অর্থনীতি

দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন 1 min read

এপ্রিল ১৪, ২০২০ 5 min read

author:

দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন 1 min read

Reading Time: 5 minutes

গ্রেট ডিপ্রেশন- বাংলায় যাকে বলে “মহামন্দা”, যার নাম শুনে এখনো আঁতকে উঠে সারা বিশ্ব। ধারণা করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া এই মহামন্দা বিশ্ব অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। প্রায় এক দশক ধরে চলা অর্থনৈতিক মহামন্দায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া সারা বিশ্ব সম্মুখীন হয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষতির। বিশ্বনীতি এই ক্ষতির নাম দিয়েছিল “গ্রেট ডিপ্রেশন” বা “অর্থনৈতিক মহামন্দা”।

কি হয়েছিল অর্থনৈতিক মহামন্দায়?

শুরুটা বাণিজ্য রাজ্য আমেরিকা থেকেই হয়েছিল। ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর মার্কিন শেয়ার বাজারে নেমে আসে অনাকাঙ্খিত ধ্বস। ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার মার্কেটে শুরু হয় হাহাকার। শেয়ার মার্কেটে বহু টাকা লগ্নি থাকার কারণে মার্কিন ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। কয়েক মাসের মধ্যেই ৪০,০০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির শিকার হয় মার্কিন বিনিয়োগকারীরা যার ফলস্বরুপ বেশ কয়েকবছর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে চলেনি কোন বিনিয়োগ।

ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় আমানতকারী জনগণ হয়ে পড়ে সর্বস্বান্ত। বহু কর্মীকে তখন জোরপূর্বক কাজ থেকে ছাটাই করতে বাধ্য হয় খ্যাতিমান সব কোম্পানিগুলো। ১৯৩৩ সালের শেষের দিকে এসে মহামন্দা যখন কিছুটা স্থবিরতা লাভ করে, তখনও প্রায় দেড় কোটি লোক কর্মহীন। আমেরিকার অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হবার পথে।
তুলা আর চিনির দাম পড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ফসল ক্ষেতেই পড়ে থেকে পচতে লাগলো, কারণ ফসল কাটার খরচও কেউ করতে চাচ্ছিল না।

এই মহামন্দা চলেছিল ১৯৪০ এর দশক পর্যন্ত। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকার কারণে নতুন করে চাহিদা তৈরি হয়, শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি ঘটে এবং নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হতে শুরু করে।

গ্রেট ডিপ্রেসনের ধাক্কা যে শুধু আমেরিকার ওপর দিয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। আমেরিকান অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ এবং এশিয়াকেও এই অর্থনৈতিক ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মুদ্রা ডলারের দামে বাধা ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নেওয়া ঋণ শোধ করতো। ডলারের দাম কমে যাওয়ায় সেসকল দেশ বাজেভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির কবলে পড়ে। একই অবস্থা ছিল এশিয়ার সকল দেশেও। এদিকে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন বা ইউরোপের সাথে কোনরকম অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল না । তাই এ বিপর্যয়ে দেশটাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণ

১৯২০ সালে মার্কিন অর্থনীতি চলছিল অকল্পনীয় উর্ধগতিতে। মাত্র ১৯২০ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে দেশটির মোট সম্পদ পরিণত হয় দ্বিগুণে। তাই অর্থনীতিবিদরা এই কালের নাম দেন “দ্যা রোয়রিং টুয়েন্টিস”।

শেয়ার মার্কেটের কেন্দ্রবিন্দু তখন ছিল নিউ ইউয়র্ক শহর। সে শহরের ওয়াল স্ট্রীটের শেয়ার বাজারে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর আনাগোনা। জনগণের মাঝে তখন সঞ্চিত অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার প্রবণতা ছিল ব্যাপক। যার ফলে শেয়ার মার্কেটে বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয় যার সর্বঘাতী রূপ দেখা যায় ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে। কালো মঙ্গলবার নামে পরিচিত ১৯২৯ সালের ২৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুজি বাজারের হঠাৎ দরপতনে এই মহমন্দার সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়। তবে অনেকেই আবার এও মনে করেন যে দরপতন শুধুই উপসর্গ মাত্র, কারণ নয়।

বাজারের উপর আস্থা হারানোর ফলে ভোগের পরিমাণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয় কমে যায়। একবার মূল্য হ্রাস পাওয়ার ফলে অনেক মানুষ ভেবে নেয় যে নুতন করে বাজারে বিনিয়োগ না করে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। টাকা বিনিয়োগ না করায় মূল্য হ্রাস পেলে তারা লাভবান হয় এবং চাহিদা কমায় স্বল্পমূল্যে অধিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। অর্থ-কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকারীরা মনে করেন মহামন্দা সাধারন দরপতন হিসেবে শুরু হয় কিন্তু অর্থ সরবরাহ সংকুচিত হতে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং এই সাধারন দরপতন মহামন্দার রূপ ধারণ করে।

ব্যাংকনীতি এবং হোবার প্রশাসন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হোবার তার জনগণকে মহামন্দা কেটে যাওয়ার আশ্বাস দিলেও, তিনবছরেও তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং ১৯৩০ সালে, ৪০ লক্ষ আমেরিকান হন্য হয়ে চাকরির খোঁজ করেছিল। একবছরে যা দাঁড়ায় ৬০ লক্ষে। বেকারত্ব যেন একগ্রাসে খেয়ে ফেলছিল আমেরিকাকে।

দেশটির উৎপাদন শিল্পে অচলাবস্থা, গৃহহীন, কর্মহীন মানুষে ছেয়ে গিয়েছিল প্রতিটি শহর। কৃষক তার ফসল ফলাতে পারছিল না। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে দেখা দেয় খরা। যাতে বহুমানুষের মৃত্যু ঘটে, নষ্ট হয়ে যায় অনেক ফসল।

১৯৩০ এর শেষের দিকে এসে মানুষ ব্যাংক বিনিয়োগ নীতিতে আস্থা হারাতে শুরু করে। সঞ্চয়পত্র ভেঙে ব্যাংক থেকে টাকা নিতে শুরু হয়। এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে স্বল্প তারল্য অনুদান প্রদানে জোর দিতে থাকে।

১৯৩১ এর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যাংকগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও ১৯৩২ এর শেষের দিকে এসে অনেক ব্যাংক তাদের পুঁজি হারিয়ে ফেলে এবং ১৯৩৩ সালে প্রায় হাজরখানেক ব্যাংক তাদের দরজা বন্ধ করে দেয়। হোবার প্রশাসন ব্যাংককে যথাসাধ্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাজস্ব অনুদান দিয়ে ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয় সরকারকে। তারা ভেবেছিল, ব্যাংক থেকে অনুদান নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা সচল করতে পারবে। এতে করে জনগণ তাদের চাকরি আবার ফিরে পেতে পারবে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মহামন্দার প্রভাব

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিলনা। এজন্য একমাত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন মহামন্দার শিকার হয়নি। এর ফলে অনেক দেশে কমিউনিস্ট রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভিত্তিক অর্থনীতির প্রতি আগ্রহ দেখা দেয়। ইউরোপের শিল্প বিল্পবের ফলে যে ধনতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলমন্ত্র হল অধিক উৎপাদন ও অধিক মুনাফা। যা মহামন্দার বিরূপ প্রভাব হিসাবে ধরা হয়।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মহামন্দার চিত্র ছিল সবচেয়ে বেশী ভয়াবহ। অবাধ বাণিজ্য, মুক্ত অর্থনীতি,সীমাহীন উৎপাদন দ্বারা সীমাহীন সম্পদ অর্জন প্রভৃতি ভাবধারা গনতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা হারাতে ব্যাপক সহায়তা করে। ফলে ফ্যাসিবাদ বা নাৎসীবাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এদিকে বিশ্ব যুদ্ধের অর্থনৈতিক ধ্বসের ফলে জার্মানির অবস্থা ছিল শোচনীয়। মার্কিন ঋণ না থাকায়, জার্মানির কাগজের মুদ্রার মূল্য কমতে থাকে। যার জন্য বৈদেশিক চুক্তিতে জার্মানি মুদ্রা তার মান হারায়৷ লেনদেনের ক্ষেত্রে তখন দাবী করা হয় ব্রিটিশ পাউন্ড বা মার্কিন ডলার। জার্মানির রপ্তানি বাণিজ্য তখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেইসাথে আমাদানি বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বেকারত্ব স্বাভাবিকভাবেই পুরো জাতিতে জেঁকে বসে। ফলে ১৯৩২ সালে দেশটির বেকার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৬০ লক্ষে।

জার্মানির প্রজাতন্ত্র ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে। ১৯৩৩ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে পার্লামেন্টে ফ্যাসীবাদীদের সংখ্যা ১ থেকে ১০৭ এ এসে দাঁড়ায়। ফলে দেশটির মূল সরকার ব্যবস্থায় একনায়কতন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।

জার্মানি ও অট্রিয়া শুল্ক জোট গঠন করে যা ফ্রান্সের জন্য মোটেও সুবিধাজনক ছিল না। জোট গঠনে তাই ফ্রান্স বিরোধিতা করে। যদিও ব্রিটেন এই জোটের বিরোধী ছিল না তবে ফ্রান্সের চাপের মুখে লীগের সভায় বিষয়টিকে হেইগ আদালতের কাছে বিচার্য হিসাবে পাঠায় বৃটিশ সরকার। পরবর্তীতে আদালত জোটটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। জার্মানির মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে, অর্থনেতিক দুর্দশা তখন মহামারী রূপ নেয়। ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন হয়, পতাকা উঠে নাৎসী দলের। ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় বসেন নাৎসী নেতা আডলফ হিটলার। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো তৈরি করে এক নতুন চুক্তি, অটোয়া চুক্তি। ১৯৩০ এর পর অধিকাংশ দেশেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৈন্যতা শুরু হয় যার কোন সুরাহা পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে অনেকেই ভেবেছিল এই মহামন্দা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, যুদ্ধ।

আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলন

১৯৩৩ এর মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলন। প্রায় ৬৪টি দেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। ফ্রান্স ও তার সহায়ক দেশগুলো বেঁকে বসে। তারা শর্ত দেয়, যদি মুদ্রা মূল্যের স্হিতি ঘটে তবেই বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস করা হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সিদ্ধান্ত দিলেন যে, শুল্ক হ্রাস করা অত্যন্ত জরুরী। মুদ্রা মূল্য স্থির করার আগেই তাই শুল্ক নিয়ে ভাবা উচিত। এ সিদ্ধান্তের কারণেই মূলত আন্তর্জাতিক সম্মেলন ভেঙে যায়।

নিউ ডিল- নতুন সম্ভাবনার উদয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩৩-৩৬ সালে প্রণীত প্রোগ্রাম, পাবলিক কর্ম প্রকল্প, আর্থিক সংস্কার এবং প্রবিধান ছিল, যার নাম দেওয়া হয়- নিউ ডিল। রুজভেল্টের মতে যা ছিল গ্রেট ডিপ্রেশন এর প্রতিক্রিয়া। এই ফেডারেল প্রোগ্রামগুলির মধ্যে কিছু বেসামরিক কনজারভেশন কর্পস, সিভিল ওয়ার্কস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ফার্ম সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএসএ), জাতীয় শিল্প পুনরুদ্ধার আইন ১৯৩৩ (এনআইআরএ) এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসন (এসএসএ) অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই প্রোগ্রামগুলি কৃষকদের, বেকার, যুব এবং বৃদ্ধদের জন্য সমর্থন অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এটি  ছিল ব্যাংকিং শিল্পের নতুন সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূল্যবৃদ্ধি হ্রাসের পর অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অন্তর্ভুক্ত।

১৯৩৫ সালে কংগ্রেস সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে একটা আইন পাস করে যা বেকার, শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম আমেরিকানদের পক্ষে মহামন্দা পরবর্তী প্রথম আইন ছিল। এই আইন ছিল বেকার এবং দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ, স্বাভাবিক স্তরে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং পুনরাবৃত্তি হ্রাস প্রতিরোধে আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার। ঐতিহ্যগত উদার অর্থনীতির নীতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং ফেডারেল সরকার সক্রিয়ভাবে অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল। সোনার মান ব্যবস্থার বিলুপ্তি, ব্যাংক ত্রাণ, ব্যবস্থাপনা মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন, জাতীয় শিল্প পুনঃস্থাপন আইন , কৃষি সমন্বয় আইন , শ্রমিক সুরক্ষা জন্য  আইন , সামাজিক নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি আইন প্রণয়ন করা হয় । টিভিএ একটি পাবলিক প্রকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *