ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বয়কট : কারণ ও প্রভাব1 min read
Reading Time: 3 minutesঘটনার সূত্রপাত বেশ আগে থেকেই। প্রথম দফায় বছর দুয়েক আগে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অযুহাতে বেশ কিছু তারকা ফেসবুক থেকে বিদায় নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এছাড়া আরো বড় অভিযোগ ছিল সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম বড় এই মাধ্যম বিভিন্ন ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জেরে এই অভিযোগ অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে।
প্রতিবাদের মূলে কারা
ফেসবুকের বিরুদ্ধে এবারের অভিযোগ বড় আকারে আসার মূল কারণ, সম্প্রতি এই প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছে বেশ বড় কিছু নাম। বিগত সপ্তাহে এইচপি, ফোর্ড, অ্যাডিডাস, ভক্সওয়াগন, সনির মত নামী কিছু কোম্পানি ফেইসবুকে নিজেদের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেনা মর্মে বিবৃতি দিয়েছে। জুনের ১৭ তারিখ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, যার মাঝে মানবাধিকার সংস্থা ‘এনএএসিপি’ (NACP) এবং কালার অফ চেইঞ্জ অন্তর্ভুক্ত, তারা “Hit Pause on Hate” ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিভিন্ন নামী কোম্পানিকে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে এক মঞ্চে আনতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু ফেইসবুকের আয়ের বড় অংশ বিজ্ঞাপন ঘিরেই পরিচালিত, তাই আন্দোলনকারীরা মূলত ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বন্ধের ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়েছে। কেবল গত বছরেই ফেইসবুক ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে।
“স্টপ হেইট ফর প্রফিট” নামে পরিচালিত এই ক্যাম্পেইনের ওয়েবসাইটে বলা হয়, “আসুন ফেইসবুককে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়া যাক।” ইতিমধ্যে এই ক্যাম্পেইন বিভিন্ন ব্র্যান্ডকে আন্দোলনের মধ্যে মঞ্চে যুক্ত করতে পেরেছে। যার মাঝে আছে কাপড়ের ব্র্যান্ড দ্য নর্থ ফেইস, ভোগ্যপণ্য কোম্পানি ইউনিলিভার, টেলিকম প্রতিষ্ঠান ভেরিজোন। চলতি সপ্তাহে সনি, কালারস, অ্যাডিডাস, ফোর্ড, ডেনি’স, ভক্সওয়াগন এই ক্যাম্পাইনে যুক্ত হয়ে ফেইসবুক বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ই-মার্কেট বিশেষজ্ঞ ডেব্রা আও উইলিয়ামসনেএ মতে, “এটা নিশ্চিতভাবেই আরো বড় হবে। আমার মনে হয়না আমি ফেইসবুকের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ দেখেছি।”
ফেইসবুক কতটা সংকটে?
প্রশ্ন আসছে এই বয়কট কি ফেসবুকের ক্ষতি করতে পারে? সহজ এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে ‘হ্যাঁ’। কারণ ফেসবুকের মোট আয়ের একটা বিরাট অংশ বিজ্ঞাপন থেকে আসে। এভাইভা ইনভেস্টরস এর ডেভিড কামিং বিবিসিকে দেয়া তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফেসবুকের ব্যাপারে এই যে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং তাদের কোনো নৈতিক অবস্থান নেই বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সেটা তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে।
গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ে গেছে প্রায় ৮ শতাংশ। এর ফলে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী এবং মার্ক জাকারবার্গের সম্পদ অন্তত ৬ বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড কমে গেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি আরও বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে কিনা কিংবা ফেসবুকের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে কিনা সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
অবশ্য কোন সামাজিক মাধ্যমের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৭ সালে বেশ কিছু নামী ব্র্যান্ড এবং কোম্পানি ঘোষণা করেছিল যে তারা ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করবে। কারণ এই বিজ্ঞাপনগুলো বর্ণবাদী এবং সমকামী বিদ্বেষী ভিডিওর পাশে দেখানো হচ্ছিল।
সেই বয়কটের ঘটনা এখন সবাই ভুলে গেলেও সে সময় এর বড় প্রভাব পড়েছিল ইউটিউবের নীতি নির্ধারকদের মাঝে। সেই ঘটনার পর ইউটিউব তার বিজ্ঞাপন নীতিমালায় অনেক পরিবর্তন এনেছে। তিন বছর পর ইউটিবের মূল কোম্পানি গুগল এখন বেশ ভালোই ব্যবসা করছে। ফেসবুকের ক্ষেত্রেও বয়কট যে সেরকম বড় কোন ক্ষতির কারণ হবে না সেটা বিশ্বাস করার অন্য অনেক কারণ আছে।
আন্দোলনের দাবিদাওয়া
আন্দোলনকারীরা ফেসবুকের সামনে যেসব দাবি পেশ করেছেন-
১।একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করা, যার মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি কোম্পানির পণ্য এবং বিদ্বেষমূলক ও পক্ষপাতী আচরণের নিয়মনীতি নিয়ে কাজ করবেন।
২।স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের দ্বারা নিয়মিত অডিট পরিচালিত হবে। যার লক্ষ্য ভুল তথ্য এবং বিষেদগার চিহ্নিত করা। এবং এই ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করা হবে।
৩।কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন যদি ফেসবুকের নিয়ম ভঙ্গ করার কারণে সরিয়ে ফেলা হয় তাহলে তা প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করে এর মূল্য ফেরত দিতে হবে।
৪।শ্বেতাঙ্গ প্রধান, সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা, ইহুদি বিদ্বেষ, সহিংসতামূলক বিতর্ক, ভ্যাক্সিনের ভুল তথ্য প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার সংক্রান্ত কোন ফেসবুক গ্রুপ থাকলে তা খুঁজে বের করা এবং সরিয়ে ফেলা।
৫।বিদ্বেষপূর্ণ বিষয় মোকাবেলার জন্য নতুন নিয়মনীতি গ্রহণ করা।
৬।ভুল তথ্য, ব্যবহারকারীর প্রতি ষড়যন্ত্র এবং বিদ্বেষপূর্ণ গ্রুপের পরামর্শ এবং সম্প্রসারণ বন্ধ করা
৭।যারা বিদ্বেষের কিংবা হয়রানির শিকার হবে ফেসবুকের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম সৃষ্টি করা।
ফেসবুক কেন হুমকির মুখে না
প্রথমত, অনেক কোম্পানি মাত্র এক মাসের জন্য ফেসবুক বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফেসবুকের বিজ্ঞাপন রাজস্বের বেশিরভাগটাই আসে হাজার হাজার ছোট বা মাঝারি আকারের ব্যবসা থেকে। যা মোট আয়ের ৯৪ শতাংশ এবং বিজ্ঞাপন ভিত্তিক আয়ের ৯৮ শতাংশ।
সিএনএনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যারা বিজ্ঞাপনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে এমন ১০০ টি ব্র্যান্ড থেকে ফেসবুকের আয় ৪.২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ফেসবুকের মোট আয়ের মাত্র ৬ শতাংশ। আর এখানে এটাও বলা দরকার, বেশিরভাগ মাঝারি কোম্পানি এখনো পর্যন্ত ফেসবুক বয়কটের ডাকে সাড়া দেয়নি।
একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিজিটাল হুইস্কির হেড অফ স্ট্রাটেজি ম্যাট মরিসন বলেন, অনেক মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে যারা আসলে ফেসবুক বিজ্ঞাপন না দেয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। তার যুক্তি, এই মাঝারি বা ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বড় টেলিভিশন নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দেয়ার সাধ্য নেই। তারা ফেসবুকের মত প্লাটফর্মে অনেক কম খরচে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। ম্যাট মরিসন বলছেন, একমাত্র ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে এরকম টার্গেটেড বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই এইসব ব্যবসা আসলে টিকে থাকে।
ফেসবুক কি বলছে?
একথা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত ফেসবুক এ ব্যপারে কাজ শুরু করেছে। কোম্পানিটি এরইমাঝে তাদের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেইল করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের দাবী, এই মেইলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেবার অঙ্গীকার করেছে। গত শুক্রবার জাকারবার্গ ঘোষণা দেন, ফেসবুক সকল ঘৃণা ছড়ানো বিজ্ঞাপন এবং ভুল তথ্য সমৃদ্ধ পোস্ট মুছে দেয়ার ব্যাপারে নিজেদের নীতিমালা আবার সংস্কার করতে যাচ্ছে। এছাড়া বিদ্বেষপূর্ণ পোস্টে ফেসবুক সতর্কবার্তা পাঠাবে বলেও জানিয়েছেন জাকারবার্গ।
আজ থেকে ৩০০ বছর আগে দাস প্রথার বিলোপ ঘটাতে ব্রিটেনের লোকেরা দাসদের কাছ থেকে পণ্য কেনা বয়কট করেছিলেন। তাতে বেশ সুফলও মিলেছিল। তবে বর্তমান এই সময়ে ফেসবুকের মত বড় আর অবিচ্ছেদ্য মঞ্চে ইতিহাস আবার ফিরবে কিনা তা নিয়ে আছে সংশয়। কিন্তু একথা সত্য, নতুন এই বয়কটে ফেসবুক একেবারে বিধ্বস্ত না হলেও বড় রকমের শঙ্কার মুখে আছে।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ