বিশ্ব

বার্লিন ওয়ালের উত্থান ও পতন1 min read

নভেম্বর ৬, ২০২০ 5 min read

author:

বার্লিন ওয়ালের উত্থান ও পতন1 min read

Reading Time: 5 minutes

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘ ২৮ বছর বার্লিন ওয়াল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতন্ত্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্রের মধ্যে অদৃশ্য “আয়রন কার্টেইন (Iron Curtain)” ও স্নায়ুযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্র শক্তির (Allied Power) চার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে চার ভাগে ভাগ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত জার্মানি পরিচিত ছিল ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি (পশ্চিম জার্মানি) নামে এবং সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত জার্মানি পরিচিত ছিল জার্মান ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক (পূর্ব জার্মানি) নামে। জার্মান রাজধানী বার্লিন সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানির ভূখণ্ডের মধ্যে পড়লেও সেখানে একই রকম চার ভাগ করা হয়েছিল। সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত বার্লিন পূর্ব ও মিত্র শক্তি নিয়ন্ত্রিত বার্লিন পশ্চিম বার্লিন নামে পরিচিত ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তারা গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অর্থনীতি ও সামরিক নীতি কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব মানচিত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দাপট অনেকখানিই লোপ পায়। তারা বাধ্য হয় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে নিজেদের উপনিবেশ তুলে নিতে। আর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে নতুন দুই পরাশক্তি জন্ম নেয়- যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

আদর্শগত পার্থক্যের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অন্য তিন মিত্র শক্তির সম্পর্কে দ্রুতই ফাটল দেখা দেয়। ফলস্বরূপ জার্মানি দখলে তাদের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তা হয়ে উঠে প্রতিযোগিতামূলক ও আগ্রাসী। এক্ষেত্রে একটি বিখ্যাত একটি ঘটনা স্মরণ করা যায়। যেহেতু পশ্চিম বার্লিন সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে বেষ্টিত ছিল, তাই সেখানে কোন কিছু পাঠাতে হলে স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব জার্মানির ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হতো। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম বার্লিনে সব রকম সরবরাহ বন্ধের জন্য অবরোধ ঘোষণা করে। যদিও সোভিয়েতের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত কাজে আসে নি। পশ্চিম জার্মানি বিমান যোগে সব কিছু পশ্চিম বার্লিনে পাঠানো শুরু করলে সোভিয়েত তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

প্রাথমিকভাবে এমন কাঁটাতারের বাঁধা তৈরি করে আলাদা করা হয়েছিল বার্লিনকে; Keystone / Getty Images

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিম জার্মানি এবং পূর্ব জার্মানিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান একেবারেই বিপরীতমুখী হয়ে যায়। পশ্চিম জার্মানিতে পুঁজিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ফলে অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করেছিল। এখানে বসবাসকারী জনগণ কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করতে পারতো। অপরদিকে পূর্ব জার্মানিতে ছিল প্রায় বিপরীত চিত্র। সোভিয়েত সেখানে কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে অর্থনীতি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হয়ে যায় সীমাবদ্ধ। এছাড়া সে সময় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ব জার্মানি পতিত ভূখণ্ডের মতো গুরুত্ব পেত। তারা পূর্ব জার্মানির উন্নতির কথা না ভেবে উল্টো সেখান থেকে কল-কারখানার সরঞ্জাম এবং অনান্য মূল্যবান সম্পদ সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠিয়েছিল।

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে পূর্ব জার্মানিতে বসবাসকারী অনেক লোকই উন্নত জীবনের আশায় পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সীমানা প্রাচীর পেরোনো খুব একটা সহজ ছিল না। তাই পূর্ব জার্মানরা পশ্চিম বার্লিন ব্যবহার করে পালাতো। ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে পূর্ব জার্মানি থেকে অনেক প্রশিক্ষিত, পেশাদার তরুণ পশ্চিম জার্মানিতে পাড়ি জমান। এতে পূর্ব জার্মান দ্রুত তাদের শ্রমশক্তি এবং জনসংখ্যা উভয়ই হারাতে শুরু করে। অনুমান করা হয় ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে পূর্ব জার্মানির মোট ১৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়ন পশ্চিম জার্মানিতে চলে গিয়েছিলেন।

বার্লিন প্রাচীর ঘিরে ছিল নো ম্যানস ল্যান্ড; Bettmann Archive / Getty Images

সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলার পুতুল পূর্ব জার্মান সরকার বেশ কয়বার পশ্চিম বার্লিন দখলের ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়েছিল। এমনকি বার্লিন দখলকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশগুলি পশ্চিম বার্লিন রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

নিজ দেশের নাগরিকদের আটকাতে মরিয়া পূর্ব জার্মানি কোন কিছুতে পেরে না উঠে সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিম ও পূর্ব বার্লিনের মধ্যে প্রাচীর তৈরি করার। ১৯৬১ সালের আগস্টের ১২ তারিখ মধ্যরাতে শুরু হয় বার্লিন ওয়ালের নির্মাণ কাজ। মধ্যরাতে বার্লিনবাসী যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন একদল সৈন্য এবং নির্মাণ শ্রমিক পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার রাস্তাগুলোতে বাঁধা সৃষ্টি করে, রেললাইন অবরুদ্ধ করে। পূর্ব এবং পশ্চিম বার্লিনের সীমানা জুড়ে কংক্রিটের স্থাপনা এবং কাঁটাতার বেঁধে গর্ত খনন করা শুরু হয়।

বার্লিন প্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ৯৬ মাইল (১৫৫ কিলোমিটার)। এটি কেবল দুই বার্লিনের সীমানা বরাবর নয়, বরং এটি দিয়ে পুরো পশ্চিম বার্লিনের চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়েছিল। বার্লিন প্রাচীরের ২৮ বছরের ইতিহাসে এটি চারবার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। এর শুরু হয়েছিল কংক্রিটের পোস্ট সহ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শক্ত স্থাপনা তৈরি করে প্রাচীরটিকে আরও দুর্ভেদ্য করে ফেলা হয়েছিল। প্রাচীরের পাশে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী। প্রাচীর ঘেঁষে বানানো হয়েছিল ৩০০ ফুট প্রস্থের নো ম্যানস ল্যান্ড। এছাড়া যানবাহনের যাতায়াত ঠেকাতে খাঁজ, বৈদ্যুতিক বেড়া, ৩০২টি ওয়াচ টাওয়ার, বাঙ্কার এমনকি মাইনফিল্ডও পুতে রাখা হতো। তবে বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং অন্যদের পারাপারের জন্য হাতে গোনা কয়েকটি চেকপয়েন্ট বসানো হয়েছিল।

সময়ের সাথে সাথে বার্লিন প্রাচীর হয়ে উঠে দুর্ভেদ্য দূর্গ

বার্লিন প্রাচীর বেশিরভাগ পূর্ব জার্মানদের দেশত্যাগ করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছিল, তবে শুরুর ভাগে এটি সবাইকে আটকাটে পারেনি। অনুমান করা হয় প্রায় ৫ হাজার মানুষ নিরাপদে বার্লিন প্রাচীর ভেদ করে পশ্চিম বার্লিনে যেতে পেরেছেন। দূর্ভাগ্যক্রমে সবার পালানোর চেষ্টা সফল হয়নি। এক সময় পূর্ব জার্মান তাদের সৈন্যদের  প্রাচীরের সীমান্তে কাউকে দেখতে পেলেই গুলি করবার অনুমতি দেয়। এতে পালাতে গিয়ে কমপক্ষে ১৪০ জন মারা গিয়েছিলেন।

বার্লিন প্রাচীরের উত্থানের মতো পতনের ঘটনাটিও ছিল অকস্মাৎ। ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কম্যুনিস্ট ব্লক দূর্বল হতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে বিল্পব শুরু হয়। তবে পূর্ব জার্মানের নেতারা তাদের দেশে কঠোর কোন বিপ্লব না করে কেবল মধ্যপন্থী সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ব জার্মানের সাধারণ নাগরিকরা তাতে রাজি ছিল না।

একটা সময় পূর্ব জার্মানবাসী টানেল খুঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে, এমনকি একটি গর্ত পর্যবেক্ষন করছে পূর্ব জার্মান সৈন্যরা; Michael Ochs Archives / Getty Images

রাশিয়ান নেতা মিখাইল গর্বাচেভ (১৯৮৫-১৯৯৯) তার দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে বেশ কিছু পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশ্যম্ভাবী ভাঙ্গনের পক্ষে ছিলেন। ১৯৮৯ সালের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় বিপ্লব সংগঠিত হয়। পূর্ব জার্মানরাও নিজেদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠে। কিন্তু পূর্ব জার্মানির নেতা Erich Honecker গায়ের জোরে তাদের আন্দোলন থামানোর হুমকি দেন। ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে Erich গর্বাচেভের সমর্থন হারানোর পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার জায়গায় পূর্ব জার্মানির ক্ষমতায় বসে Egon Krenz। Krenz জানতেন সহিংসতা দেশের সমস্যা সমাধান করবে না। তাই তিনি পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞাগুলি শিথিল করেন।

১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির সরকারি কর্মকর্তা Günter Schabowski  হঠাৎ করে বার্লিন প্রাচীর উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণার পর হাজার হাজার লোক সীমান্তে জমা হয়ে উদযাপন করা শুরু করে। বার্লিন প্রাচীর উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণার পর ১৯৯০ সালের ৩  অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি পুনরায় এক হয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *