পয়লা বৈশাখ শুধু কি বাঙ্গালীর উৎসব?1 min read
Reading Time: 5 minutes“বৈশাখের প্রথম জলে, আশুধান দ্বিগুণ ফলে”
“ শুনরে বেটা চাষার পো, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে হলুদ রো”
“ চৈত্রেতে থর থর
বৈশাখেতে ঝড় পাথর
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে
তবে জানবে বর্ষা বটে। ”
“ চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে কর পরিপাটি। ”
সেই কতকাল আগে খনা বৈশাখ নিয়ে কত শত শ্লোক বলে গেছেন। এ থেকেই বোঝা যায় বৈশাখ কতটা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত বাঙ্গালীর জীবনে। আগে যা জীবনযাত্রার সাথে জড়িত ছিল, তা এখন শুধুই উৎযাপন। কিন্ত তাতেও এতটুকুও কি কমেছে এর আবেদন? মনে তো হয় না। বিগত বছরগুলোতে বৈশাখের উৎযাপন দেখে বোঝা যায় এই উৎসব বাঙ্গালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। তবে জানেন কি, পহেলা বৈশাখ কিন্ত শুধু বাঙ্গালিই পালন করে না। পৃথিবীতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কটি দেশেও কিন্ত ঘটা করে পালন করা হয় পয়লা বৈশাখ, হয়ত ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে।
পয়লা বৈশাখ
পুরো বিশ্ব যখন জানুয়ারিতে নববর্ষ উৎযাপন করে বাঙ্গালি তখন অপেক্ষা করে বৈশাখের, ১৪ এপ্রিলের। প্রতিবারের মত এবারো রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশ সাজবে উৎসবের রঙে। নতুন বছরের নতুন সূর্যকে সম্মিলিত কণ্ঠের গানে আমন্ত্রণ জানাবে ছায়ানটের শিল্পীরা৷ রমনার বটমূল মুখর হয়ে উঠবে “এসো হে বৈশাখ গানে”। মংগল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেনী পেশার মানুষ। এটিই সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেক্যুলার উৎসব।
পয়লা বৈশাখের অন্যতম একটি অনুষ্টান হল ‘হালখাতা’। গ্রামে গঞ্জে এখনো এর কিছুটা বিদ্যমান। এদিন ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব কিতাব চুকিয়ে নতুন হিসাব শুরু করে। এ উপলক্ষে মিষ্টান্ন বিতরণ এমনকি মিলাদও দেয়া হয়।
পান্তা ইলিশ ইদানিং কালে বৈশাখের যেন অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। যদিও ইলিশ- পান্তার সাথে বৈশাখের কি সম্পর্ক এ ব্যাপারে নেই তেমন কোন ইতিহাস। তবুও ট্রেন্ড বলে কথা!
পয়লা বৈশাখ এলো কি করে?
সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য যে ইতিহাস তা বলে মোগল সাম্রাজ্যের সময় থেকে শুরু হয় এই বৈশাখের প্রথম দিনের গুরুত্ব। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬ থেকে ১৬০৯) সারা রাজ্যে কর নেয়া হতো। সেসময় তৎকালীন হিন্দুস্তান সম্পূর্ণরূপে কৃষি কাজের উপর নির্ভর ছিল। আরবী মাস অনুযায়ী ফসল তোলা বা লাগানো হিসাব করা কঠিন হয়ে পড়লে সম্রাট আকবর নতুন ক্যালেন্ডার তৈরীর আদেশ দেন। তৈরী হয় বাঙলা ক্যালেন্ডার। এই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনই পয়লা বৈশাখ। এই ক্যালেন্ডার অনুসারেই নেয়া হয় কর।
তা, যা বলছিলাম অন্য জাতি বা দেশে পয়লা বৈশাখ উৎযাপন নিয়ে। শুধু এই বাংলায়ই ঘটা করে বৈশাখ উৎযাপন করা হয় তা কিন্ত না। ওপার বাংলায়ও বাংলা নববর্ষ হিসেবে বৈশাখের প্রথম দিন পালন করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বৈশাখ
পশ্চিম বঙ্গে বাংলা নববর্ষ পালিত হয় এক দিন পর, অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল। বাংলার গ্রাম জীবন আর শহুরে জীবন কিছুটা হলেও এদিন এক সারিতে চলে আসে। আমাদের দেশে নববর্ষ শুধুই একটি উৎসব হলেও ওপারে কিছুটা ধর্মীয় রীতিনীতিও জড়িত। চৈত্র মাস থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্রের শেষের দিনে শিবের উপাসনা করা হয়। এই দিন সূর্য মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে চলে যায়। গ্রামে গঞ্জে আয়োজিত হয় চড়ক পূজা। অনেক পরিবারই এদিন খাবার দাবারে কিছু বিধিনিষেধ মানেন, যেমন বছরের প্রথম দিন তিতা ও টক খাওয়া যাবে না। হালখাতা সে দেশের পালিত হয় বরং আরো বেশি আড়ম্বড়ে। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এদিন সবচেয়ে বেশি ভীড় হয়ে থাকে। শুধু কালীঘাট নয় অন্যান্য যত বড় বড় মন্দির আছে যেমন দক্ষিণেশ্বরের কালি বাড়ি মন্দির, সব মন্দিরেই মানুষ কল্যাণ কামনা করে পূজো দিতে যায়।
আসামের রাঙ্গোলি বিহু
ভারতের কৃষিপ্রধান রাজ্য আসামে বৈশাখের প্রথম দিন থেকে ৭ম দিন পর্যন্ত পালন করা হয় রাঙ্গোলি বিহু বা ব’হাগ বিহু। ব’হাগ হল আসামীজ ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস যা আমরা বৈশাখ বলি। আসামের তিনটি বিহুর (রাঙ্গোলি, মাঘ এবং কাটি বিহু) মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল রাঙ্গোলি বিহু। সাতদিন ধরে চলা এই উৎসবের একেকদিনের তাৎপর্য একেকরকম।
বিহুর প্রথম দিন উৎসর্গ করা হয় গৃহস্থালি প্রানীদের উদ্দেশ্য। এদিন সকল গৃহস্থালি গবাদি পশুকে নদীতে নিয়ে গিয়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হয়, তাদের পুরাতন রশি কেটে দিয়ে নতুন রশি দেয়া হয়। এদিন কোন গৃহস্থালি পশু পাখিকে আটকে রাখা হয় না। এই দিনটি মূলত আসামীজ পরিবারে এবং কৃষি কাজে তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
দ্বিতীয় দিন মানুষের বিহু। ওইদিন সবাই আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভাল খাওয়াদাওয়া করে।
তৃতীয় দিন ইশ্বরের বিহু। গৃহস্থালি দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখতে পূজা করা হয়।
রাঙ্গোলি বিহু খুবই রঙ্গীন একটি উৎসব। সবদিকে রঙের ছড়াছড়ি। এদিন নিজেদের বোনা মুগা সিল্ক এর কাপড় পড়ে বিহু নাচ ও গান করা হয়।
উড়িষ্যার পানা সংক্রান্তি
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে বৈশাখের প্রথম দিনটিকে পানা সংক্রান্তি বলা হয়। অনেক জায়গায় একে মহা বিষুভা সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। পানা হল উড়িষ্যার একটি ঐতিহ্যবাহি পানীয়। এদিক একটি মাটির পাত্রে পানা অর্থাৎ মিসরি মিশ্রিত মিষ্টি পানি নিয়ে পাত্রটিকে তুলসী গাছের উপরে বেঁধে রাখা হয়। পাত্রের নিচের ফুটো দিয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়লে একে বৃষ্টির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এদিন হিন্দু দেবতা হনুমানের জন্মদিন হিসেবেও ধরা হয়।
আর সব নববর্ষের মতই উড়িষ্যায় এ দিনটি মহাসমারোহে পালন করা হয়। নতুন জামা কাপড় পড়ে গৃহস্থরা দেবতার কাছে উন্নতি ও ফসলের বর চায়। সকলের মঙ্গল কামনায় উৎযাপন করা হয় নববর্ষ।
কেরালার বিষু উৎসব
এপ্রিলের ১৪ তারিখে পালন করা নববর্ষ বা বিষু উৎসব কেরালাবাসী মালায়লাম সম্প্রদায়ের বড় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। চাষবাষের উৎসব ওনাম পালনের পরপরই ফসল ঘরে তোলার উৎসব বিষু। পুরো রাজ্য জুড়ে চলে নতুন জামা কাপড়, খাবার আর পূজা-প্রার্থণার ঢল।
কেরালাতে কৃষ্ণ দেবতাকে এই দিন পুজা করা হয়। বাড়ির পুজা খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়। নানারকম ফল, খাদ্য, পোশাক আর সোনার ভেট দেয়া হয় কৃষ্ণকে। একে বলে ভিষুকানি প্রথা। এর পর সবাই স্নান করে মন্দিরে যায়। এদিন সবাই ‘কোড়ি বাস্ত্রাম’ পড়ে। এই পোশাক শুধুমাত্র স্পেশাল ও পবিত্র দিনগুলোতেই পড়া হয়। নেচে গেয়ে আত্মীয় স্বজন আর বান্ধব নিয়ে মালায়লিরা এই দিনটিকে পালন করে থাকে।
পাঞ্জাবের বৈশাখি
আর সব কৃষিপ্রধান রাজ্যের মতই পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতেও বছরের প্রথম দিনটি ফসলের প্রাচুর্য কামনা করে উৎযাপন করা হয়। এদিন অনেকটা থ্যাংকস গিভিং এর মত। সারা বছরের ফসল উৎপাদমের জন্য কৃষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদান।
দিনের শুরুতে স্নান করে পবিত্র হয়ে শিখদের পবিত্র স্থান গুরুদুয়ারায় মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করে উৎসব শুরু হয়। পাঞ্জাবি-কুর্তা আর পাগড়ি মাথায় ছেলেরা আর নতুন জামায় মেয়েরা এদিন উপহার আদান প্রদান করে থাকে। বৈশাখি মেলায় জনসমাগম ঘটে সব ধরণের মানুষের। ছেলে বুড়ো সবাই পাঞ্জাবের ঐতিহ্যবাহি নাচ ভাংড়া আর গিদ্দা নেচে। আর দিনের শেষে নতুন বছরের সমৃদ্ধি কামনা করে শেষ হয় এই উৎসব।
শ্রীলঙ্কার আলুথ আভুরুদু
শ্রীলঙ্কার সিংহলিজ এবং তামিল দু’সম্প্রদায়ই এপ্রিলের ১৪ তারিখ নববর্ষ উৎযাপন করে। শ্রীলঙ্কানরা রাশিতে বিশ্বাসী তাই তারা মানে যে সূর্য বছরের ১২ মাস ধরে ১২ টি রাশি পরিভ্রমণ করে। এবং বছরের প্রথম মাসে মীন থেকে মেষে আসে।
পুরো দ্বীপের মানুষ নতুন বছরকে বরণ করতে ঘরদোর পরিষ্কার থেকে শুরু করে বাজার-সদাই, এমনকি দ্বীপের সংস্কারও করে থাকে।
শ্রীলঙ্কানরা নানা রকম সংস্কারে বিশ্বাসী। তারা জ্যোতিষ বিদ্যা মেনে চলে বিধায় নববর্ষের সাথে অনেক অনেক ধর্মীয় রীতিনীতিও পালন করতে হয়। প্রতিটি আচার পালনের সময় মন্দির থেকে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘন্টা হেউইসি বাজিয়ে জানান দেয়া হয়।
নেপালের নেপাল সাম্বাত
জানেন নেপালে এখন কত সাল? ২০৭৬ সাল!! অবাক হচ্ছেন? নেপাল তার নিজস্ব ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে যার অনুযায়ী এখন ২০৭৬সাল। তাদের বিক্রম সাম্বাত নামক একটি প্রাচীন ক্যালেন্ডার রয়েছে যা সাধারণ ক্যালেন্ডার থেকে ৫৬ বছর ৮ মাস এগিয়ে রয়েছে!
এই সুযোগে একটু আজব তথ্যও জানিয়ে রাখি। নেপালের রয়েছে নিজস্ব টাইম জোন। যা জিএমটির স্ট্যান্ডার্ড টাইম থেকে ৫ ঘন্টা ৪৫ মিনিট এগিয়ে!
যাই হোক, আর বাকি এশিয়ান দেশগুলোর মতোই নেপালও আনন্দ উদ্দীপনা আর উৎসবের মতোই ওই দিনটি পালন করে থাকে।
আরো অনেক দেশ যেমন বার্মা, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড এবং বিভিন্ন জাতি যেমন মৈথিলীরাও এ সময় নববর্ষ পালন করে থাকে নিজের প্রথা অনুযায়ী। রঙ, রূপ আর বাহ্যিক চাকচিক্যতায় যতই পার্থক্য থাক না কে সবার একটাই আশা-পুরোনো বছরের সব কিছু ভুলে নতুন বছরের দিকে স্বপ্ন, আশা আর সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।