দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তৈমুরের অভিশাপ1 min read
Reading Time: 4 minutesইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। আসে এবং ছত্রভঙ্গ করে দেয় জাগতিক শান্তি ও মোহ। পরাক্রমশালী এক দেশ মেতে ওঠে আরেক দেশের নিরীহ আবালবৃদ্ধবনিতার প্রতি নারকীয় অত্যাচারে। সমুদ্রসম রক্তক্ষয়ের পর থামে যুদ্ধ, নেমে আসে কথিত শান্তিচুক্তি।
মানবজাতির হাজার বছরের যুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে ঘুরেফিরে এই কথাগুলোই আসবে। যুদ্ধবাজদের ইতিহাস নানানভাবে লেখা হলেও দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্র একজন নেতাই বদলে দিচ্ছে এর নাড়িনক্ষত্র। আজ এমনই একজন খুনে তৈমুর লংয়ের জানাবো এই লেখায়। আর তার সাথে ইতিহাসের আরেক কসাই হিটলারের সংযোগটা কোথায়- তাও জেনে যাবেন।
কে এই তৈমুর?
ইতিহাসে তৈমুরের পরিচয় অনেক। তবে সব ছাপিয়ে যুদ্ধবাজ, হিংস্র সেনানায়ক পরিচিতিটাই উঠে আসে। তৈমুরের জন্ম ১৩ শতাব্দীতে তুর্কি বারলাস উপজাতিতে। এই উপজাতির গোড়াপত্তন হয়েছিল মোঙ্গলদের থেকে। পরে এরা মধ্য এশিয়ায় জায়গা করে নেয়। তৈমুরের জন্ম উজবেকিস্তানে। সে সময়টায় উজবেক শাসন করছিল মোঙ্গল চাগাতাইরা।
১৩৩৬ সালের ৯ এপ্রিল এক গাঢ় রাতে জন্ম সামান্য ভূস্বামীর ঘরে জন্ম এই শিশুর। নাম রাখা হলো, তিমুর বা তৈমুর, যার অর্থ লোহা। আদতেই তিনি লৌহমানবের পরিচয় দিয়েছিলেন জীবনের বাকি সময়ে।
তরুণ বয়সেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ভবিষ্যতের এই শাসক। একবার রণক্ষেত্রে বাম পায়ে তীরের আঘাত লাগায় আজীবনের জন্য খোঁড়া হয়ে যান তিনি। তখনই তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয় Lame বা লং। অবশ্য এটুকু সীমাবদ্ধতা দমাতে পারেনি তাঁকে । নিজস্ব রণকৌশল ও দক্ষতায় ক্রমে ট্রাঞ্জোক্সিয়ানার একটি বড় অংশ তাঁর শাসনে চলে আসে ১৩৬৬ সালের মধ্যে। নিজেকে চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি মনে করতেন তিনি। এমনকি সমর কৌশলে অনুসরণ করতেন সেই চেঙ্গিসকেই।
নারকীয় যজ্ঞ
চেঙ্গিস খানের সাথে পারিবারিক কোন সম্পর্ক না থাকায় বিজিত অঞ্চলের আমির হিসেবেই দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। তবে মনে মনে ভীষণ সংকল্প ছিল তাঁর- গোটা পৃথিবী জয় করা চাই ই চাই! প্রথমত রাশিয়া এবং পরবর্তীতে ইরান, ইরাক,সিরিয়া, আফগানিস্তান,ভারত ও এশিয়া মাইনরের বেশ কিছু অঞ্চল দখলে আসে তৈমুরের। এছাড়াও অটোমান সাম্রাজ্য এবং ইউরোপে প্রভাব বিস্তারও করেন তিনি। সে সম্পর্কে আমরা পরে এক সময় আলোচনা করবো।
তবে এসব অঞ্চল খুব সোজাপথে যে জয় করেছেন তা নয়। প্রতিটি অঞ্চলে যুদ্ধ করার সময়ই প্রচুর হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণের অভিযোগ আছে তাঁর ও বিশ্বস্ত সেনাবাহিনীর নামে। আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের ৭০ হাজার মস্তক দিয়ে একটি মিনারও তৈরি করেন তিনি। তার মানে বুঝতেই পারছেন, কতটা নৃশংস ছিলেন এই লং! এছাড়াও নানা সময়ে বিদ্রোহী সৈন্যদলকে পৈশাচিকভাবে খুন করার রেকর্ড আছে তাঁর।
৬৮ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে প্রায় ১৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন তৈমুর ও তাঁর বাহিনী। যা তখনকার দিনে গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫ ভাগ ছিল।
ঘুম ভাঙাতেই অভিশাপ
তৈমুরের মৃত্যু হয় ১৪০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। চীন জয়ের পথে তীব্র শীতের প্রকোপে মৃত্যু হয় এই পরাক্রমশালীর। ইতিহাসে অনেকে তাঁকে স্বৈরাচারী চেঙ্গিস খান, হিটলারের সমান মনে করেন। তবে এর বাইরেও একটা সংযোগ ঠিকই আছে এদের সাথে। তবে আশ্চর্যজনকভাবেসেই সম্পর্কের শুরু তাঁর মৃত্যুর পর।
উজবেকিস্তানের সমরখন্দে গুর-এ-আমির নামক স্থানে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। সমাধির কফিনে তাঁর ইচ্ছে অনুসারেই লেখা হয় এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা।
‘ আমাকে যে জাগিয়ে তুলবে , সে আমাকে নয় ,আমার চাইতেও ভয়ানক এক শাসককে জাগিয়ে তুলবে।‘ এবং
‘যেদিন এই পৃথিবীতে আবার জেগে উঠবো , সেদিনও থরথরিয়ে কাঁপবে গোটা বিশ্ব।‘
আর দশটা সাধারণ সতর্কবার্তা ভাবছেন? না হেনরি রাইডারের ‘দ্য ওয়ান্ডারার’স নেকলেসে’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে?
হিটলারের উত্থান
বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং নানান জায়গায় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে চলছিলো জোর গবেষণা। দুই বিশ্বযুদ্ধের করাল গ্রাসেও খুব একটা বাঁধা পায়নি সেগুলো। ১৯৪১ সালেও রাশিয়া তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি জোসেফ স্টালিনের নির্দেশনা অনুসারে শুরু হয় তৈমুর লং বিষয়ক গবেষণা। খ্যাতনামা প্রত্নতাত্ত্বিক মিখাইল জেরাসিমভ ও তাসমুখাম্মেদ ক্যারিনিয়াজভের নেতৃত্বে খনন করা হয় সমরখন্দের সেই সমাধি। এ সময় নানান উৎস থেকে সতর্কবার্তা আসলেও আমলে নেয়নি সোভিয়েত সরকার। সমাধিস্থ দেহ থেকেই মিখাইল আবিষ্কার করেন তৈমুর ছিলেন লম্বায় ৬ ফিট আর তাঁর হাতের অসাড়তাই ছিল মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
কথিত আছে, লংয়ের সমাধি জাগিয়ে তোলার তিনদিনের ভেতরেই শুরু হবে কোন প্রলয়। কিন্তু এবারে দুইদিনের মাথায় নেমে এলো ভয়ানক আগ্রাসন। ২২ জুন ১৯৪১ হিটলার তাঁর নাৎসি বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এবার মিলিয়ে নিন তৈমুরের সেই বার্তা। তাঁর চাইতেও ভয়ানক শাসক বলতে তিনি সম্ভবত জার্মান হিটলারকেই বুঝিয়েছেন; যার হাতে কিনা ৩৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, আর লাখ লাখ হয়েছিল শরণার্থী, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বলি।
সমাধিতে সমাধান
অবশেষে স্টালিনের নির্দেশ মোতাবেক ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর পূর্ণ মর্যাদায় তৈমুরের সমাধি বন্ধ করে দেয়া হয়। আকস্মিকভাবে এর এক মাস পরেই জার্মানদের সাথে রাশিয়ার স্টালিন গ্রাদের যুদ্ধের যবনিকা ঘটে। জার্মান তথা এর সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহ অধ্যায়ের।
সমাধি পুনরায় বুজে দেয়ার পরেই জয়লাভ! দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে অনেকেই মনে করেন হিটলার বাহিনীর পরাজয়ের পিছনে গুরুত্ববহ ভূমিকা আছে এই সমাধি সৌধের অভিশাপের। যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। তবে তৈমুরের মত নরপিশাচের সাথে খুনে এবং দাম্ভিক হিটলারকে মেলাতে ভালোবাসেন অনেকেই।