featured বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু হত্যার পলাতক আসামীরা1 min read

আগস্ট ১৫, ২০২০ 4 min read

author:

বঙ্গবন্ধু হত্যার পলাতক আসামীরা1 min read

Reading Time: 4 minutes

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটে যায় সে রাতে। নিজ বাসভবনেই সপরিবারে খুন হন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাবিশ্ব চমকে যায় নৃশংস সেই ঘটনায়। আর এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের কলকাঠি নাড়িয়েছিল এদেশেরই কিছু কুখ্যাত সন্তানরা। ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছিল স্বজাতি উপর তাঁর বিশ্বাসকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর সেই ঘৃণ্য খুনীদের বিচারকার্য শুরু হয়। ২০১০ সালে দীর্ঘ ১২ বছরের বিচার শেষে কার্যকর করা হয় ৫ আসামির দন্ডাদেশ। কিন্তু তাতেও দায়মোচন হয়নি। এখনো পলাতক আরো ৫ আসামী।

নূর চৌধুরী

“আমি হত্যাকরী নই, আমি নির্দোষ। ঐরাতে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। শেখ মুজিব যেভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনা করেছিলেন তার মেয়ে শেখ হাসিনাও একইভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। তাই বাংলাদেশে এখন আর ন্যায়বিচার আশা করা যায় না কানাডিয়ান সরকারের কাছে আমি সাহায্য চাই।”

একটি সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দন্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামী নূর চৌধুরী এভাবেই নিজের সাফাই গেয়েছেন। ১৫ আগস্ট তাহলে কোথায় ছিলেন তিনি? সে উত্তরে কখনো তিনি বলেছেন, তিনি নাকি সে রাতে নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। আবার কখনো কখনো গভীররাতে কোন এক শোভাযাত্রার টি-শার্ট তৈরিতে ব্যস্ত থাকার গল্প সাজিয়েছেন।

তার মতে জিয়াউর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকে সমর্থন করার কারণেই সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই তার দিকে আঙুল তুলেছে সরকার। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তাকে জিগ্যেস করা হয়, আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে, যা এ্যামেনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মতে সঠিক ছিলো। তারপরেও  কিসের ভিত্তিতে নিজেকে নির্দোষ বলছেন তিনি। প্রশ্নের সদ্যুত্তর পাওয়া না গেলেও তিনি বলেন, সাক্ষীদের উপর অত্যাচার করে তার বিরুদ্ধে বানোয়াট সাক্ষ্য বানানো হয়েছিল।

নূর চৌধুরী ও তার স্ত্রী ১৯৯৬ সালে কানাডা যাওয়ার পর সেদেশের সরকারের কাছে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেন। যদিও অরাজনৈতিক অপরাধের কারণে নূর চৌধুরী ও তার স্ত্রী ২০০২ সালে উদ্বাস্ত সুরক্ষা থেকে বাদ পড়েন। তবে নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়নি।

১৯৯৮ সালে নিম্ন আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে নূর চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। বাংলাদেশে ফিরলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতে পারে—এমন যুক্তি দেখিয়ে নূর চৌধুরী ‘প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের’ জন্য অনুরোধ করেছেন।

নূর চৌধুরী কানাডায় কিভাবে আছেন এবং প্রি-রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্টের আবেদন কী পর্যায়ে আছে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে কানাডার পক্ষ থেকে কোন তথ্য দেওয়া হচ্ছেনা বলে জুডিশিয়াল রিভিউয়ে আবেদন করা হয় । দেশটির উচ্চ আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করে বলছেন, কানাডা কর্তৃপক্ষ নূর চৌধুরীর বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য না দেওয়ায় যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই বাংলাদেশের আবেদন আবার বিবেচনা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে  অনুরোধ করা হয়েছে।

রাশেদ চৌধুরী

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরপরই ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাশেদ চৌধুরী জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। সেখান থেকে পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার সুযোগ পান।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধুর এ খুনিকে চাকরি থেকে অব্যহতি দিয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দেশে না ফিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় রাশেদ চৌধুরীকে। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত ১২ জন কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জনের রায় কার্যকর হলেও রাশেদ চৌধুরীসহ বিদেশে পলাতক অন্যদের দণ্ড কার্যকর হয়নি।

রাশেদ চৌধুরী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইন্টারপোল ২০০৯ সালে আমেরিকাকে একজন দণ্ডিত হত্যাকারীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য নিষেধ করে।

সরকার রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছে বেশ কয়েকবার। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর এই বিচারের কাগজপত্র চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

খন্দকার আবদুর রশিদ

খন্দকার আবদুর রশিদ একজন বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করলেও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি পদত্যাগ করেন।

ক্ষমতাধর এই খুনী ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী পথসভায় হাসতে হাসতে কয়েকবারই বঙ্গবন্ধুকে খুনের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদে বসেছিলেন বাংলাদেশের মীরজাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ। রশিদ ছিলেন মোশতাকের ঘনিষ্ট আত্মীয়।

তার গ্রামের বাড়ি চান্দিনার ছয়গড়িয়ায়। খন্দকার রশিদ বর্তমানে নিরুদ্দেশ। পৃথিবীর কোথায় তিনি লুকিয়ে আছেন সে নিয়ে কোন তথ্য এখন অবধি পাওয়া যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান রশিদ। তবে মেয়ে মেহনাজের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন।

কথিত আছে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে কর্নেল রশিদ জমির বিনিময়ে এবং লিবিয়া পাঠানোর নামে লোকজনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন। নির্বাচনের রাতেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।

পলাতক আসামি রশিদের চান্দিনার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার। ২০১৫ সালের ১৪ জুন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের তত্ত্বাবধানে উপজেলা প্রশাসন সরকারের নির্দেশনায় বাড়িসহ প্রায় সাত একর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর একই ভাবে রশিদের আরো এগারো একর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

মোসলেম উদ্দিন

মোসলেম উদ্দিন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একজন সক্রিয় আসামী। সে রাতে বাসায় গুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু যখন নিচে নামছিলেন সেই সময় সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেন মোসলেম উদ্দিন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন নরসিংদী জেলার শিবপুরের দত্তেরগাঁও এলাকায়। হত্যার দাগী আসামী হওয়া স্বত্তেও কোনো সরকারই মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং তার বাড়িতে বসানো হয়েছিলো পুলিশি নিরাপত্তা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হলে সরকার তার বাড়িসহ বেশকিছু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। একপর্যায়ে খুনি  মোসলেহ উদ্দিন গা ঢাকা দেন। সেইসাথে তার পরিবারের সদস্যরাও পালিয়ে যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, খুনি মোসলেহ উদ্দিন ভারতে অবস্থান করছেন এমন তথ্যপ্রমাণ ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। তাদের মতে বেশ কয়েকবছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের গোবরডাঙ্গার ঠাকুরনগর এলাকায় অবস্থান করছিলেন তিনি। যেখানে নাম পাল্টে তিনি পরিচিত ছিলেন আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎসক ডাক্তার দত্ত হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর অপর খুনী আবদুল মাজেদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো বলেও ধারণা করা হয়। জেলহত্যা মামলার আসামীও ছিলেন তিনি।

মেজর ডালিম

বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার আগেই দেশ ছাড়েন। ২০১০ সালে তাঁর নামে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়। যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যার স্বপক্ষে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করা হতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে মেজর ডালিম নামে বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়। যাদের মূলকাজ ছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকে যৌক্তিক বলে জনগণের সামনে তুলে ধরা। তাছাড়া সরকার বিরোধী উষ্কানিমূলক কথাও সেখানে প্রকাশ করা হতো।

ডালিমের আত্মজীবনীতে বলা হয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন পদে কয়েক দফা দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৫ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তবে তিনি কবে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তার উল্লেখ করা হয়নি।

২০০৯ সালে ডালিম কানাডায় গিয়েছিলেন বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে। এরপর কানাডা থেকে হংকং হয়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান বলে ধারণা করা হয়। তবে ডালিমের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য এখনো জানা যায়নি। গুঞ্জন আছে ২০১৫ সাল থেকে তিনি স্পেনে আছেন।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *