গরীব মানুষের দুর্দশা নিয়ে এ কেমন কৌতুক প্রধানমন্ত্রীর!1 min read
Reading Time: 4 minutesপ্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব বাসভবন গণভবনের প্রতিদিনকার খরচ এখন কত টাকা তার কোনো হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না। সরকারের অন্যান্য বিভাগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান তিনি নিয়মিত জানালেও তাকে কেন্দ্র করে খরচ হওয়া রাষ্ট্রীয় টাকার হিসাবের স্বচ্ছতা কোথায় পাওয়া যাবে রীতি মতো গবেষণা করে বের করার জিনিস! অথচ, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ এসব তথ্য গণভবনের ওয়েবসাইটেই থাকার কথা ছিল।
সে যাইহোক। গণভবনে বর্তমানে কী পরিমাণ টাকা খরচ করা হয় তার একটা অনুমান পাওয়া যাবে ২০১৩ সালে দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনটি শিরোনাম ছিল, “প্রধানমন্ত্রীর আপ্যায়ন খরচ ৮০ লাখ থেকে বেড়ে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা : একদিনেই ব্যয় হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার”।
ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৈনিক আপ্যায়ন খরচ ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৯৮ টাকা। এ খাতে তিনি ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যয় করেছেন ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা আগের সরকারগুলোর চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। বিগত সরকারগুলোর সময় এ খাতে ব্যয় হতো বছরে ৮০ লাখ টাকা। আর এখন এক মাসেই হচ্ছে ৬৫ লাখ টাকা।”
অর্থ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বার্ষিক বাজেট ২০১২-১৩-এ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অংশে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, বলে আমার দেশ-এর রিপোর্টে জানানো হয়।
২০১৯ সালে এসে হয়তো চলতি বছরের বাজেট বই ঘাটলে বর্তমানে গণভবনের খরচ কী পরিমাণ বেড়ে তার ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু হাতের কাছে এই মুহূর্তে বাজেট বই না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
আমরা যদি ২০১২-১৩ সালের বাজেটের কথাই ধরি, তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রীর ভবনে খরচ হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রী ভবনে প্রতিদিন কতজন মানুষের জন্য রান্না করা হয় তারও সঠিক কোনো তথ্য নেই আমাদের কাছে। যদি ধরে নেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবারের সদস্য, কর্মকর্তা, কর্মচারী, অতিথি- সব মিলিয়ে ১০০ জনের জন্য রান্না হয়ে থাকে (সব কর্মকর্তা-কর্মচারি নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর সাথে খাবার খান না। তবুও ইচ্ছা করেই সংখ্যাটি বাড়িয়ে লেখা হলো), তাহলে কত কেজি পেঁয়াজ লাগবে একদিনে? ৫ কেজি? ১০ কেজি? যদি প্রতিদিন গণভবনের ১০ কেজি পেঁয়াজ লাগে রান্নার জন্য তাহলে সেই পেঁয়াজের বর্তমান বাজার মূল্য হচ্ছে ২৫০০ টাকা (২৫০ টাকা কেজি দরে)। সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের কারসাজির মাধ্যমে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আগে দাম ছিল ৩৫-৪০ টাকা কেজি। সেই হিসেবে কেজিতে দাম বেড়েছে ২১০/১৫ টাকা করে। ১০ কেজিতে সেই বৃদ্ধি দাঁড়াবে ২ হাজার বা একুশ শত টাকা (৬ থেকে ৭ গুণ বৃদ্ধি!)।
যাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনের খাবার খরচ কমপক্ষে ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা (বর্তমানে এর দ্বিগুণও হতে পারে) তার খাবারে মধ্যে যদি ২ হাজার বা একুশ শত টাকা প্রতিদিনের খরচ বাড়ে তাহলে শতকরা হিসেবে এই বৃদ্ধি ১ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কোনো প্রভাবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টের পাওয়ার কথা নয়।
গত মাসে ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ কারণে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় (যদিও একই সময়ে মালদ্বীপে রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে নয়া দিল্লি!)। এর কয়েকদিনের মধ্যে ভারত সফরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় হাস্যরস করে বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। ফলে তিনি পেঁয়াজ দিয়ে তরকারি রান্না করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন এটিকে অনেকে স্বাভাবিক কৌতুক হিসেবে নিয়েছিলেন। যদিও বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করেছিলেন যে কারণে তাদের ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে সেই বিষয়টি নিয়ে কৌতুক না করে আরও সিরিয়াসভাবে ভারতের কাছে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করতে পারতেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গতকাল (১৫ নভেম্বর) শনিবার দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের আগ মুহূর্তে আবারও পিঁয়াজ নিয়ে রসিকতার সুরে কথা বলেছেন। ভারত থেকে ফেরার পর গত তিন সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম আরও কয়েকগুন বাড়ার পর নতুন করে শেখ হাসিনা জানালেন, তিনি গণভবনের শনিবার পেঁয়াজ ছাড়া সবকিছু রান্না করিয়েছেন। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে যাওয়া কর্মকর্তােদর উদ্দেশে হাসিমুখে তিনি এই কথাটি বলেন।
দেশে একটি নিত্য পণ্যের দাম নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। পাশ্ববর্তী দেশ থেকে পণ্যটি না আসা একটি কারণ। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে এবং সরকারের মন্ত্রণালয়ও বলছে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে থাকতে পারেন। আর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই স্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি যে হয়েছে তার একটি প্রমাণ হলো বাজারে কোনো দোকানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে না যে, তাদের খুপড়িতে পেঁয়াজের পরিমাণ কম। প্রতিটি দোকানেই আগের মতো ঝুঁড়িভর্তি পেঁয়াজ আছে। কিন্তু দাম আগের চেয়ে ৬/৭ গুন বেশি! এর অর্থ হচ্ছে, বাজারে পেঁয়াজ কম নয়, দামটা শুধু বেশি। এমনটা হয় শুধুমাত্র সিন্ডিকেট করলে।
এই সিন্ডিকেট ভাঙা সরকারের দায়িত্ব। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বড় বড় ডিলার ও মজুদদাররা ক্ষমতাসীন দলের লোক হয়ে থাকেন সব সময়ই। বর্তমানেও তাই। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল তার নিজের দলের এসব ব্যবসায়ীদের ডেকে হুঁশিয়ার করার। সিন্ডিকেট করে যাতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো না হয় তা নিশ্চিত করার। যদি এরপরও সিন্ডিকেট না ভাঙতো তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার।
এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য ভুক্তভোগী মানুষের কাছে “নির্মম রসিকতা” ছাড়া কিছুই নয়। পেঁয়াজ ছাড়া দেশি বা বিদেশি সুস্বাদু বিভিন্ন পদের রান্না করার ক্ষমতা এবং সঙ্গতি দুটোই প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। কিন্তু গরীব মানুষের সেই বিলাসিতার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের গরীব কোটি কোটি মানুষের কাছে পেঁয়াজ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। তাদের কপালে দুই বেলা ভাতের সাথে হয়তো ডাল কিম্বা আলু ভর্তা জোটে। এর চেয়ে বেশি কিছু জোটানো এই উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই ডাল কিম্বা আলু ভর্তার সাথে দুটো পেঁয়াজ কুচিকুচি করে না দিলে তা গলদকরণে বড় কষ্ট হয় ওই গরীব মানুষগুলোর। তারা হয়তো রিকশা চালক, দিনমজুর, পাথর শ্রমিক, কৃষক কিংবা আরও অনেক খেটে খাওয়া মানুষ।
একবেলা খাওয়ার জন্য দুটো পেঁয়াজের দাম যদি মাস খানেক আগে ৫টাকা হয়ে থাকে, তাহলে আজ সেই দুটো পেঁয়াজ তাদেরকে কিনতে হচ্ছে ৩০ কিংবা ৩৫ টাকা দিয়ে। ভাত, ডাল, আলু ভর্তা দিয়ে যাদের প্রতি বেলা খাবারের খরচ ২৫ থেকে ৩৫ টাকার কম হয়ে থাকে, তাদের জন্য একবেলার পেঁয়াজে আরও ৩০ টাকা বেশি খরচ হওয়া মানে তাদের একবেলার খরচ ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া।
হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পেঁয়াজের দাম যে পারিমাণ বাড়লে আপনার দৈনিক খাবার খরচের ওপর ১ শতাংশ বদ্ধির প্রভাব পড়ে না, সেই একই দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষের দৈনিক খাবার খরচের ওপর ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে! আপনি কি বুঝতে পারছেন কী কারণে আপনার মতো মানুষের পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করার কথা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে খুবই নির্মম একটি কৌতুক? খুবই জঘন্য একটি উপহাস?