জ্যাক মা: করোনা ঝড়ে চীনের রক্ষাকর্তা1 min read
Reading Time: 5 minutesচীনের উহান শহর থেকে বিস্তার লাভ করা কোভিড-১৯ এখন পর্যন্ত ছড়িয়েছে ১৮৭টি দেশে। সময় যত যাচ্ছে চীনের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাবও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। উহানের ল্যাবরেটরি থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি- একথা বিশ্বাস করেন এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। যারা আবার একথায় ভরসা করেন না তারা চীনাদের খাদ্যাভাস নিয়ে সমালোচনা করছেন। এসবের সাথে যুক্তরাস্ট্রের চীন বিরোধী প্রোপাগান্ডা তো আছেই। সব মিলিয়ে চীনের পক্ষে কথা বলছেন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ দুস্করই বটে। চীন করোনা যুদ্ধে আপাতত বিজয়ী হলেও বৈশ্বিক ভাবমুর্তি উদ্ধারে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এখনো।
চীনের এই দুঃসময়ে কমিউনিস্ট পার্টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেদেশের গ্লোবাল আইকন জ্যাক মা। যিনি চায়নার হারানো সুনাম ফিরে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। জ্যাক মা’কে সবাই চেনেন আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। বিশ্বের অন্যতম ধনী এই ব্যক্তি কিছুদিন আগে নিজের টুইটার একাউন্ট খুলেন। তারপর থেকে বিশ্ববাসী জ্যাক মা’র টুইটার পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারছেন, ঠিক কীভাবে তিনি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় লড়ে যাচ্ছেন এবং বিশ্বের প্রায় প্রতিটি করোনা আক্রান্ত দেশেই চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করার ব্যাপারে অবদান রাখছেন।
“বিশ্ব একটাই, আর তাই করোনা ভাইরাস প্রতিহত করতে আমদের লড়াইও একটাই”- কিছুদিন আগে ঠিক এমন অঙ্গীকারই ফুটে উঠেছে জ্যাক মা’র এক টুইটার বার্তায়। তিনি এখন পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশী দেশে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করার পাশাপাশি বেশ কিছু দেশে উন্নত মানের ফেস-মাস্ক এবং ভেন্টিলেটর সরবরাহ করেছেন।
জ্যাক তার এই ভালো কাজের সাধুবাদ যেমন পাচ্ছেন তেমনি সমালোচনাও আসছে। এই কাজগুলোর পেছনে জ্যাক মা’র উদ্দেশ্য নিয়ে সবাই দ্বিধায় দোদুল্যমান। পুরো বিশ্বের বেহাল এই অবস্থায় জ্যাকের এই সাহসী উদ্যোগ কি নিজেকে কম্যুনিস্ট পার্টির একজন মুখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা? নাকি তার এই স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ দেখিয়ে দলীয় প্রচার প্রচারণার ফায়দা লুটছে কম্যুনিস্ট পার্টি?
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে জ্যাক চায়নার বৈদেশিক কূটনৈতিক নিয়ম-কানুন মেনেই বিভিন্ন দেশকে সাহায্য করছেন। বিশেষ করে কোন দেশকে অনুদান পাঠানো যাবে আর কোন দেশকে যাবে না সেটা কূটনৈতিক নিয়ম মেনেই করা হচ্ছে। তবে জ্যাকের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাকে হয়ত চায়নার অন্যান্য ঈর্ষাপরায়ণ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিহিংসার বেড়াজালে আটকে ফেলতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে যারা অনুদান দিয়ে থাকেন তাদের উপর নজরদারি রাখা একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ‘ক্যানডিড’। ক্যানডিডের তালিকায় বর্তমানে অনুদান দিয়ে যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে আলিবাবার স্থান বারো নাম্বারে। তবে এই তালিকা তৈরিতে শিপমেন্টের বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনায় রাখা হয়নি। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় কোন কোন দেশের কাছে অনুদানের চেয়ে জরুরী সেবার পণ্যগুলো শিপমেন্ট করে দেয়াটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আর সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে আলিবাবা’র নামের পাশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তকমাটি দিতেই হয়।
বর্তমানে যেকোনো পণ্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে শিপমেন্টের জন্য জ্যাক মা’র থেকে বেশী যোগ্য ব্যক্তি দ্বিতীয়জন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিগত মার্চ থেকেই জ্যাক মা ফাউন্ডেশন এবং তার সাথে সম্পৃক্ত আলিবাবা ফাউন্ডেশন আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ সহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় পণ্য সরবরাহ করে আসছে। এমনকি চায়নার জন্য রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকা যেমন ইরান, ইসরায়েল মতো অঞ্চলেও তারা ডেলিভারির কাজ করে আসছে। এইসব কাজের মধ্য দিয়ে যেন বারবার জ্যাক মা’র সেই টুইটটিই ফুটে উঠছে, “পুরো বিশ্ব একটাই আর এই যুদ্ধে আমরা সবাই মিত্র পক্ষের।”
এছাড়া করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য রিসার্চের কাজেও জ্যাক মা বেশ মোটা অংকের অনুদান প্রদান করেছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনামে শিপমেন্টে তার সহযোগিতার কথাই বারবার উঠে আসছে। কেননা জ্যাকের এত উদার সহযোগিতা ছাড়া অনেক দেশের পক্ষেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া অনেক কষ্টকর একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াতো।
জ্যাক মা’র জীবনী লেখক ডানকান ক্লার্ক এই বিষয়ে বলেন, চায়না থেকে যে কোন দেশে বিমানের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষমতা জ্যাক মা’র রয়েছে। কেননা জ্যাক মা’র বিশাল কোম্পানি আর লোকবল মূলত ঠিক এই কাজের জন্যই বিশেষজ্ঞ।
অনুদানে রাজনীতি?
জ্যাকের সমালোচকেরা বলছেন তার এই অনুদানের উপরেও রয়েছে রাজনৈতিক লাগাম! কেননা রাজনৈতিকভাবে চায়নার প্রতিপক্ষ ও প্রতিবেশী দেশ তাইওয়ান এবং তাইওয়ানের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন কোন দেশের কাছে আলিবাবা ফাউন্ডেশন এবং জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের কোন অনুদান এখন পর্যন্ত যায়নি। তবে জ্যাক মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন যাতে সবার কাছেই এই অনুদান পৌঁছায়। কিছুদিন আগে তিনি টুইটারে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে লাতিন আমেরিকার বাইশটি দেশে তিনি অনুদান প্রদান করতে যাচ্ছেন। এই দেশগুলোর সাথে তাইওয়ানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকলেও এরা চায়নার কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম আহবান করেছে। তবে এই দেশগুলোর মধ্যে হন্ডুরাস, হাতিতি এর মতো আরো কিছু দেশ রয়েছে যাদের কাছে জ্যাক মা ফাউন্ডেশন এবং আলিবাবা ফাউন্ডেশনের অনুদান পৌঁছানোর সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।
এই ফাউন্ডেশন দুটোই অনুদান প্রাপ্ত দেশের তালিকা প্রদান করার ব্যাপারে অনিচ্ছা পোষণ করছে বারংবার। অনেক রাজনীতিবিদদের ধারণা এই তালিকাটি প্রকাশ পেলে চায়নার কূটনৈতিক সম্পর্কের উপরে একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া যাবে বলেই হয়ত এই তালিকাটি প্রকাশ করা হচ্ছে না।
জিনপিং এর পাশে জ্যাকের নাম
সে যাই হোক, এই অনুদান প্রদানের বিষয়টি অনেকের কাছেই অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে । অনেক কোম্পানিই এখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার রসদ প্রদান করছে। এদিকে কিউবা এবং এরিত্রিয়াতে হয়ত সামান্য জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বাকি সবগুলো দেশেই চায়না থেকে প্রেরিত শিপমেন্টগুলো সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে।
জ্যাক মা’র বিপুল অনুদান প্রদান অনেকটাই তার সাফল্য হিসেবে পরিস্ফুটিত হচ্ছে। চায়নার গণমাধ্যমগুলোতেও জ্যাক মা এর বীরত্ব গাঁথা ফুটে উঠছে প্রতিনিয়তই। চায়নার কম্যুনিস্ট নেতা শি জিনপিং এর সাথে প্রতিনিয়তই জ্যাককে তুলনা দেয়া হচ্ছে। তবে এই তুলনা জ্যাকের কাছে মোটেও ভালো লাগছে না বরং বলা যেতে পারে এটা তাকে প্রতিনিয়তই অস্বস্তিতে ফেলছে। কেননা একদিকে যখন জ্যাক মা’র প্রশংসা চলছে তখন অপরদিকে এই ভাইরাস রোধে জিনপিং এর ভূমিকা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
ইতোমধ্যেই চীন সরকার বেশ কিছু করোনা আক্রান্ত দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়েছে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে। তবে তাদের এই প্রচেষ্টায় উল্টো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। চায়না সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দেশ ব্যবহৃত এবং ক্রুটি-পূর্ণ সরঞ্জাম পাঠানোর অভিযোগ তুলেছে।
অপরদিকে জ্যাক মা’র শিপমেন্টগুলো নিয়ে এমন কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চীন আফ্রিকা প্রকল্পের ওয়েবসাইট এবং পডকাস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এরিক অলান্দার এ সম্পর্কে বলেছেন, “আসলেই এটা ঠিক যে মা এর অনুদান আফ্রিকা জুড়ে সর্বজনীনভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে।”
জ্যাক মা কি খ্যাতির বিড়ম্বনার শিকার হতে যাচ্ছেন?
অনুদান এবং একই সমান্তরাল রেখায় ক্রমবর্ধমান যশের কারণে কি জ্যাক মা কোন ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছেন? হ্যাঁ! এমন একটি প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মনে প্রায়শই উঁকি দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জিংপিংকে অনেকেই কিছুটা ঈর্ষা পরায়ণ বলেই চিনেন। এখন দেখার বিষয় হল জ্যাক মা’র এত খ্যাতি এবং যশের বিষয়ে জিংপিং এর দৃষ্টিভঙ্গি কি!
জিংপিং এর ঈর্ষাপরায়ণতার ইতিহাস বড়ই কঠিন। অনেকেই ধারণা করেন বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে চীনে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, কয়েকজন বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তার রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হওয়ার পেছনে জিংপিং এর প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। এছাড়া অনেক গণমাধ্যম কর্মীদেরও আশ্রয় হয়েছে কারাগারে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জেল খাটার পরে কেবলমাত্র দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শর্ত মোতাবেক ছাড়া পেয়েছেন।
ওয়াশিংটন ডিসির প্রতিরক্ষা গবেষক এশলে ফেং এর মতে এমনটা গুজব রয়েছে যে আলিবাবা গ্রুপে চেয়ারম্যানের পদ থেকে জ্যাক মা এর পদত্যাগের পিছনেও কম্যুনিস্ট পার্টির হাত রয়েছে। তারা মনে করছিল আলিবাবা গ্রুপের এত প্রচার এবং প্রসারের কারণে হয়ত রাজনৈতিক ভাবে জিংপিং এর প্রভাব অনেকাংশেই স্ফীত হয়ে আসবে। আর তাই অনেকেই মনে করে থাকেন হুট করেই জ্যাক মা পদত্যাগ করেননি বরং তার পদত্যাগের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।
জ্যাক মা’র জীবনী লেখক ডানকান ক্লার্কের মতে, ২০১৭ সালে যখন জ্যাক নিজ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে চীন-মার্কিন বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তখনই তার শেষের শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই মনে করেন এই ঘটনার মাধ্যমেই জ্যাক মা’র আলিবাবা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগের সূত্রপাত ঘটে।
আদতে জ্যাক মা কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টিতে বহিরাগত কেউ নন বরং চীনের এই ধনী পুঁজিবাদী প্রায় ১৯৮০ এর দশক থেকেই কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। জ্যাক মা’র সাথে পার্টির সবসময়েই একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। তবে পার্টির সাথে জ্যাক সম্পৃক্ত থাকলেও কখনই সরাসরি অংশগ্রহণ করেন নি। আর আলিবাবা গ্রুপের সাথেও কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পর্ক নিয়ে মজার ছলে অনেক বিশেষজ্ঞরাই বলে থাকেন, কম্যুনিস্ট পার্টি হল আলিবাবা গ্রুপে এমন একটি গার্লফ্রেন্ড, যার সাথে সম্পর্ক থাকবে কিন্তু কখনো বিয়ে হবে না।”
প্রশংসার ভাগীদার হতে চাচ্ছে চায়না সরকার!
যদিও জ্যাক মা ফাউন্ডেশন সরকারের বিভিন্ন কূটনৈতিক শর্তাবলি মেনেই অনুদান করে যাচ্ছে, তবে চায়না সরকারও এই অনুদানের ফায়দা লুটছে বলে ধারণা করে হচ্ছে। কেননা প্রত্যেক দেশেই যখন জ্যাক মা ফাউন্ডেশন থেকে কোন শিপমেন্ট যাচ্ছে তখন সেই দেশে অবস্থিত চাইনিজ এম্বাসেডররা সেটাকে হাস্যজ্বল মুখে গ্রহণ করছেন। এখানে প্রশ্নটি এসেই যাচ্ছে, যেহেতু অনুদানটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত তাহলে শিপমেন্ট পৌঁছালে সেখানে চায়না সরকারি হস্তক্ষেপ হচ্ছে কেন? তাহলে কি চীন সরকার এই অনুদানের সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রয়েছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে?
জ্যাক মা’র ব্যক্তিগত অনুদানের কারণে চীনের ধ্বসে পরা ভাবমুর্তি কিছুটা হলেও পুনরুত্থান ঘটছে। ব্যক্তিগত হোক আর যাই হোক, এই অনুদানগুলো এবং শিপমেন্টগুলো চায়না থেকেই আসছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
লেখক- ইকবাল মাহমুদ ইকু