ইতিহাস পুড়িয়েছে যেসব পারমাণবিক দুর্ঘটনা1 min read
Reading Time: 5 minutesসম্প্রতি এইচবিওর ‘চেরনোবিল’ মিনিসিরিজ নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে গেছে গোটা বিশ্বে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহ দিক সম্পর্কে যারা জানতেন না তারাও বেশ খানিকটা নড়েচড়ে বসেছেন। সিরিজটিকে অনেকে আমেরিকান প্রোপাগান্ডা হিসেবে দেখলেও এটা অস্বীকার করবার জো নেই যে কোটি বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই মানবসৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
তবে চেরনোবিল বা হিরোশিমা–নাগাসাকিই পারমাণবিক কেলেংকারির একমাত্র উদাহরণ নয়। চলুন জেনে আসি আলোচিত চেরনোবিলসহ আরও কয়েকটি পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ইউক্রেনের চেরনোবিল পাওয়ার প্ল্যান্টে ঘটে ইতিহাসের সবচাইতে ভয়ংকর পারমাণবিক বিপর্যয়। প্রিপেট শহরে এই চরমতম দুর্ঘটনাটি ঘটে রাতের ১:৩০ এর দিকে। এই প্ল্যান্টে ছিল ৪ টি পারমাণবিক চুল্লি যার প্রতিটি ছিল ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। দুর্ঘটনা ঘটে এর চতুর্থ চুল্লিতে পরীক্ষা চালানোর সময়ে। এর পেছনে অনেকেই দায়ী করেন প্রধান সহকারী প্রকৌশলী আনাতোলি দিয়াতলভের গোঁয়ার্তুমি এবং অদক্ষ টেকনিশিয়ানের পরিচালনাকে।
আনাড়ি টেকনিশিয়ানেরা প্রথমত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন, পরে আচমকা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণসীমার বাইরে চলে গেলে তারা রেগুলেটিং সিস্টেম, জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয় এবং চুল্লির কোরের কন্ট্রোল রডগুলোও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। হঠকারী কর্মকাণ্ডের ফলে ক্ষতি আরও ত্বরান্বিত হয়। মাত্র ৭ শতাংশ শক্তি নিয়ে কাজ করতে থাকা চুল্লিতে চেইন রিয়েকশন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলে আয়োডিন, স্ট্রটোনিয়াম ও সিজিয়াম–১৩৭ পরমাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
বিস্ফোরণে তৎক্ষণাৎ দুজন টেকনিশিয়ানের মৃত্যু হয়। এছাড়াও সপ্তাহ খানেকের ভেতরে তেজস্ক্রিয়তার তীব্রতায় মারা যান আরও ২৮ জন। এছাড়াও অনেকেই থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। অত্র এলাকার পশুপাখিদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে। প্রায় ৩০,০০০–৫০,০০০ স্থানীয় কে সরিয়ে নেয়া হয় অন্যত্র। এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা হিরোশিমা–নাগাসাকির ৪০০ গুণ বেশি। ৩০ বছর পর এর ক্ষতি কমে আসলেও প্রিপেটকে এখনও সম্পূর্ণ বাসযোগ্য ধরা হয় না।
দুর্ঘটনার প্রথম দিকে ধামাচাপার চেষ্টা চললেও ঘটনার দুদিনের মাথায় তেজস্ক্রিয়তা ফ্রান্স, জার্মানি, বেলারুশ,ইতালিতে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র বিশ্বের সামনে আসে এর ভয়াবহতা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য এই ঘটনাকেই দায়ী করেন মিখাইল গরবাচেভ।
ফুকুশিমা দাইশি দুর্ঘটনা
জাপানের ফুকুশিমা দাইশি পাওয়ার প্ল্যান্টে দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালের ১১ মার্চ। রিখটার স্কেলের ৯ মাত্রার ভুমিকম্প এবং ১৫ মিটারের সুনামির ফলে শক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্ল্যান্টের ৬ টি চুল্লির মধ্যে ৪ টি কার্যকর ছিল। এর মাঝে তিনটিকে ঠাণ্ডা করতে গিয়েই বাঁধে বিপত্তি। প্রথম তিন দিনের মাঝেই কোর মৌল গলে গিয়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে থাকে। আইনেস স্কেলে (INES-International Nuclear and Radiological Event Scale) এ ৭ রেটিং পায় এই দুর্ঘটনা।
৪–৬ দিন তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরিত হয় এ থেকে যা ৯২৪ পেটা বিকিউরেলের সমান। জুলাইয়ের মাঝেই চুল্লি বা রিয়েক্টরগুলো শীতল করা হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয়। তেজস্ক্রিয়তার ফলে কোন মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও প্রায় এক লাখ মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয় ওকুমা ও ফুতাবা শহর থেকে। তবে এই ক্ষয় হ্রাসের প্রক্রিয়ায় কাজ করতে গিয়ে প্রায় ১০০০ লোকের মৃত্যু হয়।
থ্রি মাইল আইল্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট
যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের দুর্ঘটনাটি ঘটে ব্যবহৃত মৌলের আংশিক অংশ গলে যাওয়ার ফলে। ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ প্ল্যান্টটির রিয়েকটর ২ এর শীতলীকরণ অংশের ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয়টি ঘটে। শীতলীকরণের জন্য ব্যবহৃত পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং সময়মত ভাল্ভ বব্ধ করতে না পারার ফলে পানির মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে থাকে।
দুর্ঘটনার প্রথমদিন সবার প্রচেষ্টায় কমে আসে ক্ষতির পরিমাণ। যেহেতু এর শেলের কোন ক্ষতি হয়নি তাই কোন বড় বিপর্যয় ঘটেনি। তবে স্থানীয়দের ঘরের বাইরে বের হবার ব্যাপারে দুইদিনের নিষেধাজ্ঞা ছিল।
কিশতিম বিপর্যয়
কিশতিমের বিপর্যয় নিয়ে খুব বড় একটা মাতম না হওয়ার কারণ তৎকালীন সোভিয়েত সরকার বেশ ভালোভাবেই একে চেপে যেতে পেরেছিল। তবে চেরনোবিলের পর থলের বেড়াল বেরিয়ে আসে ১৯৮৯ সালে। ১৯৫৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার কিশতিমে প্লুটোনিয়াম প্রসেসিং প্ল্যান্টে ঘটে এটি। মূল দুর্ঘটনার ১ বছর আগে থেকেই কোর শীতলীকরণের পানির তাপমাত্রা বাড়তে থাকে যা ঘটনার দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে কোর গরম হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
আশেপাশের ৩০০ টি গ্রাম এর তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়, ২,৭০,০০০ জনের মধ্যে মাত্র ১১হাজার লোককে সরিয়ে নেয়া হয় অন্যত্র। এর মাঝেও ১০০ জনের বেশি লোক মারা যায় তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে। পরবর্তী ২ বছর ধরে চলে লোকজন সরানোর কাজ। দেরির ফলে প্রায় ৫০০০ জনের মৃত্যু হয় তেজস্ক্রিয় প্রভাবে, অনেকেই আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে, শিশুরা বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শুধু তাই নয় ১৯৪৯–১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী টেকা নদীতে এর বর্জ্য ফেলায় তাও তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
চেলিয়াবিনস্ক প্রদেশের এই প্ল্যান্টটি তৈরি হয়েছিল মূলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে। এতে সুরক্ষার চাইতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেয়াই ছিল মূল লক্ষ্য। এর কিছু মৌল থেকে এখনও তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিঃসরিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভয়াবহতার মাত্রায় চেরনোবিল– ফুকুশিমার পরেই আছে এটি অর্থাৎ ষষ্ঠ গ্রেডে।
উইন্ডস্কেল বিপর্যয়
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক পারমাণবিক বিপর্যয় উইন্ডস্কেল পারমাণবিক অগ্নিকান্ড ঘটে ১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর। তবে এর সূত্রপাত ঘটে অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকেই যখন ১ নম্বর চুল্লিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি ভুল পরীক্ষা চালানো হয়। ফিশন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালানোর জন্য ৮ অক্টোবর আরও তাপমাত্রা বাড়ানো হলে ভেতরের ম্যাগনেসিয়াম, লিথিয়াম, ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অক্সাইডাইজড হতে শুরু করে। ফলাফল আগুন ধরে যায় মৌলে।
দুইদিন ধরে এই গলন প্রক্রিয়া চললেও ১০ অক্টোবর দুইজন কর্মী মূল চুল্লি পর্যবেক্ষণে গেলে টের পান সেটা। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের এই প্ল্যান্টে কর্মীরা বায়ু, পানি ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মাধ্যমে দুইদিনে অগ্নি নির্বাপণে সমর্থ হন। কিন্তু এর মাঝেই উত্তর পশ্চিমের এই প্ল্যান্ট থেকে ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য স্থানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে থাকে।
ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে দুর্ঘটনার ৫০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে উৎপাদিত গরুর দুধ বিতরণ বন্ধ থাকে কয়েক সপ্তাহ। অত্র এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয় মানুষকে। বহু দশক এ সংক্রান্ত নথিপত্র চাপা পড়ে থাকলেও ১৯৮০ সালে সিল করা এই কারখানাটি খুলে পরিষ্কারের কাজ শুরু হয় যা ২০১৮ তে শেষ হয়।
‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?’ এই বিতর্কে রসদ দেয়ার কাজটাই যেন করেছে এই পারমাণবিক দুর্ঘটনাগুলো। জীবনকে সহজ করে তোলার কাজে নিয়োজিত এই পারমাণবিক চুল্লিগুলো ক্ষণিকের ওলটপালটেই পরিণত হয়েছে মেরি শেলির সেই ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ এর যমজ ভাইয়ে।