featured বিশ্ব

বিক্ষোভের পেছনের গল্প1 min read

নভেম্বর ৪, ২০১৯ 4 min read

author:

বিক্ষোভের পেছনের গল্প1 min read

Reading Time: 4 minutes

বিক্ষোভ চলছে। হংকং থেকে চিলি। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য। কোন কোন দেশ হয়তো কিছু দিন আগেও উন্নত বা সম্ভবনাময় দেশ গুলোর একটি বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু অর্থনীতিবিদ আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেক হিসাব এলোমেলো করে দিয়ে আজ দেশ গুলোর রাজপথে  নেমে এসেছে হাজারো জনতা। আজ পাঠকদের সাথে নিয়ে এই বিক্ষোভ গুলোর কারণ, প্রকৃতি আর সম্ভাব্য পরিণতি খোঁজার চেষ্টা করবো আমরা। 

দাবির বিচিত্রতা

কোন দেশে হয়তো আন্দোলন  হচ্ছে হোয়াটস এপ এর উপর বসানো কর প্রত্যহারের দাবিতে। কোন দেশে আন্দোলন হচ্ছে দৈনন্দিন জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের দাবিতে। কোথাও আবার আন্দোলন হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে। কোন দেশের জনগণ ফুঁসে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে। 

চিলি

চিলির কথাই ধরা যাক। ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে দেশটির। বড় হয়েছে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনুপাত। পরিবর্তন ঘটেছে তাদের জীবন যাত্রার মানের। কিন্তু বিপত্তি দেখা যাচ্ছে গত কিছুদিন যাবত। চিলির অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় পরিবহণ খাতে অতিরিক্ত কর বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জনগণ নেমে আসে রাজপথে। 

সমস্যাটার মূলে আছে বর্ধিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করা জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সহায়তা প্রকল্প আছে। আছে অতি ধনী গোষ্ঠীর জন্য আছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। বিপদে পরে গেছে মধ্যবিত্ত চিলিয়ানরা। তাই নিজেদের অবস্থা তুলে ধরবার মরিয়া প্রচেষ্টায় আজ চিলিয়ানরা রাজপথে।  

ট্যাংকের সামনে চিলিয়ান বিক্ষোভকারী

হংকং- অনমনীয়, অভূতপূর্ব 

২০১৯ সালের প্রায় পুরোটা জুড়েই বিক্ষোভ ছিলো হংকং এ। প্রাথমিক ভাবে হংকং এর বিক্ষোভ সেদেশের নির্বাহী ক্যারি লামের আনা প্রত্যাবসন বিলের বিরুদ্ধে শুরু হলেও দ্রুতই তা চীনা আধিপত্য বিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়। পুলিশি হামলা, নির্যাতনের মুখেও অবিচল হংকং এর বিক্ষোভকারীরা। 

হংকং এর গল্পটা একটু অন্যরকম। GDP এর দিক দিয়ে হংকং পৃথিবীর নবম বৃহত্তম অঞ্চল। Heritage Foundation এবং Simon Fraser University এর জরীপে হংকং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিক থেকেও উপরের দিকেই। কিন্তু মূল সমস্যাটা হচ্ছে আয় বৈষম্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্রমাগত সংকোচন। 

হংকং এর বিক্ষোভকারীদের দেখা এমন গ্যাস মাস্কেও

ক্রমবর্ধমান চীনা হস্তক্ষেপে আতংকিত স্বাধীনচেতা হংকং বাসী। বিষয়টা ফুটে উঠেছে Gallup Poll এর ফলাফলেও। অর্থনীতির আকারের দিক দিয়ে নবম বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল হলেও সুখী মানুষের হিসেবে হংকং এর অবস্থান ৬৬তম। ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ যে এরকম ভয়াবহ বিক্ষোভে রূপ নিবে তা বোধ করি হংকং কতৃপক্ষও ভাবতে পারেনি।

বিক্ষোভ চলছে লেবানন, ইরাকেও। মোটা দাগে এদের মাঝে সাদৃশ্যতা খুঁজতে গেলে যা দেখা যায়-

আয় বৈষম্য ও দুর্নীতি 

ভয়াবহ আয় বৈষম্য বিক্ষোভের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। উদাহারণ হিসেবে চিলিকে নেওয়া যেতে পারে। OECD ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে চিলিতে আয় বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। মারত্মক আয় বৈষম্য তখনই দেখা দেয় যখন দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যহারের কারণে একটি গোষ্ঠীর অন্য সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক সম্পদের অধিকারী হয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে।

আয় বৈষম্যের তুলনা মূলক চিত্র

ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির ফলে সরকারের ব্যয়ও বেড়ে যায়। সেই ব্যয় মেটাতে সরকার খোঁজে বিকল্প রাস্তা। যেমনটা ঘটেছে ইকুয়েডর এবং লেবাননে। ইকুয়েডরে সরকারের ব্যয় কমানোর জন্য তেলের উপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়। লেবাননে কর বসানো হয় হোইয়াটস অ্যাপ মেসেজের উপর।  

ইরাকের বিক্ষোভের বিষয়টা এখানে আরো প্রাসংগিক। বিক্ষোভকারীরা ইরাকের পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থারই পরিবর্তন চাচ্ছেন। ইরাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে স্বজন প্রীতি ও দুর্নীতি। 

ইরাকে বিক্ষোভের কিছু চিত্র

রাজনৈতিক স্বাধীনতা 

বিক্ষোভের পেছনে আছে রাজনৈতিক কারণও। হংকং এ বিক্ষোভের মূল কারণ ক্রমবর্ধমান চীনা আগ্রাসন। প্রাথমিকভাবে প্রত্যাবসন বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলেও এখণ আন্দোলনের দাবিতে যোগ হয়েছে ক্যারিলামের পদত্যাগ, পুলিশি নৃশংসতার বিচার এবং চীনা হস্তক্ষেপ বন্ধ করার দাবি।

স্বাধীনতাকামী নেতাদের কারাদন্ড দেবার কারণে রাজপথে আন্দোলন কাপাচ্ছে বার্সোলোনা। কাতালানবাসীর আন্দোলনে অনেকটাই তালমাতাল স্পেন

বিক্ষুব্ধ কাতালোনিয়া

নেতাবিহীন আন্দোলন

আন্দোলনগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রায় সবগুলো আন্দোলনই সংগঠিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন মেসেজিং এপস এর মাধ্যমে। 

প্রায় প্রতিটা আন্দোলনের শুরুতেই নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন বিরোধী নেতা কর্মীদের জেলে পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকার। হংকং এর ক্ষেত্রে এই বিরোধী নেতার নাম ছিলো Joshua Wong। রাশিয়াতে গ্রেফতার হয়েছেন Joshua Wong। লেবানন,চিলি,ইরাক প্রায় সব জায়গায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী নেতাদের খুঁজে বেরিয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকার। 

কিন্তু আন্দোলনগুলো সংগঠিত হচ্ছে ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে। আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করছেন টেলিগ্রামের মতো এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের। আন্দোলনকারীরা খুব দ্রুত একে অন্যের কাছ থেকে শিখছেনও। বার্সালোনায় বিমান বন্দর বন্ধ করে দেবার কৌশল হংকং এর আন্দোলন কারীদের কাছ থেকেই শেখা। এমনকি বার্সালোনায় আন্দোলনে টিয়ার গ্যাস এবং জল কামান থেকে বাঁচার কৌশল শেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে হংকং এর আন্দোলনকারীদের লিফলেট। এই বছরের শুরুতে হওয়া সুদান এবং আলজেরিয়ার আন্দোলনেও আন্দোলনকারীরা একে অপরের স্লোগান, লিফলেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। 

প্রথাগত মিডিয়ার প্রতি অবিশ্বাস

আন্দোলনকারীদের বার্তা পরিস্কার- টিভি বন্ধ করুন, সোস্যাল মিডিয়া অন করুন। মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার বদলে আন্দোলনকারী এবং সাধারণ জনগণের আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে সোস্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ব্লগিং সাইট গুলো 

দিনের শেষে জনগণের দাবি কতটুকু আদায় হবে তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। তবে এটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়, 

“আসছে ফাগুনে ওরা দিগুণ হবে“

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *