ। দীর্ঘ সময় মানসিকভাবে আঘাতগ্রস্ত ছিলেন। পরে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই পরিণত হন খ্যাতনামা মনস্তত্ববিদে।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নির্দয় অত্যাচার আর হলোকাস্টের দুর্বিষহ স্মৃতি আজও তাড়া করে ফিরলেও দমে যাননি এই থেরাপিস্ট। বিল গেটসের মতে, ‘যত ভয়ংকর অভিজ্ঞতাই আপনার হোক না কেন, আমার বিশ্বাস এই বই থেকে কিছুটা সাহস অর্জন করতে পারবেন।‘
Cloud Atlas –লেখক ডেভিড মিচেল
‘বর্তমানের চৌকসেরা শুধু নন-ফিকশন বা অনুপ্রেরণামূলক বই পড়েন’- এই প্রথাগত ধারণাকে ‘টাটা বাইবাই’ জানান। কেননা, এই বছর বিল গেটসের প্রিয় বইয়ের তালিকায় দ্বিতীয়তেই আছে এক উপন্যাস।
ছয়টি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত গল্প একসূত্রে বেঁধে এগিয়েছেন লেখক মিচেল। ২০০৪ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের পটভূমি ১৮৫০ সালের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আরম্ভ করে পোস্ট-আপোক্যালিপ্টিক পৃথিবীর বাস্তবতা পর্যন্ত সুদীর্ঘ বিবরণে এগিয়েছে।
পাঠককুলের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলেও ম্যান বুকার প্রাইজে এর মনোনয়নই প্রমাণ করে এর সাহিত্যিক আবেদন। গেটসও তাঁর প্রতিক্রিয়ায় একে ‘অসামান্য মানবিক এক উপন্যাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
The Ride of a Lifetime– লেখক: বব আইগার
ব্যবসা সংক্রান্ত বই পড়াটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ বিলের ক্ষেত্রে। তাই ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বব আইগারের বইকেই টপ চার্টে তুলে আনলেন।
২০০৫ সালে যখন আইগার ডিজনির দায়িত্ব পান, তখন বেশ ভরাডুবির মুখেই পড়েছিল কোম্পানিটি। ক্রমশ প্রতিযোগিতা থেকে হারিয়ে যাবার আশঙ্কা, প্রযুক্তির ক্ষিপ্র গতিতে বদল সব মিলিয়ে দিশেহারাই ছিল এর অবস্থা। বব তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি টের পাচ্ছিলাম অতীত ঘেঁটে আদৌ কোন লাভ নেই। বরং ভবিষ্যতের দিকে মন দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।‘
ঠিক এর বারো বছরের মাথাতেই পিক্সার, মারভেল, লুকাস ফিল্ম, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্সের মালিক হয় ডিজনি। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছুলেই বিনীত বব, ‘গত ১৪ বছরে নেতৃত্ব কাকে বলে শিখেছি। যত যাই শুনুন না কেন, বাস্তবিক অভিজ্ঞতা ব্যতীত এটা আয়ত্ত করা অসম্ভব।‘
২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশ পায় ডিজনি সিইওর এই আত্মস্মৃতিচারণ।
The Great Influenza– লেখক জন এম ব্যারি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। এর মধ্যেই আমেরিকার ক্যানসাস থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল শতাব্দীর অন্যতম ভয়ানক মহামারি- ফ্লু। ১০০ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটে এর প্রভাবে।
২০০৪ সালে ভাইকিং প্রেস থেকে প্রকাশিত জন ব্যারির এই বইয়ে ঐতিহাসিক তথ্য, উপাত্তের পাশাপাশি তৎকালীন সামাজিক অবস্থা এবং সংকটের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। এর একশো বছর বাদে করোনা মহামারিতেও দৈনিক মৃত্যু ঘটছে অসংখ্য লোকের। গেটস এই সংকটকে সেই ফ্লুর সাথে তুলনা করে বলেন, ‘শুধু ইতিহাসকে জানবার জন্যই নয়, এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের সংকট মোকাবেলার স্বার্থে এটি পড়া জরুরি।‘
Good Economics for Hard Times– লেখক: অভিজিৎ ভাস্কর ব্যানার্জি এবং এস্থার ডুফলো
অর্থনীতিবিদ এই দম্পতির নোবেল জয়ের খবর সর্বজনবিদিত। সেই নোবেলের রেশ টাটকা থাকতেই তাঁদের আরেকটি অর্থনীতির বই পাঠকের হাতে গুঁজে দিতে চান বিল।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক শ্রেণিবিভাগ সহ নানান সংঘাতের নানান দিক তুলে ধরেছেন ডুফলো-অভিজিৎ। মার্কিন মুলুকের অর্থনৈতিক অবস্থানের কড়া সমালোচনা, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট ও প্রযুক্তিগত সমস্যা মোকাবেলার বেশ কিছু পরামর্শ ও বিবিধ আলোচনাও রয়েছে সরস এই বইয়ে।
২০১৯ এর ১২ নভেম্বর পাবলিক অ্যাফেয়ারস প্রকাশ করে এটিকে। অনেকে একে ‘এন্টি ট্রাম্প’ বই হিসেবেও ঘোষণা করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে।
চলচ্চিত্র আর সিরিজেও মনোযোগ
বইয়ের লম্বা লিস্ট দেখে যারা আড়মোড়া ভাঙতে চান তাদের জানাই, বিল গেটস কিন্তু ফিল্ম-সিরিজেরও বেশ ভক্ত। তাঁর অন্যতম পছন্দের চলচ্চিত্র ব্র্যাড পিট-রবার্ট রেডফোর্ড অভিনীত ‘Spy Game’. থ্রিলার জনরার এই ছবি নাকি আজ অবধি ১২ বার দেখেছেন তিনি।
‘Pandemic: How to Prevent an Outbreak’- নেটফ্লিক্সের এই তথ্যচিত্রকে দেখবার অনুরোধ বিলের। বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষক, বিজ্ঞানীদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, তাঁদের সংগ্রাম এবং মানব কল্যাণে অবদান বিষয়ে জানবার জন্য নিঃসন্দেহে উপাদেয় এই চিত্রায়ন।
‘A Million Little Things’, ‘This Is Us’ এবং ‘Ozark’- নন্দিত এই সিরিজগুলোকে উপভোগ্যের কাতারেই ফেলেন বিল-মেলিন্ডা যুগল। এছাড়াও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসভিত্তিক ‘I, Claudius’ নিয়েও তাঁর উচ্ছ্বাস প্রচুর। সত্তর দশকের জনপ্রিয় এই বিবিসি সিরিজকে ঐতিহাসিক আগ্রহ ও নির্মাণের জন্য দেখবার পরামর্শ তাঁর। ।
বই পড়বার নিয়ম–কানুন
প্রশ্ন করতেই পারেন, বিল গেটস ঠিক কীভাবে বই পড়েন আর সেটার সুফলও পান। এ বিষয়ে চারটি সহজ নিয়ম অনুসরণ করেন তিনি।
প্রথমত, যেকোনো বই পড়বার সময় প্রচুর নোট করেন। ফিকশনের বেলায় কম নোট করলেও নন-ফিকশন পড়বার সময় বিশাল সময় ব্যয় করেন নতুন তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটিতে।
দ্বিতীয়ত, বই নির্বাচনে ভীষণ সতর্ক বিল। শুরু করলে গোগ্রাসে পুরোটা শেষ করতে পারবেন- এমন ধাঁচের বই-ই তাঁকে টানে। আধা সমাপ্ত গ্রন্থ তালিকা নেই তাঁর।
তৃতীয়ত, টেক জগতে প্রসিদ্ধ হলেও বইয়ের বেলায় কাগজের পাঁচমিশালি বই ভালোবাসেন তিনি। ই-বুক, পিডিএফে অভ্যস্ত নন একটুও।
চতুর্থত, প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা অখণ্ড অবসরের একমাত্র সঙ্গী বই। বিশেষত রাতে ঘুমুবার আগে আধা থেকে এক ঘণ্টা পড়েই কাটান।
শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বারবার আত্মিক উন্নতির স্বার্থে সাহিত্য চর্চাকে সাধারণের কাতারে আনবার তাগাদা দিয়েছেন । তাঁর মতে-
‘ আমাদের কর্মীর দল যেমন একদিকে বাংলায় ডেমোক্রেসি গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন, তেমনি আর-এক দিকে আমাদের পক্ষে মনের অ্যারিস্টোক্রেসি গড়ে তুলতে চেষ্টা করা কর্তব্য। এর জন্য চাই সকলের পক্ষে কাব্যকলার চর্চা।‘
কেবল বিল গেটস নন, যেকোনো মাল্টি মিলিয়নার-বিলিয়নার ব্যক্তির অভ্যাসের ফিরিস্তি শুনলেই বুঝবেন, বই পড়া অত্যাবশ্যক।
লেখক- সারাহ তামান্না