বিশ্ব

তাইওয়ান কি স্বাধীন নাকি চীনের আরেক প্রদেশ?1 min read

জুলাই ৪, ২০২০ 3 min read

author:

তাইওয়ান কি স্বাধীন নাকি চীনের আরেক প্রদেশ?1 min read

Reading Time: 3 minutes

“এক দেশ, দুই নীতি” – চীনকে জড়িয়ে এই বাক্যটি প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এক দেশের দুই নীতির প্রয়োজন কেন?  তাইওয়ান, হংকং, ম্যাকাও, তিব্বত এবং মেইন ল্যান্ড চায়নার (চায়নার মূল ভূখণ্ড) ভূ-রাজনীতি  নিয়ে অনেক অনেক পাঠকের আগ্রহ আছে, বিভ্রান্তি আছে। সেই বিভ্রান্তি দূর করতে আজকে আমরা আলোচনা করবো চীন- তাইওয়ান সম্পর্কের অতীত-বর্তমান নিয়ে।

চীনের সাথে বিরোধপূর্ণ অঞ্চল তাইওয়ান মূলত একটি দ্বীপ। তাইওয়ান রিপাবলিক অব চায়না (Republic of China) নামেও পরিচিত। ভৌগলিকভাবে তাইওয়ান পিপল রিপাবলিক অব চায়না (People Republic of China) বা মেইন ল্যান্ড চায়নার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। চায়না থেকে তাইওয়ানের দূরত্ব মাত্র ১১০ কিলমিটার। তাইওয়ান ৯৪ কিলোমিটার (২৪৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ১৪৪ কিলোমিটার (৮৯ মাইল) প্রশস্ত। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী তাইওয়ানের জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৮লাখ ১৬ হাজার ৭৩৬। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ০.৩১ শতাংশ।

রাজনৈতিক জটিলতা

১৮৮৩ সালে চীনের সিং (Qing) ডাইনেস্টি ওলন্দাজদের থেকে তাইওয়ান দ্বীপ দখল করে নেয়। এরপর ১৮৯৫ সালে সাইনো (Sino)-জাপানিজ যুদ্ধে জাপানিজরা জয়ী হলে তারা তাইওয়ান দ্বীপ নিজেদের দখলে নেয়। মাঝে ১৯১২ সালে চীনে সিং ডাইনেস্টির পতন ঘটে। চীনা জাতীয়তাবাদী সরকার কুওমিনটাং এর হাত ধরে চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় Republic of China। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে ১৯৪৫ সালে তারা তাইওয়ানের দায়িত্ব চীনা সরকারের হাতে তুলে দেয়।

চীনে সেসময় গৃহযুদ্ধ চলছিল। মাও সে তুং এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পন্থীরা সেই গৃহযুদ্ধে  চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকার কুওমিনটাংকে পরাজিত করে। চীনের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে কমিউনিস্ট পন্থীদের কাছে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুং চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠা করেন People Republic of China।

গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়ে চিয়াং কাইশেক এবং তার কুওমিনটাং সরকারের লোকজন পালিয়ে যায় তাইওয়ানে যান। সেখানে তারা ‘Republic of China’ নামেই একটি সরকার গঠন করে। নিজেদেরকে সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে তারা। তাইওয়ান এবং চীনের বিরোধিতার শুরুটা সেই সময় থেকেই শুরু হয়।

চিয়াং কাইশেকের পরিকল্পনা ছিল, কোন একদিন কমিউনিস্টদের কাছ থেকে তারা আবার পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ নিবে। আর মধ্যবর্তী সময় তাইওয়ানেই কাটাবে।

যুক্তরাষ্ট্র কার পক্ষে

যুক্তরাষ্ট্র কার পক্ষে থাকে সেটা সব সময় বিশ্ব রাজিনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থাকে। চায়না ও তাইওয়ানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব প্রথমে “Republic of China” তথা তাইওয়ানকে চায়নার প্রকৃত সরকার বলে নিজেদের সমর্থন জানিয়েছিল। কাপিটালিস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সরকার People Republic of China (PRC)-র কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন দেবে না সেটা মোটামুটি সবাই জানতো। তবে সেসময়  PRC পাশে পেয়েছিল আরেক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে।

একটি তথ্য হয়ত সবাইকে অবাক করতে পারে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান “Republic of China” পরিচয় নিয়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ছিল। জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে PRC কে তাদের সদস্য রাস্ট্র করে। তারপর থেকে একে একে বিশ্বের প্রায় সব দেশই স্বাভাবিক রীতি মেনে নিয়ে জাতিসংঘের মত করে বেইজিং এর পক্ষ নেয়। যার ফলাফল হিসেবে তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমে আসে।

অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে PRC-এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন মূল চীনের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি একবার মূল চায়না সফরও করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিংকে স্বীকৃতি দেয়।

এই দেশ, দুই নীতি

১৯৪৯ সাল থেকে তাইওয়ান চায়নার মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু বেইজিং শুরু থেকেই দাবি করে এসেছে “এক চায়না”র অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ান। তাইওয়ানের আলাদা প্রশাসন ছিল কিন্তু তারা চীনের অংশ হয়েই কাজ করেছে।

মাঝের সময়টায় চীন আর তাইওয়ানের মধ্যে চলেছে তীব্র বাকযুদ্ধ। কিন্তু এরপর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ‘এক দেশ, দুই পদ্ধতি’ নামে চীন এক প্রস্তাব দেয়। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরও ভালো করতে ১৯৯২ সালে তাইওয়ান বেইজিং এর সাথে কনসেনসাস (Consensus) নামের একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিতে স্পষ্ট হয়ে বলা হয় তাইওয়ান “এক চায়না”র অংশ কিন্তু তারা আলাদা প্রশাসনের সুবিধা ভোগ করতে পারে। কিন্তু তারা কখনোই স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না।

তাইওয়ানের বর্তমান অবস্থান

২০০৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত চেন শুই বিয়ান ঘোষণা দেন যে তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়। তার এই অবস্থান চীনকে তাতিয়ে তোলে। ২০০৫ সালে চীন তড়িঘড়ি করে এক আইন পাশ করে। যাতে বলা হয়, তাইওয়ান যদি চীন থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করে, সেটা ঠেকাতে চীন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে।

তবে রাজনীতির বাইরে সমীকরণ বেশ কঠিন। তাইওয়ানের অর্থনীতি এখন চীনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখন আর স্বাধীনতাকে কোন বাস্তবসম্মত বিকল্প বলে ভাবে না।

তাইওয়ানের বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ‘ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি’ এখনো স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যদিকে কুওমিনটাং পার্টি চায় মূল চীনের সঙ্গে একত্রীকরণ। বর্তমান তাইওয়ান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির সদস্য। তিনি চান তাইওয়ানের স্বাধীনতা।

যেহেতু তাইওয়ান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তাই তাইওয়ানের সকল মানুষেরই গণতান্ত্রিক সব অধিকার অর্থাৎ রাজনৈতিক মত প্রদান এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। দেশটির বেশিরভাগ জনগণই এখন নিজেদের ‘তাইওয়ানিজ’ ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিছু পক্ষের দাবী সবকিছু ছিন্ন করে তাইওয়ান মূল চীনের সাথেই যুক্ত হবে।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *