প্রোজেক্ট A119: চাঁদ ধ্বংসের পরিকল্পনা ছিল আমেরিকার1 min read
Reading Time: 4 minutesপ্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ। পেরিয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। স্নায়ুযুদ্ধের সবে শুরু। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুই প্রতাপশালী রাষ্ট্র নতুন আবিষ্কার ও গবেষণায় হারিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে।
১৯৫৭ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক–১’ পাঠিয়ে দিলো মহাকাশে। যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধে একচাল হারলে কী হবে , ’৫৮ এর জানুয়ারিতেই তারা উৎক্ষেপণ করলো স্যাটেলাইট ‘এক্সপ্লোরার–১’। তবে এই স্যাটেলাইটের দোলাচলের বাইরেও ধীরে ধীরে অন্যদিকে এগুচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদকে একেবারে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিল তাদের। আর সেটাই হলো প্রোজেক্টঃ A119.
নেপথ্যের কথা
প্রজেক্টঃ 1119 এর মূলে স্নায়ুযুদ্ধ থাকলেও এ নিয়ে খুব একটা প্রকাশ্যে আসেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৯ সাল থেকেই পারমাণবিক বোমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে ‘অস্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ পুরোদমে গবেষণা শুরু করে । যুক্তরাষ্ট্রের চার জায়গায় বিপুল পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্রাদি জমাও রাখা হয়।
১৯৫৭ সালে বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলার নতুন প্রস্তাবনা নিয়ে আসেন। পৃথিবীতে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা সম্পর্কে তো বিস্তর জ্ঞান আহরণ হলো, হিরোশিমা– নাগাসাকিতেও সফল পরীক্ষা চালানো হলো; কিন্তু মহাকাশে এর প্রভাব কী? টেলারের মূল পরিকল্পনা ছিল দুটো বোমা বিস্ফোরণের– একটি চাঁদের বুকে, আরেকটি তার কাছাকাছি কোন স্থানে। তবে হ্যাঁ, মূল প্রস্তাব টেলারের কাছ থেকে এলেও এর পেছনে ছিল বিজ্ঞানীদের গোটা একটা দল।
পরিকল্পনার শুরু
বছরের শেষভাগে গুজব ওঠে, সোভিয়েত ইউনিয়নও একই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এর সাথে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীও। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। মহাশূন্যে তথা চাঁদে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে একদিকে যেমন বিজ্ঞানের এক দ্বার উন্মুক্ত হবে তেমনি সোভিয়েত রাষ্ট্রকেও আমেরিকার ক্ষমতা সম্পর্কে কড়া জবাব দেয়া যাবে।
এই দলে কাজ করছিল শিকাগোর ‘ইলিওনয় ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র ১০ জন মেধাবী বিজ্ঞানী, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন পদার্থবিদ লিওনার্দ রেইফিল। তিনি ১৯৫৩ সালে এই ইলিওনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। নাসাসহ বিভিন্ন স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করায় অভিজ্ঞ তিনি।
এই দলের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ২৪ বছর বয়সী গণিতবিদ কার্ল সাগান। গাণিতিক ভাবে সাগান দেখিয়েছিলেন চাঁদে বিস্ফোরণ ঘটলে ‘মাশরুম ক্লাউড’ বা মেঘের আকার–আয়তন কতটুকু হবে।
পিছিয়ে যাওয়া
গবেষক দলের পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫৯ সালেই হওয়ার কথা ছিল এই অভিনব ঘটনার। কিন্তু ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতেই ভেস্তে যায় সব। জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য ভয়ানক পরিণতির কথা ভেবেই বাদ দেয়া হয় একে। বিজ্ঞানীরা জানান, চাঁদে বিস্ফোরণ হওয়ার ফলে এর কিছু টুকরো বা গোটা চাঁদটাই পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে পারে; যার ফল হবে মারাত্মক।
তবে আমেরিকা হতোদ্যম হয়নি। পুরো দলকে ঢেলে সাজানো হয় চাঁদে ভ্রমণের জন্য। যার ফলে ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখেন।
শান্তিচুক্তিতে চাঁদ
চন্দ্রজয়ের আগেভাগে অবশ্য নিষ্পত্তি হয় এই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের। ১৯৬৩ সালে ‘ Partial Nuclear Test Ban Treaty’ তে স্বাক্ষর করে সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকা। ১৯৬৭ সালে ‘Outer Space Treaty’ তে এরা স্বাক্ষর করে জানিয়ে দেয়, ভবিষ্যতে মহাকাশে কোন ধ্বাংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাবেনা তারা। পরবর্তীতে এই চুক্তিগুলোকে একত্রে ‘Set of laws governing outer space’ বলে ধরা হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১০৭ টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে।
প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র
এই প্রোজেক্টের দলিল ও অস্তিত্বের ব্যাপারটি জনসম্মুখে আসে ১৯৯৯ সালে কার্ল সাগানের উপর লেখা জীবনীতে। রেইফিলই সাগানকে এই দলে যুক্ত করেছিলেন। মিডিয়ার সামনে আসার পর রেইফিল ১৯৫৮ সালের মে মাসের একটি রিপোর্ট এবং ১৯৫৯ সালের একটি ফিজিবিলিটি রিপোর্টসহ মোট আটটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এই রিপোর্টের মূল কপিগুলো ১৯৮৭ সালে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল।
তবে ২০০০ সালে মার্কিন পদার্থবিদ লিওনার্দ রেইফিল এগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান। রেইফিল দ্য অবজারভারের কাছে জানান, ‘ প্রোজেক্টঃA119 যে অত্যন্ত গোপনীয় সেটা আমরা সবাই জানতাম। যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে বিমান বাহিনীর কাছে যেতে হতো। তবে কার্ল সাগান ১৯৫৯ সালে কিছু তথ্য পাচারের চেষ্টা করেছিল।‘
তিনি আরও জানান, ‘ গবেষণায় আমরা এতটাই নিবদ্ধ ছিলাম যে, জনতা কী ভাববে এই পরীক্ষা সম্পর্কে , একবারের জন্যও চিন্তা করিনি। তবে এটি বাতিল হওয়ায় ভালোই হয়েছে, নইলে বড়সড় একটা বিপর্যয় ঘটে যেতো। মার্কিন বিমানবাহিনী চাইছিল মহাকাশ থেকে মাশরুম মেঘের মাধ্যমে সোভিয়েতকে শো– ডাউন দেখাতে। কিন্তু পৃথিবীতে এর ভয়াবহ প্রভাবের বিষয়ে একটুও ভাবেনি তারা।‘
ব্রিটিশ পারমাণবিক ইতিহাসবিদ ডঃ ডেভিড লোরি বলেন, ‘ এটা চিন্তার বাইরে! একবার ভাবুন, যদি এই পরিকল্পনা সফল হতো তাহলে আমরা কোনদিনই চাঁদের বুকে নিল আর্মস্ট্রং এর সেই বিখ্যাত পদচিহ্নের ছবি পেতাম না।‘ তিনি আরও যোগ করেন, ‘ বর্তমানে আমেরিকা যেভাবে মিসাইল ডিফেন্স নিয়ে তৎপরতা দেখাচ্ছে সেটাও কিন্তু কম কিছু না। পঞ্চাশের দশকে চাঁদ উড়িয়ে দেবার মতো কিছু এখন হলেও অবাক হবোনা।‘
কী হতো পরিণতি?
‘A Study of Lunar Research Flights ‘নামক একটি গবেষণা পত্রে প্রকাশ পায় প্রোজেক্ট A119’ এর ইতিবৃত্ত। এতে বলা হয়, এই বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ছিল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, মিলিটারি ও রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন।
তবে এই পুরো গবেষণাই হয়েছিল তৎকালীন বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, পৃথিবী থেকে ৩,৮৪,৪০০ কিলোমিটার দূরের চাঁদে বিস্ফোরণ ঘটলে কি সত্যিই সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখতে পেতো?
গবেষণা ও রেইফিলের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জানা যায়, সোডিয়াম বাষ্প তৈরির মাধ্যমে খালি চোখে এর মাত্রা দেখানোর কথা ভেবেছিল গবেষক দল। এমনকি কতটুকু সোডিয়াম ব্যবহার করতে হবে, তাও হিসেব করা ছিল। তিন ভাগে ভাগ হয়ে চাঁদের মাটিতে বিস্ফোরণ ঘটতো। মূল অংশটি থাকতো চাঁদের অন্ধকার অংশে, একটি এর থেকে অল্প দূরে এবং আরেকটি থাকতো চাঁদের বাইরে–শুন্যে।
চাঁদে বেশ কিছু গর্ত বা ক্র্যাটার আছে। গবেষক দল মনে করেছিলেন এই বিস্ফোরণের ফলে চাঁদের অভ্যন্তরে কী আছে সেটা বেরিয়ে আসবে। তবে এর চাঁদের বায়ু এবং মাটিতে পাকাপাকিভাবে পারমাণবিক ক্ষতিরও শঙ্কা ছিল।
এছাড়াও কোন কারণে চাঁদ তার অক্ষ থেকে ছিটকেও আসতে পারতো। মহাকাশে পারমাণবিক বর্জ্য তথা ভয়াবহতা ক্ষতি করতে পারতো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তথা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাস নতুন নয়। এই যুদ্ধে যেমন অনেক আবিষ্কারও হচ্ছে তেমনি অসংখ্য নিরাপরাধ ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। এমন অস্থির সময়ে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসা ভীষণ জরুরি; ক্ষমতার জন্য নয়, মানবতার খাতিরে।