পলান সরকার – আলোর ফেরিওয়ালা1 min read
Reading Time: 4 minutesজনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে পলান সরকারের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। জ্ঞানের ফেরিওয়ালা সাদা মনের এই মানুষটি তাঁর নিঃস্বার্থ কাজ দিয়ে মন জয় করে নিয়েছিল পুরো বাংলাদেশের। নিজেও বইপোকা দেখেই কিনা নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল অজান্তেই।
গত পহেলা মার্চ,শুক্রবার তিনি ৯৮ বছর বয়সে এ পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন। খ্যাতিবিমুখ এই মানুষটি কে যেন সবাই জানতে পারে, তার একটা ছোট্ট চেষ্টা এই লেখা। লেখাটি ‘আলোর ফেরিওয়ালা’-র প্রতি উৎসর্গীকৃত।
১৯২১ সালের ১লা আগস্টে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। বাবা হায়াতুল্লাহ ও মা মহিফুন্নেসার তৃতীয় পুত্র তিনি। দ্বিতীয় কন্যার মৃত্যর পর তিনি জন্মেছিলেন দেখে মা তাকে পলান বলে ডাকত। পরবর্তীতে এটাই তাঁর নাম হয়ে উঠে,যদিও জন্মের সময় নাম রাখা হয়েছিল হারেজ উদ্দিন।
বয়স যখন মাত্র পাঁচ, সেই সময় হারান নিজের বাবাকে। বাবার মৃত্যর পরে তিনি তাঁর মা ও নানার সাথে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউশা গ্রামে চলে আসেন। বাবার মৃত্যর পরে তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যার কারণে কোনমতে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পারলেও সপ্তমের গণ্ডি পেরোনোর সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্ত পড়ার নেশা তাকে ছাড়েনি কখনই।
পড়ার নেশা ছাড়তে পারতেন না বলেই এর-ওর কাছ থেকে বই ধার করে আনতেন। গ্রামে তখন বই এর আকাল ছিল তাও তিনি ঠিকই বই খুজে বের করতেন পড়ার জন্য়। যখন যা পেয়েছেন তাই পড়েছেন। বাদ যায়নি কুড়িয়ে পাওয়া কাগজ ও। যুবক বয়সে তাঁর নানার জমির খাজনা আদায়ের কাজ করতেন। যার ফলে পরবর্তীতে বাউশা ইউনিয়নের কর আদায়কারীর চাকরি পান। এর মাঝেই তাঁর নানা মারা যান। নানার মৃত্যতে উত্তরাধিকার সুত্রে বেশ কিছু জমি ভাগে পান। যার ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
’৬২ সালে কর চৌকিদারের চাকরি নেবার আগে পলান সরকার যাত্রাদলে ছিলেন। তিনি ভাঁড়ের অভিনয় করতেন। তাঁর কথায়, “চেহারা খারাপ ছিল দেখে নায়ক-সহনায়কের পাট আমাকে দেওয়া হতোনা। ফকরামো (ফক্কড়) বা লোক হাসানোর পাট করতে হত আমাকে।”
পলান সরকার বিশ্বাস করতেন রামকৃষ্ণ দেবের কথায়, ‘থ্যাটার করলে লোকশিক্ষা হয়’। এই বিশ্বাসে তিনি গ্রামের তফি শাহের দলের সাথে ভাসানযাত্রা,ইমানযাত্রা,কেষ্ট যাত্রা ইত্যাদি নিয়ে ঘুরেছেন সারা দেশ। তাঁর যাত্রা দলে একমাত্র লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন তিনি। তাই যাত্রাদলের সব স্ক্রিপ্ট কপি করতে হত তাকেই। যেহেতু সে যুগে ফটোকপিয়ার বা সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিল না। এর সাথে সাথে তিনি প্রম্পটারের কাজ ও করতেন। আর এই করতে করতেই বই পড়ার নেশা ধরে গেল।
কর আদায়কারীর বেতন দিয়ে বই কিনতেন,নিজে পড়তেন ও অন্যদের ধার দিতেন পড়ার জন্য। এছাড়া যাত্রা-থিয়েটার করার সময় আড়ানির ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে বই নিতেন পড়ার জন্য। বই পড়তে পড়তে তাঁর ভাষা জ্ঞান হয়েছিল চমৎকার। তাই গ্রামে কোন জমির দলিল,ব্যবসায়ের চুক্তিনামা কিংবা সভার কার্যবিবরণী লেখার জন্য সবসময় ডাক পড়তো তাঁর।
১৯৬৫ সালে বাউশা হারুন-অর-রশিদ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় নিজের জমি দান করেন তিনি। কিন্ত প্রচারবিমুখ এ মানুষটি নিজের নাম ও প্রচার করতে চাননি,না চেয়েছেন স্কুলে কোন শীর্ষস্থানীয় পদ। তবুও স্কুলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়েছিল। প্রতি বছর এ স্কুলে প্রথম থেকে দশম স্থান পেত যারা,তাদের পলান সরকার পুরস্কার হিসেবে বই দিতেন। পরে তিনি খেয়াল করেন যে অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও বই পড়তে আগ্রহী। তখন তিনি সবাইকে বই পড়তে দেওয়া শুরু করেন,নিয়ম ছিল পড়ে ফেরত দিতে হবে। আর এভাবেই তাঁর বই আন্দোলনের শুরু হয়েছিল।
অসম্ভব বই-পাগল মানুষটি নিজে যেমন বই পরতেন,অন্যদের ও পড়ার জন্য উৎসাহ ও সুযোগ দুটোই করে দিতেন। তাঁর নিজস্ব চাল-কল ছিল,যেখানে সময়মত দেনা-পাওনা পরিশোধ করলে তিনি বই উপহার দিতেন। শুধু তাই নয়, বিয়ে বা জন্মদিন ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অন্যান্য উপহারের সাথে তিনি বইও দিতেন।
এদিকে ১৯৯২ সালের দিকে তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। ডাক্তার তাকে নিয়মিত ৩-৪ কিলোমিটার হাঁটতে বলেন। তখন তাঁর মাথায় আসে এক অভিনব চিন্তা। তাঁর ভাষায়, ‘আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো’। আর এভাবে পলান সরকার বই পৌঁছে দিতে লাগলেন ঘরে ঘরে,গ্রামে গ্রামে। ধীরে ধীরে তাঁর কথা ছড়িয়ে পরে অন্য গ্রামেও। সেখানের মানুষেরাও ধরণা দিতে থাকেন তাঁর কাছে। তিনি হয়ে উঠেন এক ভ্রাম্যমান পাঠাগারের মত। গ্রামের লোকেরা ঘুম ভেঙ্গে উঠে আঙ্গিনায় দেখতে পেতেন হাস্যোজ্জল এ মানুষটিকে,কাধে তাঁর ঝোলাভর্তি বই। এভাবে তিনি রাজশাহির প্রায় ২০টি গ্রামে পৌঁছে দেন জ্ঞানের আলো, গড়ে তুলেন এক অভিনব আন্দোলন।
নীরবে নিভৃতেই তিনি তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন অনেক বছর ধরে, এমন সময়ে বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ২৯ ডিসেম্বার,২০০৬ সালে। এর পরে ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো তাকে নিয়ে ‘ছুটির দিনে’ ফিচার করে। এভাবে দেশব্যাপি তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে রাজশাহি জেলা পরিষদ ২০০৯ সালে তার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি পুর্ণাঙ্গ পাঠাগার তৈরি করে দেয়। শুধু তাই নয়, ২০১১ সালে তাঁকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা তথা ‘একুশে পদক’ এ ভূষিত করা হয়।এমনকি বিটিভিতে তাঁর জীবন অবলম্বনে নাটক ‘অবদান’ প্রচার করা হয়েছিল।
গুণী এ মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন গত পহেলা মার্চ। রেখে গেছেন ৬ ছেলে,তিন মেয়ে ও অসংখ্য মানুষ যারা জ্ঞানের দেখা পেয়েছিল তাঁর মাধ্যমে। হয়তোবা সেই মাদকাসক্ত ছেলেটি যার জীবন বদলে দিয়েছিলেন তিনি, কিংবা আব্দুর রহিম নামের মুদি দোকানদার, যার দোকানে প্রতিদিন বসে বই পড়ার আসর। এমন হাজারো মানুষ যাদের তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বই নামের দীপশিখার কাছে। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন , “আমার কাজ ততদিন চলবে যতদিন আমি হাঁটতে পারব,যখন আমি আর হাঁটতে পারবোনা, আমার লাইব্রেরি আমার কাজ চালাতে থাকবে”।
আমাদের সমাজে,আমাদের দেশে একজন সাদা মনের মানুষ হিসেবে, নিঃস্বার্থ মানুষ হিসেবে সবসময় উদাহরণ হয়ে থাকবেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউশা গ্রামের পলান সরকার।