ইতিহাস

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন: বাংলা ভাষায় প্রথম কোরআন শরিফ এর অনুবাদক1 min read

জুন ১২, ২০২০ 4 min read

author:

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন: বাংলা ভাষায় প্রথম কোরআন শরিফ এর অনুবাদক1 min read

Reading Time: 4 minutes

প্রথম জীবনে তার নাম ও কাজ জানতে পেরে মনে বিষ্ময় জাগেনি এমন ব্যক্তি হয়ত খুব কমই আছেন। পবিত্র কোরআন এর বাংলা অনুবাদকের নাম যে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল সবার কাছে। তবে বাস্তবতা এটাই যে, আমাদের মাতৃভাষায় প্রথমবার ইসলাম ধর্মের পবিত্র এই গ্রন্থের অনুবাদ করেন একজন ব্রাহ্মধর্মের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কেন? আর একজন ব্রাহ্মধর্ম অনুসারীর হাতে করা কোরআন অনুবাদ বাংলার মুসলিম সমাজ আসলে কিভাবে নিয়েছিল?

গিরিশচন্দ্র সেনের নিজস্ব লেখা থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মধর্মের নববিধান মণ্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেনের উৎসাহ এবং অনুরোধে তিনি এ কাজ শুরু করেন। কেশবচন্দ্র সেন চেয়েছিলেন সকল ধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয় আনতে।আর এই সমন্বয় সাধনের জন্য সব ধর্ম সম্পর্কে জনসাধারণের সাধারণ জ্ঞান থাকা জরুরী ছিল। আর তাই প্রধান ধর্মগুলোর সারকথা জানার জন্য তিনি ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মূল গ্রন্থগুলো বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নেন। চার ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ অনুবাদের জন্য চারজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে তিনি দায়িত্ব প্রদান করেন।

গিরিশচন্দ্র সেন উর্দু, ফার্সি এবং সংস্কৃত ভাষায় দখল থাকার কারণে কোরআন শরিফ অনুবাদের মতো কঠিন কাজ পেয়েছিলেন। কঠিন বলা চলে দুই দিক থেকে। প্রথমত ভাষাগত কারণ। আরবি ভাষা শিখে তবেই অনুবাদে হাত দেয়া যায় এবং দ্বিতীয়ত সমাজ ব্যবস্থা।

অনুবাদ করার মতো আরবি জ্ঞান ছিল না গিরিশচন্দ্র সেনের। তিনি ১৮৭৬ সালে ভারতের লখনৌ শহরে পাড়ি জমান আরবি ব্যাকরণ শেখার জন্য। ৪২ বছর বয়সী গিরিশচন্দ্র সেন সেখানে একজন মৌলবির কাছে আরব্য ভাষার তালিম নিতে শুরু করেন। আরবি ব্যাকরণে বিজ্ঞ পঁচাত্তর বছর বয়সের মৌলবি এহসান আলী তাকে যত্নের সঙ্গে আরবি ভাষা শিক্ষা দেন। এরপর কলকাতার একজন মৌলবির কাছে কিছুদিন আরবি ভাষার শিক্ষা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন গিরিশচন্দ্র।

ঢাকায় এসে দ্বিতীয় দফায় নলগোলার মৌলবি আলীমুদ্দিনের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তিনি। গিরিশচন্দ্র জানতেন কোনো মুসলমান কোরআন বিক্রেতা তার কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ বিক্রি করবে না। তখন তিনি তার সমমনা একজন মুসলমান বন্ধু মিয়া জালাল উদ্দিনের মাধ্যমে একটা কোরআন শরিফ সংগ্রহ করেন।

গিরিশচন্দ্র সেন; Photo Source: banglapedia

গিরিশচন্দ্র সেনের হাত ধরে সর্বপ্রথম কোরআন শরিফের ক্ষুদ্র একটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালে। একে পরীক্ষামূলক প্রকাশও বলা যেতে পারে। মজার ব্যাপার হল, প্রথম খণ্ড প্রকাশের সময় অনুবাদকের নাম গোপন রাখা হয়। কারণ অনুবাদক হিসেবে সংকলনেই নাম প্রকাশ পেলে নানাবিধ ঝামেলা হতে পারতো। এমনকি পুরো কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। মাত্র ২৫ পয়সায় বাজারে এসেছিল ৩২ পৃষ্ঠার একটি অনুবাদ। মোটামুটি ভালো একটি সাড়া পাবার পর তিনি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজে হাত দেন। ১৮৮১ সালে ময়মনসিংহে অবস্থানকালে তিনি কোরআন শরিফের ছোট ছোট অংশের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন। একই বছরের শেষ দিকে তিনি শেরপুরের চারুযন্ত্র প্রেস থেকে তার অনুবাদের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন।

প্রথম খন্ড প্রকাশের সময় নিজের নাম ব্যবহার করেছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। গিরিশচন্দ্র সেনের অনূদিত কোরআন শরিফ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকমের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি তার মুসলমান বন্ধুদেরই অনেকে তাকে কাফের সম্বোধন করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে।

এসব জটিলতার মাঝে ১৮৮২ সালে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ হলে দৃশ্যপট আমূল বদলে যায়। বেশ কয়েকজন আলেম গিরিশচন্দ্র সেনকে অভিনন্দন জানান এবং জমিদার, ধনাঢ্য মুসলমানরা তার অনূদিত কোরআন শরিফ কেনার জন্য অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতে শুরু করে। এর ফলে পরবর্তী খণ্ডগুলো প্রকাশ করাটা বেশ সহজ হয়ে যায় গিরিশচন্দ্রের জন্য।

কলকাতার বিধানযন্ত্র ছাপাখানা থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ হতে থাকে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ। সব মিলিয়ে কাজ কোরআন শরিফের অনুবাদ শেষ করতে সময় লেগেছিল ৬ বছর। অনুদিত কোরআনের আকার দাঁড়িয়েছিল ১২ খন্ড। আর মুদ্রিত মূল্য ছিল মাত্র আড়াই টাকা।

১৮৯৮ সালে বাংলায় অনূদিত কোরআন শরিফের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় কলকাতার দেবযন্ত্র প্রেস থেকে। কলকাতার মহালগঙ্গা মিশন প্রেস থেকে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে এবং বাংলাদেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে ঢাকার ঝিনুক পুস্তিকা থেকে।

সব মিলিয়ে প্রায় বিতর্কহীনভাবেই গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা অনুবাদ সে সময়ের মুসলিম সমাজ এবং আলেমগণ গ্রহণ করেন। তখন অনেক বিজ্ঞ আলেম গিরিশচন্দ্রের প্রশংসা করে পত্র লেখেন। যারা পত্র লিখেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মওলানা আকরাম খাঁ, ইসলামি চিন্তাবিদ মজফর আবদুল্লাহ, কলকাতা মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক আহমদ উল্লাহ প্রমুখ।

কাজের ব্যাপক স্বীকৃতি স্বরূপ গিরিশচন্দ্র সেনের নামের আগে মুসলমান সমাজ ‘ভাই’ শব্দটি যোগ করে। সেখান থেকেই তার নামের প্রচলন হয়, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। আবার অনেকেই তাকে মৌলবি গিরিশচন্দ্র সেন ডাকতে শুরু করে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে থেকেই ভারত উপমহাদেশের বাংলাভাষী অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রচারকদের আগমন হয় তারও অনেক আগে। সে সময়ে প্রায় সাত কোটি মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্যও ছিল বাংলা ভাষায়।

আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় পারদর্শী অনেক আলেম ছিলেন যারা বাংলা সাহিত্যেও পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত কোরআন শরিফের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। টাঙ্গাইলের মাওলানা আমির উদ্দিন বসুনিয়া আমপারার কিছু অংশ অনুবাদ করলেও তা সংরক্ষণ নিয়ে বিশেষ জানা যায়নি।

গিরিশচন্দ্র সেন শুধু কোরআন শরিফের অনুবাদ করেই তার কাজ শেষ করেননি। সাধারণের কাছে যা অজানা তা হলো, গিরিশচন্দ্রই হযরত মুহাম্মদ (সা.)- এর প্রথম বাঙালি জীবনীকার। তিনি ১৯০৫ সালে মুসলমানদের কল্যাণে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা এবং পুস্তক রচনা করেছিলেন। তিনি ইমাম হাসান এবং হোসেনের জীবনীসহ মিশকাত শরিফের অর্ধেকটা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও ইসলাম ধর্মবিষয়ক প্রায় ৪২টি বই রচনা এবং অনুবাদ করেছেন গিরিশচন্দ্র সেন। যদিও এসব মহান কাজের স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন সমাজ থেকে, কিন্তু এসব বিরল কাজের সংরক্ষণ নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী দেখা যায়নি কাউকেই।

তার অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শেখ ফরিদুদ্দিন আত্তারের ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ অবলম্বনে ‘তাপসমালা’, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির ‘মসনবি শরিফ’ ও শেখ আত্তারের ‘মানতেকুহতায়ের’ অবলম্বনে ‘তত্ত্ব-রত্নমালা’, শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ’ ইত্যাদি। টীকাসহ কোরআন শরিফ অনুবাদের সময় গিরিশচন্দ্র সেন তাফসিরুল হোসাইন, শাহ আবদুল কাদিরের ফায়িদা এবং তাফসিরুল জালালাইন অনুসরণ করেন।

নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনায় এই মহান মানুষটির নিবাস ছিল। তবে সংস্কারের অভাবে আর দখলদারিত্বের চাপে তার শতবর্ষী বাড়িটি পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছিল। ২০০৮ সালে বাড়িটির মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কারে অনুদান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে ভারতীয় হাইকমিশন। পরে ২০১৫ সালে নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের মধ্যে বাড়িটি সংরক্ষণ ও একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর নির্মাণের চুক্তি হয়। এরপর সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও দিক নির্দেশনায় সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

হয়ত বর্তমান আধুনিক যুগে প্রায় সবার হাতের কাছেই বাংলা অনুদিত কোরআন পাওয়া যায়। আরো সংক্ষেপে ভাবলে, স্মার্টফোন তো আছেই। কিন্তু, সব শুরুর রূপকার যিনি, তাকে ছাড়া কাজগুলো কতটা সহজ হতো ভাবা দুষ্কর। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন আরো অনেক প্রজন্ম ধরে একই বিষ্ময় জাগিয়ে যাবেন, একজন ব্রাহ্মধর্ম অনুসারী হয়ে কোরআন অনুবাদের মতো তার অনন্য কাজ দিয়ে।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *