পেন্সিলের দুনিয়া1 min read
Reading Time: 5 minutesস্রেফ পেন্সিল দিয়েই তিন তিনটে লোককে ধরাশায়ী করেছিল জন উইক। সিনেমাবোদ্ধাদের এই গল্প তো জানাই। কিন্তু জানেন কি,শুধু ফিকশনে না ,সত্যি সত্যিই কিন্তু পেন্সিল দিয়ে মানুষ হত্যা হয়েছিল।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভড়কে গেছেন। শিরোনামে পেন্সিলের ইতিহাস, অথচ ব্যাখ্যায় হত্যাকাণ্ড! হাঁফ ছেড়ে বসুন। কারো মৃত্যুনামা নয় ,পেন্সিলের জীবনবৃত্তান্তই বলবো এখন।
পেন্সিলের পূর্বপুরুষ
পেন্সিল শব্দের উদ্ভব ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ ‘পেনিসিলাম’ থেকে। এর অর্থ ‘ছোট লেজ’। আদিকালে উটের লোম থেকে মোলায়েম তুলি বা ব্রাশ তৈরি হতো। সেই ব্রাশ দিয়েই আঁকা–লেখার কাজ চলতো। পেন্সিল পূর্ণ আকার পায় রোমানদের হাতে। মোম আবৃত তক্তায় বা কোডেক্সে (Codex) লেখার জন্য যে পেন্সিল ব্যবহৃত হতো সেগুলো ছিল ধাতুর তৈরি। রোমানরা একে স্টাইলাস বলে চিনতো। স্টাইলাস অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতো তাঁরা। টমাস আস্টেল তাঁর ‘The Origins and Progress of Writing’ –বইয়ে এই অস্ত্রের এক রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ভরা মজলিশে ক্যাসিয়াসকে এই স্টাইলাসের দ্বারাই হত্যা করেছিলেন। স্টাইলাসের ধাতব অংশকে বলা হতো প্লামেটস।
গ্রাফাইট আবিষ্কার
১৫৫০ সালে ইংল্যান্ডের কাম্বারল্যান্ডে অকস্মাৎই গ্রাফাইট আবিষ্কৃত হয়। স্থানীয় রাখালেরা হঠাৎ খেয়াল করলো কিছু গাছের নিচে কালো রঙের ছাই পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো ঠিক উড়েও যায় না বা পুড়েও না। তারা সেগুলোকে ভেড়ার গায়ে চিহ্ন দেয়ার কাজে ব্যবহার করা শুরু করলো। কিছুদিন পর সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপে গ্রাফাইটের বিশাল খনি পাওয়া যায়। মূলত এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আধুনিক পেন্সিলের উত্থান।
এর আগে লেখার কাজে চারকোল বা অন্য কালি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এতে সমস্যা ছিল, সেগুলো সহজে মোছা যেত না। কিন্তু এই গ্রাফাইটের কালি সহজেই মোছা সম্ভব। প্রথমদিকে এই পদার্থকে ওয়েড, সাদা সিসা, কালো সিসা, ব্লিউইস, গ্রাফিও পিওমবিনো, বিসমাথ, প্লুমবাগো নানা নামে ডাকা হতো।
চামড়া বা দড়িতে মুড়িয়ে লেখার কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে গ্রাফাইট। কিন্তু এতে ব্যবহারকারীর হাত, কাপড়ে প্রায়ই দাগ পড়ে যেতো।ঐতিহাসিক করনারড জেসনারের ‘Book on Fossil’ এ জানা যায়, আধুনিক স্টাইলাসের সিসা একদিকে তীক্ষ্ণধার করা হতো এবং একটা কাঠের হ্যান্ডেলে ঢোকানো হতো। হ্যান্ডেলহীন স্টাইলাস ব্যবহারে হাত–কাপড় যেমন নোংরা হতো তেমনি শক্তিও ব্যয় হতো প্রচুর।‘ অবশেষে ১৫৬০ সালে ইতালিয়ান দম্পতি সিমোনিও এবং লিন্ডিয়ানা বারনাকোত্তি কাঠের ফ্রেমে গ্রাফাইট মুড়ে বাজারজাত করেন। ফ্রেমটা ছিল গোলাকার আর তার মাঝেই আঠা দিয়ে জুড়ে দেয়া হতো গ্রাফাইট। ব্যস!
আধুনিক পেন্সিলের আগমন
১৬৬২ সালে জার্মানরা পেন্সিলকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। নুরেম বার্গের ক্যাসপার ফেবারের কারখানায় উৎপাদিত হতে থাকে কাঠের পেন্সিল । সেই ফেবার ক্যাসেলের জনপ্রিয়তা আজও তুঙ্গে।
১৭৯৫ সালে পেন্সিলে বৈচিত্র্য আনে ফরাসিরা। ফ্রেঞ্চ চিত্রশিল্পী নিকোলাস জ্যাকুয়েস কন্তেকে কম খরচায় পেন্সিল তৈরির নির্দেশ দেন নেপোলিয়ন। সেসময় দুই দেশে যুদ্ধ চলায় বৃটেন গ্রাফাইট রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। অল্প গ্রাফাইট, মাটি আর কাঠের গুড়ি দিয়ে মাত্র আটদিনে নতুন পেন্সিল উদ্ভাবন করলেন কন্তে।
১৮০২ সালে অস্ট্রিয়ার অধিবাসি জোসেফ হার্ডমুথের ‘কোহিনুর কোম্পানি‘ কিনে নেয় এই পেটেন্ট। নানান অনুপাতে মাটি ও গ্রাফাইট মিশিয়ে বিভিন্ন ধরণের পেন্সিল বানাতে থাকে তারা।
পেন্সিল যেখানে, শার্পনারও সেখানে। ১৮৪৭ সালে থিয়েরি দেস এস্টিভক্স শার্পনার আবিষ্কার করেন। আর হাইমেন লিপম্যান পেন্সিলে জুড়ে দেন ইরেজার বা রাবার।
আমেরিকার পেন্সিল যাত্রা
ব্রিটেন একসময় আমেরিকাতেও পেন্সিল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ১৮১২ সালে কেবিনেট প্রস্তুতকারক উইলিয়াম মনরো আমেরিকায় প্রথম কাঠ পেন্সিল তৈরি করেন। ১৮৪৭ সালে দ্য জোসেফ ডিক্সন কোম্পানি এই বাণিজ্যে পসার জমাতে থাকে। জার্সি শহরে বড়সড় কারখানা স্থাপন করে তাঁরা। যন্ত্রের সাহায্যে প্রতি মিনিটে ১৩২ টি পেন্সিল তৈরি করতো ডিক্সন কোম্পানি। ক্যালিফোর্নিয়ার সিডার গাছের কাঠই ছিল তাদের প্রথম পছন্দ। উনবিংশ শতকের শেষভাগে ফেবার-ক্যাসেল, এবারহার্ড ফেবার, ঈগল পেন্সিল কোম্পানি, জেনারেল পেন্সিল কোম্পানি কারখানা স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে পেন্সিলের কারখানা।
চমকপ্রদ কিছু তথ্য
১। বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বেশ প্রিয় এক সামগ্রী ছিল পেন্সিল। স্কেচ করতে প্রায়ই ব্যবহার করতেন।
২। ১৭২৯ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন পেনিসিল্ভানিয়া গেজেটে পেন্সিলের বিজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য নির্দেশ দেন।
৩। গৃহযুদ্ধের সময় সব ধরণের পরিকল্পনা করা হতো পেন্সিলে এঁকেই। সেনাবাহিনীতেও পেন্সিলকে গৌরবজনক বস্তু হিসেবে বিবেচিত হতো।
৪। টমাস আলভা এডিসন শুধু পেন্সিলের কথা মাথায় রেখেই বিশেষ পোশাক ডিজাইন করেছিলেন।
৫। বিখ্যাত লেখক জন স্টেইনবেক প্রতিদিন ৬০ টি পেন্সিল ব্যবহার করতেন। আরনেস্ট হেমিংওয়েও স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে পেন্সিলেই নোট রাখতেন।
৬। উনিশ শতকের গোড়ায় পেন্সিল উৎপাদনকারীরা কাঁচামালকে গুরুত্ব দিতেন। সিডার গাছের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাডায় পাড়ি জমাতেন তাঁরা।
৭। রাবার আবিষ্কারের পূর্বে লোকে বাসি রুটি দিয়ে পেন্সিলের দাগ মুছতো।
পেন্সিলের রকমফের
প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ ধরণের পেন্সিল ব্যবহার করা হয় গোটা দুনিয়াজুড়ে। এর মধ্যে আছে গ্রাফাইট পেন্সিল, সলিড গ্রাফাইট পেন্সিল, চারকোল পেন্সিল, কার্বন পেন্সিল, কালারড পেন্সিল, গ্রিজ পেন্সিল, ওয়াটার কালার পেন্সিল, কারপেন্টারস পেন্সিল, কপিং পেন্সিল, প্লাস্টিক পেন্সিল, নন ফটো ব্লু পেন্সিল, স্টেনোগ্রাফার পেন্সিল, পপ এ পয়েন্ট পেন্সিল, মেকানিক্যাল পেন্সিল, গলফ পেন্সিল, ইরেজেবল কালার পেন্সিল ইত্যাদি।
গ্রাফাইট স্কেল
2B or not 2B- That is the question. পেন্সিলের বেলাতেও এই প্রশ্ন চিরন্তন। 2B, HB এসব তো শোনা। কিন্তু এগুলোর মানে কী? চলুন জেনে নিই।
পেন্সিলের শিষ বা গ্রাফাইটের দৃঢ়তার পরিমাপে দুই ধরণের স্কেল ব্যবহৃত হয়। একটি হলো –নাম্বারভিত্তিক স্কেল, অপরটি HB গ্রাফাইট স্কেল। নাম্বারের ক্ষেত্রে সাধারণত 2,3,6 প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। যত বড় সংখ্যা, পেন্সিলের গ্রাফাইটও তত শক্ত। তবে শক্ত গ্রাফাইটে দাগ হয় হালকা। যত কম নাম্বার তত গাঢ় পেন্সিলের দাগ। অন্যদিকে HB স্কেলের H দ্বারা বোঝায় Hard pencil এবং B দিয়ে বোঝায় Blackness of pencil’s mark. এক্ষেত্রে HB মানে ‘দৃঢ় ও কালো’, ‘HH’ মানে ভীষণ দৃঢ় আর BBB অর্থ গাঢ় কালো। দুটো মিলিয়ে 2B, 4B এও দেখা যায়। এর মানে হচ্ছে 2B এর চাইতে 4B গাঢ় দাগ ফেলবে।
বর্তমান হালচাল
উনিশ শতকের শেষদিকে শুধু আমেরিকাতেই প্রতিদিন গড়ে ২,৪০,০০০ পেন্সিল ব্যবহৃত হতো। ডিক্সন কোম্পানি প্রতি বছর ১.৫ বিলিয়ন পেন্সিল উৎপাদন করে। আমেরিকায় প্রতি বছর পেন্সিল ব্যবহার বাড়ছে ৭% হারে।
জাপানিরাও কম যায় না। বিশ শতক থেকে পেন্সিল উৎপাদনে প্রতিযোগিতাই শুরু করে দিয়েছে তারা। টমবো আর মিতসুবিশি কোম্পানির হাত ধরে সেরা ম্যানের পেন্সিল পেয়েছে বিশ্ব। এর নির্মাণ শৈলীতে যত্নের পাশাপাশি শিল্পকেও প্রাধান্য দিয়েছে জাপানিরা। ফিনিশিং, কাঠের ফ্রেম, চকচকে আবরণ, ১৪ ধাপে রঙিন নকশা আর মনকাড়া প্যাকেজিং এর জন্য জনপ্রিয় হয়েছে জাপানি পেন্সিল।
‘একটা চমৎকার পেন্সিল আর একফালি স্বপ্ন আপনাকে যেকোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।‘ না, আমার কথা নয়। খ্যাতিমান লেখক জয়েস মেয়ার এভাবেই পেন্সিলের সাথে আইডিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। আমাদের অধিকাংশেরই হাতেখড়ি এই পেন্সিল দিয়েই। তাই শিক্ষা বা সৃষ্টি- আজ সবকিছুর নকশাকার এই পেন্সিলই।