জ্বালানিতে ৩০০ বিলিয়নের বিনিয়োগঃ বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কী প্রভাব পড়বে?1 min read
Reading Time: 4 minutes‘কর্ণফুলী নদীতে দিনে পাঁচ হাজার টন বর্জ্য’
এই শিরোনামে গত ১৬ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয় পয়ো ও গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্প ও চিকিৎসা বর্জ্য, নৌযান থেকে ফেলা তেল ও বর্জ্য কর্ণফুলী নদী দূষণের প্রধান কারণ। আশু পদক্ষেপ না নেয়া হলে শীঘ্রই এই নদী নাব্যতা হারাবে এবং শুকিয়ে যাবে।
শুধু এই প্রতিবেদনকে একটি মডেল ধরে পুরো বিশ্বের দিকে তাকালে পরিবেশ দূষণের প্রকৃতি সম্পর্কে আঁচ করা যায়। এমাজন বন পুড়ে ছাই হওয়া, ক্রমান্বয়ে বর্জ্য ব্যবস্থা খারাপ হওয়া, কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা কমার কোনো নাম নেই।
‘দ্য গার্ডিয়ানে’র প্রতিবেদন
১২ অক্টোবর ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বিশাল বোমা ফাটিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্ল্যাকরক, ভ্যানগার্ড ও স্টেট স্ট্রিট– যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই তিন ফাইন্যান্স কোম্পানির মোট ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের খবর দিয়েছে এই পত্রিকাটি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই বিনিয়োগ বিশ্ব পরিবেশে আরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
প্যারিস চুক্তির ফলে এই তিন কোম্পানির সাথে যুক্ত বহু কোম্পানিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষ করে খনিজ জ্বালানি এবং প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো বিরাট ক্ষতির অংক গোনে। ক্ষতি লাঘবে এই তিন ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি ক্রমাগত পরিবেশবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকারীদের চাপ দিয়ে আসছিল।
‘দ্য গার্ডিয়ানের’ এর সাথে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে তৎপর আরেক সংস্থা ‘ইনফ্লুয়েন্স ম্যাপ’ও কাজ করেছে। অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো, বৈশ্বিক উষ্ণতা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা। এছাড়াও ডাটা স্পেশালিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘প্রক্সি ইনসাইট’ও তিন ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানির সম্পদ ও বিনিয়োগ পর্যালোচনার কাজটি করে। এতে দেখা যায়, চীনের জিডিপির চাইতে বেশি অর্থ আছে শুধু এই তিন কোম্পানির হাতেই !
কার বিনিয়োগ কত?
‘দ্য ভ্যানগার্ড গ্রুপ’ মোট ৫.৫২ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, ১.৮১ বিলিয়ন টন কয়লা ও ৩৪.৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য বিনিয়োগ করেছে। এর সিইও ও চেয়ারম্যান হলেন টিম বাকলে। অন্যদিকে ল্যারি ফিঙ্কের ‘ব্ল্যাকরক’ ৩.২৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, ১.৩৫ বিলিয়ন টন কয়লা ও ২১.৭ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাসে বিনিয়োগ করেছে। ‘স্টেট স্ট্রিট কর্পোরেশন’ও পিছিয়ে নেই। রন ও হেনলির কোম্পানি ১.১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল, ০.২৩ টন কয়লা ও ৬.৭০ ট্রিলিয়ন টন কিউবিক ফিট গ্যাসে অর্থ ঢেলেছে।
গবেষণায় পরিলক্ষিত হয়, ২০১৬ সাল থেকে কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল বাণিজ্যের ৩৪.৮% পরিচালিত হয় এদের দ্বারা। এটা বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতিতেও এই তিন তিমির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ‘দ্য গার্ডিয়ানে’র অনুসন্ধানে এও জানা যায়, এই তিন কোম্পানি তাদের শেয়ারহোল্ডারদের মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতো এবং প্রয়োজনে অগ্রাহ্যও করতো। ২০১৫–১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব পরিবেশ সংক্রান্ত নেয়া সিদ্ধান্ত ও পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের ভোট জোচ্চুরি পর্যন্ত করেছে ভ্যানগার্ড ও স্টেট স্ট্রিট।
তথ্য-উপাত্ত যত
‘দ্য গার্ডিয়ানে’র তদন্তে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তা হলো–
১। তেল, কয়লা ও গ্যাস বাণিজ্যের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির মোট ২৮৬.৭ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার আছে এই তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ভ্যানগার্ডের কাছে $১৬১.১ বিলিয়ন, ব্ল্যাকরকের $৮৭.৩ বিলিয়ন এবং স্টেট স্ট্রিটের কাছে আছে ৳৩৮.৩ বিলিয়ন মূল্যের শেয়ার। তবে এর মাঝে ডিরেক্ট শেয়ার এবং তহবিলের অংশ যুক্ত নয়।
২। প্যারিস চুক্তি অনুসারে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে শক্ত অবস্থান থাকলেও তা অগ্রাহ্য করে এই বিনিয়োগ সম্পাদিত হয়। ফলে বিশ্বে নিঃসরিত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১০.৫৯৩ গিগাটন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪.২৮৩ গিগাটনে।
৩। প্রক্সিইনসাইটের তথ্য– উপাত্তে দেখা যায়, ২০১৫–১৯ সাল অব্দি ভ্যানগার্ড ও ব্ল্যাকরক প্যারিস চুক্তিতে যেসব জ্বালানি কোম্পানি সমর্থন জানিয়েছে তাদের সাথে ভ্যানগার্ড ও ব্ল্যাকরক কোন প্রকার আর্থিক লেনদেনে যায়নি।
৪। এই তিন কোম্পানির বহু বিনিয়োগ পরিকল্পনায় ‘পরিবেশবান্ধব’ ও ‘টেকসই’ কথা দুটোর উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটেছে।
তিন কোম্পানির অবস্থান
এই তদন্ত প্রতিবেদনের পর স্টেট স্ট্রিট, ভ্যানগার্ড ও ব্ল্যাকরক কোন প্রকার অস্বীকৃতি জানায় নি। তবে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তারা এই তদন্তকারী দলকে কিছু বিবৃতি প্রদান করেছে।
ভ্যানগার্ডের এক মুখপাত্র জানান, ‘সারাবিশ্বে প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক আমাদের এখানে তাদের সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ জমা রাখে। পাশপাশি ১০ হাজারেরও বেশি কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে এখানে নিয়মিত বিনিয়োগ করছে। তাদের স্বার্থে হলেও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমরা সচেতন। তাছাড়া আমরা নিয়মিত শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসি, ভোটাভুটিও হয়। এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো শেয়ার হোল্ডারদের সুবিধা দেখা। ‘ব্ল্যাকরকের মুখেও প্রায় একই বুলি। তারা জানায়, ‘ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমরা বেশ কিছু টেকসই বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা এমন কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করছি, যারা বৈশ্বিক জলবায়ুতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমাদের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি গবেষক দলও কাজ করছে।‘
‘দেখুন, চাইলেও আমরা কোন প্রতিষ্ঠানকে চট করে বাদ দিতে পারি না। এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফাণ্ডের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। তবে বিনিয়োগকারীরা যদি ESG ( Environment, social and governance) অর্থাৎ সামাজিক,পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় ভাবে সচেতন কোন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।‘ একটু ব্যতিক্রমী ভাবেই জানায় স্টেট স্ট্রিট।
বাড়তি বিতর্ক
তবে শুধু বিবৃতিতেই থেমে যাচ্ছে না বিতর্ক। এই বিনিয়োগে বাধাদানকারী কোম্পানি ডিরেক্টরদের অন্যায়ভাবে সরিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে এই তিন কোম্পানির বিরুদ্ধে।
পরিবেশবাদিরা দূষণ কমানোর লক্ষ্যে নানান পদক্ষেপ পেশ করলেও এর বেশিরভাগই আমেরিকান সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিধিনিয়মের তলে চাপা পড়ছে। গবেষণায় এও দেখা যায় যে, Institutional Shareholder Services এর উপাত্ত অনুযায়ি যুক্তরাষ্ট্রের মোট কোম্পানির এক চতুর্থাংশ তাদের সাধারণ সভায় বিভিন্ন প্রস্তাবনা সংক্রান্ত ভোটাভুটির আয়োজন করে । এর ১০৫ টি প্রস্তাবনার মধ্যে ৭৯ টিই বাতিল বা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিই এই ৭৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল জ্বালানি শিল্পের উত্থানের জন্য দায়ী। এর উপর ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ উস্কে দিয়েছে একে। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির গতিও ত্বরান্বিত হবে।
‘দ্য গার্ডিয়ানের’ এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্বের নানা প্রান্তের পরিবেশকর্মীরা সোচ্চার হয়েছেন আবারও। আশা করা যায়, এই তিন রাঘব বোয়াল শীঘ্রই তাদের সপক্ষের যুক্তি তুলে ধরবেন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আশু পদক্ষেপ নেবেন।