ইতিহাস

তাজমহলঃ সম্রাট শাহজাহানের অমোঘ প্রেমের নিদর্শন1 min read

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯ 6 min read

author:

তাজমহলঃ সম্রাট শাহজাহানের অমোঘ প্রেমের নিদর্শন1 min read

Reading Time: 6 minutes

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অমোঘ প্রেমের নিদর্শন তাজমহল পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি। স্ত্রী মমতাজের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসার নিদর্শন স্বরুপ, তাঁর মৃত্যুর পর সমাধিস্থলে সম্রাট শাহজাহান এই বিশাল এবং অপূর্ব স্থাপনাটি তৈরি করেন। ভারতীয়, পার্সিয়ান এবং ইসলামিক প্রভাবকে একত্রিত করে নির্মাণ করা এই স্থাপনাটি মধ্যযুগীয় মোঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। তাজমহলের বাইরের দেয়ালগুলো নির্মাণ করা হয়েছে উজ্জ্বল মার্বেল পাথর দিয়ে, যা দিনের আলোর উপর নির্ভর করে রঙ পরিবর্তন করতে পারে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো তাজমহলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অপূর্ব ও নিখুঁত নির্মাণশৈলী এবং ডিজাইনের জন্য গোটা বিশ্বে স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে তাজমহল এক উচ্চাসন দখল করে আছে। সেই সাথে ভারতের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

উল্লেখ্য যে, ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত তাজমহল নির্মাণে সময় লেগেছিলো প্রায় ২০ বছর। ১৬৩২ সালে শুরু হওয়া তাজমহলের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। 

সম্রাট শাহজাহান

বাবর, হুমায়ুন, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের পর মুঘল রাজবংশের (মুঘলরা ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে রাজত্ব করে) পঞ্চম সম্রাট ছিলেন শাহজাহান। চতুর্থ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র শাহজাহান সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে শাহজাদা খুররাম নামে পরিচিত ছিলেন। রাজ্যাভিষেক হওয়ার পর তাঁর নতুন নাম হয় “আবুল মুজফফর শিহাবুদ্দিন মোহাম্মদ শাহজাহান সাহিব কিরান-ই-সানী।

তিনি ১৫৯২ সালের ৫ জানুয়ারি বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন তাঁর দাদা সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্র। 

চতুর্থ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র শাহজাহান; Photo Credit: Britannica

চতুর্থ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সিংহাসন দখলে তিনি তাঁর ভাইদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সিংহাসনের সম্ভাব্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করে ১৬২৮ সালে পঞ্চম মুঘল সম্রাট হিসেবে মসনদে বসেন শাহজাহান। এসময় সম্রাট শাহজাহানের পাশে ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম। ১৬১২ সালে শাহজাহান তাঁকে বিয়ে করার পর তাঁর নাম পরিবর্তন করে মমতাজ মহল রাখা হয়। এবং তিনি মমতাজ মহল নামেই অধিক পরিচিত হন।

উল্লেখ্য যে, ১৬১১ সালে যুবরাজ শাহজাহান রাজ্য ভ্রমণে বেরিয়ে ১৪ বছরের কিশোরী আরজুমান্দ বানু বেগমের প্রেমে পড়েছিলেন। সে বছরই তাঁর সাথে বাগদান সম্পন্ন করে রেখেছিলেন শাহজাহান। তবে মমতাজ সম্রাটের কততম স্ত্রী ছিলেন এটা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোথাও কোথাও আবার মমতাজ সম্রাটের তৃতীয় এবং চতুর্থ স্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ আছে। তবে মমতাজ ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের সব থেকে প্রিয়তমা স্ত্রী।

সূর্যাস্তের সময় তাজমহল; Photo Credit: Britannica

১৬৩১ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৪তম সন্তান জন্মদানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মমতাজের মৃত্যু হয়। অনেকেই মমতাজের অকাল মৃত্যুর জন্য সম্রাট শাহজাহানকেই দায়ী করে। গর্ভবতী মমতাজকে নিয়েই শাহজাহান যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় দীর্ঘসময় হাতির পিঠে বসে থাকার কারণে মমতাজের প্রসব বেদনা শুরু হয়। দীর্ঘ ৩০ ঘন্টার সেই প্রসব ব্যাথা শেষে ১৪তম সন্তানের জন্ম দিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মমতাজ। শাহজাহান নিজেও অবশ্য তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই তো মমতাজের মৃত্যুর পর অনুশোচনায় সাতদিন সাত রাত সম্রাট মুখে কোন দানাপানি তুলেন নি। এমনকি ঘর থেকেও বের হন নি। 

তার কিছুদিন পরই সম্রাট শাহজাহান বিবেকের দংশনে এবং অপরিমেয় প্রেমের টানে প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের স্মরণে অবিস্মরণীয় এক নিদর্শন তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। কথিত আছে মমতাজ মৃত্যুর পূর্বে শাহজাহানের কাছে তাঁর দু’টি শেষ ইচ্ছার কথা বলে গিয়েছিলেন। প্রথমটি, মমতাজের মৃত্যুর পর অন্যকোন নারীর গর্ভে যাতে শাহজাহানের কোনো সন্তান না আসে। এবং দ্বিতীয়টি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিস্থলে মর্মর পাথর দিয়ে এমন এক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা, যা গোটা পৃথিবীর কাছে তাদের প্রেমের নিদর্শনস্বরূপ শত শত বছর টিকে থাকবে। 

গুটিকয়েক ইতিহাসবিদ সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, সম্রাটের স্থাপত্যশিল্পের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিলো। নিজের শখ পূরণ করতেই তিনি তাঁর শাসনামলে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে অগণিত স্থাপনা নির্মাণ করেন। যা মুঘল স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রাখতে যুগের পর যুগ ধরে টিকে আছে। সম্রাটের খুব ইচ্ছে ছিলো এমন কোনো স্থাপত্য নিদর্শন তৈরি করা যা তাকে হাজার বছর ধরে অমর করে রাখবে।

তাঁর তাজমহল নির্মাণের কারণও ঠিক এটাই। মমতাজের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বরং নিজের অমরত্বের লোভই তাজমহল নির্মাণে তাকে বেশি উৎসাহিত করেছিলো। 

Photo Credit: Britannica

তাজমহলের নকশা ও নির্মাণ

মমতাজের মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ১৬৩২ সালে তাজমহল তৈরির মূল কাজ শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, তাজমহলের সম্পূর্ণ স্থাপনাটির নকশা একক কোন মানুষের করা না। সম্রাট শাহজাহান  তাজমহলের নকশা করার জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তের গুণী স্থপতিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে তাজমহলের স্থপতিদের একটা তালিকা পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী-

তাজমহলের চত্বরের নকশা করেছিলেন পারস্যের বিখ্যাত স্থপতি ওস্তাদ ঈসা।

তাজমহলের বড় গম্বুজটির নকশা করেছিলেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আগত স্থপতি ইসমাইল খা। 

তাজমহলের বড় গম্বুজের উপর স্বর্ণের দণ্ডটির ডিজাইন করেছিলেন লাহোরের বাসিন্দা স্থপতি কাজিম খান।

দিল্লীর চিরঞ্জী লাল ছিলেন তাজমহলের প্রধান ভাস্কর এবং মোজাইক-কারক।

তাজমহলের প্রবেশদ্বারে আমানত খাঁর নাম খোদাই করা আছে। তিনি তাজমহলের সমস্ত চারু লিপির দায়িত্বে ছিলেন। 

রাজমিস্ত্রিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। 

সমস্ত কাজের প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন মীর আব্দুল করিম এবং মুক্কারিমাত খান। 

তাজমহল নির্মাণে সাদা মার্বেল পাথরের পাশাপাশি জেড, ক্রিস্টাল, নীলকান্ত এবং ফিরোজা পাথরের মতো অত্যন্ত মূল্যবান পাথর ব্যবহার করে পিতরা দুরার নামে পরিচিত এক জটিল নকশা করা হয়েছিলো। 

মূল্যবান পাথরে খোচিত তাজমহলের একাংশ; Photo Credit: Bitannica

যমুনা নদীর তীরে তাজমহল বানানোর জন্য যে জায়গাটি শাহজাহান পছন্দ করেছিলেন, তার মালিক ছিলো মহারাজা জয় সিং। মহারাজা জয় সিং-এর কাছ থেকে আগ্রা শহরে এক বিশাল প্রাসাদের বিনিময়ে সম্রাট তাজমহলের জন্য এই জায়গাটি বুঝে নেন। তারপর নদী থেকে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু করে আলগা মাটি ফেলে ৩ একরের মতো জায়গা ভরাট করা হয়। 

প্রায় ১০০ ফুট উঁচু তাজমহলের প্রবেশ পথটি লাল রঙের বেলে পাথরের তৈরি। ইসলামিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে এর তোরণে আরবি হরফে ক্যালিগ্রাফি আকারে লিখা আছে কোরআনের বানী। এর কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ২৪০ ফুট (৭৩ মিটার) উঁচু। কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে চারটি ছোটো গম্বুজ রয়েছে। মূল স্থাপনার চারপাশে আছে ১০৮ ফুট উচ্চতার চারটি মিনার।

তাজমহলের সামনের চত্বরটিকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয়। এবং ৩০০ বর্গ মিটার করে ভাগ করে চারভাগেই উঁচু দেয়াল দিয়ে ১৬ টি ফুলের বাগান বানানো হয়।  বাগানের মাঝখান দিয়ে মমতাজের মাজার এবং তাজমহলের দরজা বরাবর মার্বেল পাথরের তৈরি এক বিশাল চৌবাচ্চা বসানো হয়েছিলো। যাতে স্বচ্ছ পানিতে তাজমহলের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়।

তাজমহলের মূল চত্বরটি তিনদিক থেকে বেলে পাথরের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। নদীর পাশটাতে কোনো দেয়াল দেওয়া হয়নি।

তাজমহলের ঠিক মাঝখানে একটি কক্ষে মমতাজের সাথে শায়িত আছেন সর্বকালের সেরা প্রেমিকদের একজন সম্রাট শাহজাহান। শুরুতে এখানে শুধুমাত্র মমতাজের কবর ছিলো। কিন্তু সম্রাটের মৃত্যুর পর তাকেও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয়। 

তাজমহল নির্মাণে ২০ হাজার শ্রমিক এবং পণ্য পরিবহনের জন্য ১ হাজারেরও বেশি হাতির প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছিলো।

তাজের রক্ষণাবেক্ষণ

তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ করে সম্রাট শাহজাহান তার অবর্তমানেও যাতে তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক ভাবে হয় সে ব্যবস্থাও করেছিলেন। তাজমহলের দক্ষিণ দিকের এলাকায় তাজমহলের মূল নকশার সাথে মিল রেখে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের জন্য কাটরা (বাজার) তৈরি করেন। এগুলোর ভাড়া এবং তাজমহলের আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের খাজনা থেকেই তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করা হতো। কিন্তু সম্রাট শাহজাহান সিংহাসনচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তাজ অবহেলার স্বীকার হতে থাকে। ধীরে ধীরে মূল্যবান রত্ন পাথরগুলো চুরি হতে থাকে। উল্লেখ্য যে, প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মমতাজের সমাধির উপর অত্যন্ত মূল্যবান মনিমুক্তাখচিত যে চাঁদর চড়ানো হতো তা ১৭১৯ সালে দিল্লির মসনদ দখলকারী সৈয়দ ভাইরা লুঠ করে। এরপর ১৭৬১ সালে মোটা রুপোর চাদর বসানো তাজমহলের একটা দরজা লুঠ করে জাঠ লুটেরারা।

এরপর উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে তাজ তার সৌন্দর্য এবং মাহাত্ম্য হারায়। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর তাজমহলের প্রবেশপথের বাগানে ইংরেজ সেনারা তাঁবু গাড়ে। আর পূর্ব দিকের মেহমান খানায় সেনা কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ইংরেজ সৈনিকরা তাজমহলে খুঁটি গাড়ার পর বাগান নষ্ট হয়ে যায়, ধাতব ফোয়ারা, সমাধি এবং দেয়ালে লাগানো মূল্যবান পাথর তুলে নিয়ে যায় সৈনিকরা। এছাড়াও তাজের চূড়ায় লাগানো সোনার পাতটিও খুলে নেওয়া হয়। পরে অবশ্য ইংরেজ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বিশেষ প্রচেষ্টায় তাজ কিছুটা হলেও তার পুরাতন গরিমা ফিরে পেয়েছিলো। 

তবে তাজমহলের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিটা হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। ইংরেজরা কিংবা লুটেরারা যতটুক  না ক্ষতি করেছে তারচেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি করেছে মাথুরার পেট্রোল শোধনাগার। এই পেট্রোল শোধনাগার থেকে নির্গত রাসায়নিক বৃষ্টির সাথে মিশে তাজের গায়ে পতিত হয়ে শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরগুলোকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। 

সম্রাট শাহজাহান ভালোবাসার যে নিদর্শন রেখে গিয়েছেন যুগের পর যুগ ধরে তা টিকে আছে। একদিন হয়তো ইট,কাঠ এবং পাথরের তৈরি এই দালান মিশে যাবে মাটির সাথে। কিন্তু প্রিয়তমার প্রতি সম্রাটের ভালোবাসা টিকে থাকবে চিরকাল। 

লেখক- নিয়ন রহমান

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *