ড. মাকসুদুল আলম: সোনালী আঁশের মানুষ1 min read
Reading Time: 5 minutesড. মাকসুদুল আলম, বিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশের অহংকার, আমাদের গর্ব। তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কারের ফলে কৃষিক্ষেত্রে এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। তিনি তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং করে স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বসেরা সব বিজ্ঞানীদের তালিকায়।
ক্ষুদে বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম
ড. মাকসুদুল আলম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বেড়ে ওঠেছেন পিলখানায়। বাবার বিডিআর-এ চাকরির সূত্রে ঢাকার পিলখানাতেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ছোট ভাই মাহবুবুল আলম ও বন্ধু জোনায়েদ শফিকের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন ‘অনুসন্ধানী বিজ্ঞান ক্লাব’। ক্লাবের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন গাছের পাতা সংগ্রহ করা এবং সেগুলো দিয়ে অ্যালবাম তৈরি করা। এর পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন গাছ পর্যবেক্ষণ ও চারা লাগানোর কাজ। বই দেখে দেখে অ্যালবামে সাজিয়ে রাখা গাছের পাতার বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তাদের বৈজ্ঞানিক নাম বের করতেন। ক্লাবের কার্যালয় ছিল লালবাগের ২৩ নম্বর গৌরসুন্দর রায় লেনে, মাকসুদুল আলমের বাসার ছাদে। যেদিন ক্লাবের সভা বসত সেদিন তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন তাঁর মা। ছেলেবেলা থেকেই গাছের প্রতি এ অকৃত্রিম টানই মাকসুদুল আলমকে পৌঁছে দেয় বিজ্ঞানের বৃহত্তর জগতে।
মাকসুদুল আলমের শিক্ষাজীবন
ড. মাকসুদুল আলম ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি পাড়ি জমান রাশিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তরুণ মাকসুদুল আলম পুরান ঢাকার গলি থেকে জ্ঞানের হাত ধরে প্রবেশ করেন বিজ্ঞানের মহাসড়কে। প্রাণের অজানা তথ্য উদ্ধারকেই তিনি বেছে নেন গবেষণার বিষয় হিসেবে। শৈশবে যিনি আবিষ্ট হয়েছিলেন গাছের জাদুতে, গাছের প্রেমে যিনি ছিলেন মত্ত, তিনি গাছ ছাড়া অন্য কিছুতে কী করে মন বসাবেন? তাইতো গাছের প্রাণরহস্য অনুসন্ধান করার তরেই নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
মাকসুদুল আলম ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস ডিগ্রী লাভ করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৮২ সালে মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট থেকে দ্বিতীয়বারের মতো পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
পেশাজীবনের শুরুতে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৭ সালে গবেষণা কাজে প্রথম সফলতা লাভ করেন। পান এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড। মাইক্রোবায়োলজিতে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে এ পুরষ্কার দেওয়া হয়। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। সেসময় তিনি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হেলো ব্যাকটেরিয়ামের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। সেই যে শুরু হলো জীবনরহস্য আবিষ্কারের খেলা। এরপর থেকে ড. মাকসুদুল আলমের নামের পাশে একের পর এক জীবনরহস্য উন্মোচনের তকমা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার ও বাংলাদেশের হয়ে পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য বের করেন। ২০১০ সালে তিনি আমাদের দেশের হয়ে পাট ও পরবর্তীতে ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং আবিষ্কার করেন।
জিনোম সিকুয়েন্সিং নিয়ে কিছু কথা
আমরা হয়তো অনেকেই এ সম্পর্কে জানি। সহজ করে বলতে গেলে, জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কাজই নিয়ন্ত্রিত হয় তার ক্রোমোজম বা জিনোম দ্বারা। এসব জিনোম তৈরি হয় DNA দিয়ে, আর DNA তৈরি হয় অসংখ্য নিউক্লিওটাইড দ্বারা। এ নিউক্লিওটাইডগুলো গঠিত হয় চার ধরণের নাইট্রোজেনাস বেস দিয়ে। সেগুলো হল: অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) ও থাইমিন (T)। জীবের ক্রোমোজমে অবস্থানকারী এ চারটি বেসই বিভিন্ন কম্বিনেশন তৈরি করে, যে কারণে প্রতিটি জীব একে অন্যের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যধারী। যদি কোনভাবে কোন জীবের জিনোমের এই কম্বিনেশন জানা যায় তাহলে সে জীবের বৈশিষ্ট্যও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
নাইট্রোজেনাস বেসগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক আবিষ্কার করাকে জিন ডিকোডিং বলে। ইতিমধ্যে মানুষের জিন ডিকোডিং করে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিনসমূহের অবস্থান জানা গেছে এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। তেমনি পাটের জিনোম ডিকোডিং বা জিন সিকুয়েন্সিং হওয়া মানে আমরা এখন পাটের যেকোন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এটা আধুনিক বিজ্ঞানে মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। ড. মাকসুদুল আলম শুধু পাট নয়, একে একে ছত্রাক, পেঁপে ও রাবারেরও জীবনরহস্য আবিষ্কার করেছেন। তাঁর এ অসামান্য অর্জন আধুনিক জীববিজ্ঞানের সত্যিই অনেক বড় পাথেয়।
পেঁপে, রাবার, ছত্রাক ও পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন
ড. মাকসুদুল আলম প্রথম চমক দেখিয়েছিলেন পেঁপের জীবনরহস্য উন্মোচিত করে। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। সেসময় হাওয়াইতে নানা রোগের কারণে ভীষণ ক্ষতির শিকার হচ্ছিলেন পেঁপেচাষীরা। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কিছুতেই কোন সুরাহা হচ্ছিল না। অবশেষে বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম এ গবেষণায় সফল হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তাঁর এ যুগান্তকারী আবিষ্কার দেখতে দেখতে সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ডাক আসে রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচন করে দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গবেষণা প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণা কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাঁকে। ড. মাকসুদুল আলম এখানেও সফল হয়েছেন। এরপর মস্কো, হাওয়াই, কুয়ালালামপুর বা ডারবানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে গবেষক দল একের পর এক জীবের প্রাণরহস্য আবিষ্কার করে সাড়া ফেলতে থাকেন।
এরই মধ্যে ঘটে যায় এক চমকপ্রদ ঘটনা। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় ড. মাকসুদুল আলমকে নিয়ে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। আর তাতে চোখ পড়ে আমাদের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। তিনি মাকসুদুল আলমকে দেশে ফিরে এসে পাটের জীন নকশা উন্মোচনের আহবান জানান। দেশপ্রেমী মাকসুদুলও তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ২০১০ সালে মোট ৩০ জন গবেষককে নিয়ে একটি গবেষণা দল তৈরি করেন। এ দলের মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাকসুদুল আলমসহ মোট পাঁচজন গবেষক। তিনি একইসাথে পাট ও পাটের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এক ছত্রাকের জিন সিকুয়েন্স বের করার জন্য গবেষণা শুরু করেন। তিন বছর মেয়াদী সে গবেষণা প্রকল্পের ফল তাঁরা মাত্র এক বছরের মাথায় বের করে আনেন। এ গবেষণার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে ড. মাকসুদুল আলমের জন্য ধরা হয়েছিল মাসে ১৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে তিন বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ছয় কোটি টাকা। কিন্তু ড. মাকসুদুল আলম সে পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। কারণ তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞানকে অভিজাত পর্যায় থেকে একেবারে সাধারণের পর্যায়ে নিয়ে আসা।
ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে গবেষকদল পাটের জন্য ক্ষতিকর যে ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের জন্য গবেষণা শুরু করেছিলেন সেটাও ২০১২ সালে বের করে আনেন। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম Macrophomina phaseolina। এটি উদ্ভিদের নানা ধরণের ক্ষতি করে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্লাইট। এর ফলে উদ্ভিদের আক্রান্ত অঞ্চল শুষ্ক ও বিবর্ণ হয়ে যায়, শিকড় পচে যায় বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মারাত্মক এ ছত্রাকটি পাটসহ প্রায় ৫০০ প্রজাতির স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে। ছত্রাকটির জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলে উন্নত পাটের জাত উদ্ভাবনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে।
ড. মাকসুদুল আলম শৈশবকাল থেকেই মায়ের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৩ এপ্রিল কিশোর মাকসুদুলের বাবা দলিলউদ্দীন আহমেদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তখন স্বামীশোকে কাতর মা লিরিয়ান আহমেদ শক্তহাতে সংসারের হাল ধরেন। সমস্ত বাধা পেরিয়ে সমাজের যোগ্য করে তোলেন নিজের সন্তানদের। মায়ের এ হার না মানা পরিশ্রম সন্তানদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করেছে। মাকসুদুল আলম শুধু নিজেই গবেষণা করে এগিয়ে যাননি। দেশেও তরুণ প্রজন্মকে জীন গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে এখন পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় একটি বায়োটেকনোলজি সেন্টারও স্থাপিত হয়েছে। সেখানে কাজ করছেন একঝাঁক তরুণ জিনোম বিজ্ঞানী।
অন্তিম কাল
দীর্ঘদিন ধরে যকৃতের সমস্যায় ভুগতে থাকা মহৎ এ ব্যক্তি ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৬০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চলে যান।