ফ্লাইট আইসি ৮১৪ হাইজ্যাকিং– এক মাসুদ আজহারের কাছে ভারতের পরাজয়1 min read
Reading Time: 5 minutes২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ – হিমালয়ের দেশে মনে রাখার মত এক মধুচন্দ্রিমা শেষে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী ফ্লাইটে রওনা দিলেন রুপিন কাটইয়াল ও রচনা কাটইয়াল। মাত্র ২/৩ সপ্তাহ আগেই ডিসেম্বরের ৩ তারিখে বিয়ে হল হরিয়ানার রুপিন ও রচনার। জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছে মাত্রই। ভেলরের ৭ বন্ধু এম.থুলাসি, এস.ধানাসেকারান, আর.পি.কান্নান, মুশতাক আহমেদ, আর.কুলাসেকারান, পেরুমাল ও সি.জি.প্রসাদ বাবু বের হয়েছিল উত্তর ভারত ঘুরতে, এই ঘোরাঘুরি করতে করতেই পৌছালেন কাঠমান্ডু। ক্রিসমাসের আগের দিন দিল্লিগামী ওই ফ্লাইটে উঠেন তারাও। কিন্ত ক্রিসমাস সে বছর ফ্লাইট আইসি- ৮১৪ এর যাত্রীদের জন্য আনন্দের বদলে বিভীষিকাই বয়ে আনল।
সেদিন আইসি ৮১৪ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে বিকেল ৪ টায় দিল্লির উদ্দেশে উড়াল দেয়। ১৭৬ জন যাত্রী ও ১৫ জন ক্রু ছিলেন ফ্লাইটে। ইন্ডিয়ান এয়ারস্পেসে প্রবেশের সাথে সাথেই ৫ জঙ্গি তাদের কাজ শুরু করে। মুখোশধারী একজন ককপিটের দিকে যান ও অন্য ৪ জন যাত্রীদের মাঝে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন। ককপিটে ক্যাপ্টেন দেবি শরণ কে প্লেন পশ্চিমে নিতে বলা হয়,নইলে বোমা মেরে পুরো প্লেন উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। আর এভাবেই হাইজ্যাকিং এর সুত্রপাত হল আইসি ৮১৪ তে।
আইসি ৮১৪ কেন ছিনতাই হল?
উত্তর একটাই – মাসুদ আজহারের জন্য। কিন্তু কে এই মাসুদ আজহার? বর্তমানে ভারতের প্রধান মাথাব্যথা এই মাসুদ আজহার। ২০০১ সালের লোকসভা হামলা, ২০১৬ সালে উরি ও পাঠানকোটের হামলা ও সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামার হামলা – সবকটি মাসুদ আজহার পরিচালিত জইশ-ই-মোহাম্মেদের কাজ। এখন ভারতের অন্যতম লক্ষ্য মাসুদ আজহার কে ধরা, অথচ একসময় সে ছিল তাদের হাতের মুঠোয়। আর মুঠো থেকে ফসকেছিল আইসি ৮১৪ ছিনতাই এর জন্যই।
শুরুটা ছিল কোথায়?
১৯৯৪ সালে তৎকালীন হরকাতুল মুজাহিদিন এর অপারেটিভ আজহার কাশ্মীরে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে প্রবেশ করেন। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে যান ভারতীয় পুলিশের হাতে। এরপর থেকে তার মুক্তির জন্য বিভিন্ন ভাবে জঙ্গিরা চেষ্টা করছিল। ১৯৯৫ এর জুলাই এ তারা ৬জন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে, আজহারের মুক্তির বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। কিন্ত তাদের দাবি অপূর্ণই থেকে যায়।
এরপর ১৯৯৮ এর দিকে ইউসুফ আজহার আব্দুল লতিফের সাথে যোগাযোগ করে আজহারের মুক্তির জন্য। জেল ভেঙ্গে বের করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টাও চালানো হয়। এরপর পরই হাইজ্যাকিং এর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৯৯ এর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় পাঁচ হাইজ্যাকার – ইব্রাহিম আতহার, সানি আহমেদ কাজি, শহিদ সাইয়েদ আকতার, জহুর ইব্রাহিম মিস্ত্রি ও শাকির দেখা করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে কাঠমান্ডু থেকে ছিনতাই হবে। এরপর দুই মাসের মাঝে লতিফ ৫ জঙ্গির জন্য নকল ভারতীয় পরিচয় তৈরি করে।
কালিম্পং থেকে গ্রেনেড ও রিভলভার সংগ্রহ করা হয়। এরপর ডিসেম্বরের ১৩ তে সবাই আবার কাঠমান্ডুর চিড়িয়াখানায় মিলিত হয়। এখানে মাস্টারমাইন্ড আতহার শেষ আলোচনা করেন তার পরিকল্পনা নিয়ে। এরপর ২৪ তারিখ এয়ারপোর্টে প্রথমে যান আতহার (গ্রেনেড ও রিভল্ভার নিয়ে),এরপরে একে একে অন্যরা যান। আতহার ও কাজি ছিলেন বিজনেস ক্লাসে ও অন্যরা ছিলেন এক্সিকিউটিভ ক্লাসে, ভিন্ন নামে।
আইসি ৮১৪ হাইজ্যাক্ড
২৪ ডিসেম্বর এ কি কি হল?
ফিরে যাওয়া যাক আবার শুরুতে। মুখোশধারী ক্যাপ্টেন শরণকে বলেন লখনৌ হয়ে লাহোরে যেতে। কিন্ত প্লেনে অতদুর যাবার মত জ্বালানি ছিল না। বাধ্য হয়ে তারা ক্যাপ্টেনের কথা শুনে রাজি হন অমৃতসরে নামতে। অন্যদিকে সরকারের কানে যখন ছিনতাই এর খবর যায় তখন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি প্লেনে, এবং প্রায় ২ ঘণ্টা পর্যন্ত তিনি কিছুই জানতেন না।
সরকারি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ থেকে বলা হচ্ছিল যেকোনভাবে হোক প্লেনের উড্ডয়ন ঠেকাতে। কিন্ত দেরি করা দেখে জঙ্গিদের সন্দেহ হয়। তাই তারা ক্যাপ্টেন কে বিমানবন্দর ছাড়তে বলেন। ক্যাপ্টেন না বললে হাইজ্যাকারদের একজন রুপিন কাটইয়াল কে ছুরিকাঘাত করেন। বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেন শরণ ৭.৪৫ এর দিকে যখন জ্বালানি ট্যাংকার রওনা দিল প্লেনের দিকে তখনি ফ্লাইট আইসি ৮১৪ ওড়ানো শুরু করেন। এরপর তারা রওনা দেয় লাহোর এয়ারপোর্টের দিকে। কিন্ত লাহোর বিমানবন্দর থেকে অবতরনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না,এমনকি তারা রানওয়ের আলো বন্ধ করে দেয়। কিন্ত পরে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে আসলেও বিমানটির অবতরণ করা খুবই প্রয়োজন।
তারা অনুমতি দেন ও জ্বালানির ব্যবস্থা করেন। ক্যাপ্টেন পাকিস্তানি সরকারের কাছে কিছু যাত্রী নামানোর অনুরোধ করলেও ভারত-পাকিস্তানের কূটনৈতিক ঝামেলার জন্য তারা রাজি হয়নি। আড়াই ঘণ্টার মত ছিল তারা লাহোর বিমানবন্দরে।এরপর বিমান আবার উড়াল দিল। এবার গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল মিনহাত এয়ারবেস। সেখানে পৌছতে পৌছতে ক্রিসমাস এর দিন চলে আসলো।
২৫ ডিসেম্বরে কি কি হল?
দুবাই এর এয়ারবেস এ যাওয়ার পর হাইজ্যাকাররা ২৭ জন যাত্রী কে ছেড়ে দেয়। এর সাথে সাথে রুপিন কাটয়াল এর মৃতদেহ দেওয়া হয়। ছুরিকাঘাতের কারণে ও চিকিৎসার অভাবে দুবাই পৌছনোর আগেই মারা যায় ২৫ বছরের সদ্য বিবাহিত রুপিন। আমিরাতের সরকার ভারতের কমান্ডো অভিযানের অনুরোধ প্রত্যাখান করে। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে যখন যাত্রীদের নিয়ে বিশেষ বিমান পৌছাল তখন অপেক্ষারত স্বজনদের মাঝে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। এদিকে দুবাই থেকে আইসি ৮১৪ উড়াল দেয় আফগানিস্তানের কান্দাহারের উদ্দেশে।
কান্দাহারে কি ঘটলো?
কান্দাহারে পৌছনোর পর তালেবানরা ভারত ও হাইজ্যাকারদের মাঝে মধ্যস্ততাকারির ভুমিকা নেয়। ২৭ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জশবন্ত সিং কান্দাহারে যান। ভারতের পক্ষে মধ্যস্ততা করছিল বিবেক কাতজু, অজিত দোভাল ও সিডি সাহাই, তারা চাইছিলেন ইন্ডিয়ান কমান্ডো দ্বারা উদ্ধার অভিযান চালাতে, কিন্ত তালেবানরা তা প্রত্যাখান করে। তখন তালেবান কমান্ডোদের দিয়ে করানোর কথা বললে তালেবানরা বলে যে তাদের টেকনিক্যাল দক্ষতা কম তাই সম্ভব না। যদিও ভারত ভেবেছিল যে তালেবানরা তাদের পক্ষে, কিন্ত কমান্ডো অভিযানের কথা বলতেই তালেবানরা বিমান ঘিরে অবস্থান নেয়। এরইমধ্যে ভারতের দিক থেকে হাইজ্যাকারদের দাবি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়,যার মধ্যে ছিলঃ মাওলানা মাসুদ আজহার,মুস্তাক আহমেদ জারগার ও আহমেদ ওমর সাইদের মুক্তি।
এরপর ৩১ দিসেম্বর,১৯৯৯, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জশবন্ত সিং ও অজিত দোভাল(বর্তমান সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা) তিন জঙ্গিকে নিয়ে রওনা দেন কান্দাহারে। কথা অনুযায়ী যাত্রীদের ও ক্রুদের ছেড়ে দেয় হাইজ্যাকাররা। যদিও আইন অনুযায়ী হাইজ্যাকারদের ও জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল,কিন্তু তার বদলে তালেবানরা সবাইকে কোয়েট্টা সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে আসে। আর বিশেষ বিমানে করে ফ্লাইট আইসি ৮১৪ এর যাত্রীরা ও ক্রু রা ভারতে ফিরে আসে।
বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর কাঠমান্ডুতে বিশাল নেটওয়ার্ক ছিল,কিন্তু এরপর ও সঠিক সময়ে তারা ছিনতাই এর ব্যাপারে কোন খবর পায়নি। শুধু তাই নয়,প্রথম যখন হাইজ্যাক এর খবর সরকারের কানে যায়, তখন তারা ত্বরিত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি,যা তাদের সমস্যাকেই বাড়িয়েছে। অমৃতসরে যখন প্রথম বিমান নামে তখন স্থানীয় পুলিশের কাছে সিদ্ধান্ত পৌছতে দেরি হয়েছে। পাঞ্জাবের কমান্ডো ফোর্সকে কোন কাজেই লাগানো হয়নি। এনএসজির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শেষ পর্যন্ত কিছু করতেই সক্ষম হয়নি ভারত।
ভারতের জন্য এখনো এ ছিনতাই গলার কাঁটা হয়েই রয়েছে। কারণ এর কারণেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল মাওলানা মাসুদ আজহারকে। যার ফল এখনো ভোগ করছে ভারত। তেমনি এ হাইজ্যাক এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে ওই ফ্লাইটের সবার মনে। রুপিন কাটয়াল এর পরিবারের মনে এখনো দগদগে হয়ে আছে ঘা। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার অনিল জাগিয়া ছেড়ে দিয়েছে বিমানের চাকরি। অবাক হয়ে এখনো তারা ভাবে কখনো কি ভেবেছিল একবিংশ শতাব্দির শুরুটা এভাবে হবে?