ইতিহাস

ভারতবর্ষের ঠগি সম্প্রদায়: যাদের কারণে পথে-প্রান্তরে হারিয়ে যেত হাজার হাজার মানুষ1 min read

সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০ 4 min read

author:

ভারতবর্ষের ঠগি সম্প্রদায়: যাদের কারণে পথে-প্রান্তরে হারিয়ে যেত হাজার হাজার মানুষ1 min read

Reading Time: 4 minutes

হালযুগের জনপ্রিয় শব্দ “Thug life”। যদিও এটি মূলত আমেরিকান মিউজিক্যাল ব্যান্ডের নাম। তবুও এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক ইতিহাস। ২০১৯ সালে বলিউডে অমিতাভ বচ্চন এবং আমির খান অভিনীত “থাগস অব হিন্দুস্তান” সিনেমা জগতে বেশ সাড়া ফেলেছিল। সিনেমাটি মূলত তৈরি হয়েছিল মার্কিন লেখক ফিলিপ মেডোস টেলরের “কনফেশন অব এ থাগস” উপন্যাস অবলম্বনে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল যাদেরকে নিয়ে সেই থাগদের সাথে জড়িয়ে আছে নির্মমতার এক ইতিহাস।

ঠগিদের পরিচয়

ইংরেজিতে থাগ (Thug), বাংলায় যাকে বলে ঠগি। এ শব্দের সাথে পরিচয় নেই এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে ঠগিদের ইতিহাস জানেন এমন লোক দূর্লভ। কালের বিবর্তনে ঠগিরা হারিয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতায় তাদের রক্তাক্ত ছাপ কয়েকশ বছর পরেও অক্ষত রয়েছে।

সংস্কৃত শব্দ  ‘ঠগ’ থেকে উৎপত্তি ঠগি শব্দটির। যার অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। ঠগি মূলত একটি বিশেষ শ্রেণীর খুনি সম্প্রদায়ের নাম। এই দস্যু দলটি গামছা বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত নিরীহ পথিকদের। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের হিসেবে, বছরে প্রায় বিশ লক্ষ পথিককে হত্যা করতো ঠগিরা। তেরশো শতক থেকে উনিশশো শতক পর্যন্ত সমগ্র ভারতে তাদের আধিপত্য ছিল।

জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১২৯০ সালে সুলতানদের শাসন আমলে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষে দেখা গিয়েছিল ঠগিদের। সুলতান সেসকল ঠগিদের হত্যা করেননি বরং তাদেরকে নৌকায় তুলে ভাটির দেশ তথা বাংলায় পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন, যেন তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।

১৮১২ সালে বৃটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। সে সময় একটি গণকবরে ৫০টি গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা মৃত দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ১৮৪১ সালে গভর্ণর জেনারেল লর্ড বেন্টিংকের নির্দেশে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ঠগিদের পুরো ভারতবর্ষ থেকে নির্মূল করতে সক্ষম হন।

একদল ঠগি, স্থান- পেশোয়ার (পাকিস্তান), সময়- ১৮৬৫; Photo: npr.org

ঠগিদের কার্যক্রম

ঠগিরা থাকত দলবেঁধে, ছদ্মবেশে। একেক দলে ঠগিদের সংখ্যা থাকত কয়েক’শ পর্যন্ত। তবে পথে বেরিয়ে তারা ভাগ হয়ে যেত ছোট ছোট দলে। একেক দলের একেক বেশ। কোনো দল তীর্থযাত্রী, কোনো দল সাধারণ ব্যবসায়ীর রূপ নিতো। হাটে, ঘাটে, মেলায় কিংবা তীর্থস্থানে সাধারণ লোকজনদের উপর করতো নজরদারি। কারও কাছে টাকা কিংবা মূল্যবান জিনিসের হদিস পেলেই এমনভাবে অনুসরণ করতো যেন কেউ বুঝতে না পারে। এরপর সুযোগ বুঝে দুর্গম কোনো পথে বন্ধুবেশে পরিচিত হতো তাদের সাথে। নিরীহ পথচারীরাও বিশ্বাস করে সঙ্গ দিত তাদের। পথে একসঙ্গে বিশ্রাম, খাবার খাওয়া কিংবা গান বাজনা চলাকালে পথিকরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো না মৃত্যুর পরগণা নিয়ে এসেছে ছদ্মবেশী ঠগিরা।

এদিকে ঝোপ বুঝে কোপ মারার সুযোগে থাকত ঠগিরা। তাদের একটা দলের কাজ ছিলো ছদ্মবেশে পথিকের মন ভোলানোর, সে দলের নাম ‘চামোচি’ । আরেকটা দল সুবিধামতো জায়গা খুঁজে কবর তৈরি করতো, নাম ‘বিয়াল’।  আর দুই দলের মধ্যে সংযোগ রাখার জন্য থাকতো কয়েকজন গুপ্তচর।

ঠগিদের দলে একজন সর্দার থাকতেন। যিনি সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে নির্দেশ দিতেন দলের অন্য সদস্যদের। হত্যাকান্ডের জন্য তারা ব্যবহার করতো একটি হলুদ রং এর রুমাল বা গামছা। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে গামছাটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় দিয়ে একটা রুপোর টাকা কিংবা দুইটা তামার পয়সা বাঁধা থাকতো।

একজন পথচারীকে হত্যা করতে তিন সদস্যের একটি দল গঠন করা হত। এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস পেঁচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।

ঠগিদের গলায় ফাঁস দেয়ার কৌশল

হত্যার পর লাশ গুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হত যেখানে আগে থেকেই কবর খুঁড়ে রাখতো আরেক দল। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগিদের অগ্রবর্তী দলটি তাদেরকে ধরে হত্যা করত। খুন করার পর পথচারীদের সব সম্পদ লুটে নিত তারা। তাতে তাদের খুব যে লাভ হতো তা কিন্তু নয়। কখনো বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। আবার কখনোও জুটতো মোটে মাত্র কয়েক পয়সা। তবে ঠগিরা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।

কেন এই নৃশংসতা?

ঠগিরা মূলত ছিল ধর্মান্ধ। তারা মা ভবানী বা কালী দেবীর উপাসনা করতো। তাদের ধারণা ছিল, তারা নিজেরা মানুষ হত্যা করে না। মা ভবানীই তাদের দিয়ে হত্যা করান। যাকে হত্যা করতে হবে তাকে পাঠিয়ে দেন ঠগিদের সামনে। তাই ওসব মানুষকে মেরে ফেলা ঠগিরা নিজেদের দায়িত্ব মনে করতো।  হিন্দুদের পাশাপাশি ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের ঠগিরাও মা ভবানীকেই ভক্তি করতো।

Photo: wikipedia

বংশপরম্পরা মেনে ঠগিদের বংশধররা একই পেশায় আসতো, তবে সেটা সাবালক হওয়ার পর। সারা বছর আট-দশজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করতো তারা। এমনকি ঠগিদের স্ত্রী-সন্তানরা তাদের পেশা সম্পর্কে জানতো না। কিন্তু বিশেষ সময় এলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরতো দলবেঁধে।

বাংলায় এদের বেশি উৎপাত ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষত বর্ধমান জেলায় এরা নৌপথেও হামলা চালানো শুরু করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ঠগিদের কথা উল্লেখ্য আছে।বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। এমনকি বিখ্যাত বাঙালি গোয়েন্দা ফেলুদার গল্পেও ঠগিদের মতো করে ফাঁস পড়ানোর কথা উল্লেখ আছে।

ঠগি দমন

বেঙ্গল আর্মির অফিসার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ছিলেন বিচক্ষণ এক ব্যক্তি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাধারণ মানুষদের থেকে ঠগিদের আলাদা করা খুব কঠিন। স্লিম্যান তাই গুপ্তচর নিয়োগ করে,গঠন করেছিলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী। এমনকি তিনি তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ঠগিদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ মানচিত্র তৈরি করেন। একপর্যায়ে তিনি ঠগিদের কাজের সময়টুকুও নির্ণয় করে ফেলেন। স্লিম্যানের এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা পরবর্তীতে বেশ ফল প্রদান করে।

১৮৩০ সাল থেকে স্লিম্যানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগিরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে। এদের কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো যাবজ্জীবন জেল দেয়া হয়। এভাবে এক পর্যায়ে ভারতবর্ষ ঠগি মুক্ত হয়।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *