জাসিন্ডা আর্ডার্ন: বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী প্রধানমন্ত্রী1 min read
Reading Time: 3 minutesকোভিড-১৯ মোকাবেলায় আমেরিকা-ইউরোপ-চীনের সরকার যখন হিমশিম খেয়েছে, তখন প্রাণঘাতি এই ভাইরাস মোকাবেলায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নিউজিল্যান্ড। অনান্য দেশের তুলনায় নিউজিল্যান্ড শুরু থেকেই কোভিড-১৯ এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। যার পুরো কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে দেশটির ৪০তম এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্নকে। তবে ভালো কাজের মাধ্যমে আলোচনায় আসা জাসিন্ডার জন্য নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদ হামলার পর ধর্মীয় সহানুভূতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি।
১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টন শহরে জন্ম নেয়া জাসিন্ডা আর্ডার্নের বেড়ে ওঠা মুরুপাড়া (Murupara) নামক নিউজিল্যান্ডের মাউরি আদিবাসী অধ্যুষিত একটি ছোট্ট শহরে। মা-বাবার কনিষ্ট সন্তান জাসিন্ডাকে দারিদ্র্যতা কখনো স্পর্শ না করলেও মাউরি আদিবাসীদের অভাব অনটনের জীবন তার শিশুমনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মুরুপাড়ার অধিকাংশ পরিবার ছিলো দারিদ্র্যতার নিম্ন সীমায়। শিক্ষা দূরে থাক, একবেলা পেট ভরে খাবারই জুটতো না। শহরবাসীর দুর্দশাই পরবর্তীতে তাকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। তিনি চেয়েছিলেন রাজনীতির মাধ্যমে দেশের ছিন্নমূল গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে।
বাবার কর্মসূত্রে শৈশব মুরুপাড়া কাটিয়ে চলে আসেন মরিন্সভিলেতে (Morrinsville)। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইক্যাটোতে (Waikato)। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়েন। ভাগ্যক্রমে লেবার পার্টির নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেন। আর সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই মাত্র ১৭ বছর বয়সেই লেবার পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান জাসিন্ডা। ১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের জেনারেল ইলেকশনে হেরি দাইউন হোবেনের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান তিনি।
স্নাতক শেষ হলে জাসিন্ডা লেবার পার্টির সংসদ সদস্য ফিল গফের অধীনে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে এই অভিজ্ঞতাই তাকে প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ পেতে সাহায্য করেছিল। ২০০৫ সালে তিনি পাড়ি জমান ব্রিটেনে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মন্ত্রীসভার দপ্তরে চাকরি করেন প্রায় আড়াই বছর। ২০০৭ সালে আর্ডার্ন দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সোশ্যালিস্ট ওয়েলথের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কাজের সুবাদে আলজেরিয়া, চীন, ভারত, ইসরায়েল, জর্ডার্ন ও লেবাননসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পান।
২০০৮ সালে জাসিন্ডা লেবার পার্টির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ১৩,০০০ ভোটে পরাজিত হন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের সংবিধানিক নিয়মানুযায়ী তিনি সংসদের সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনীত হন। এতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে দেশের কনিষ্ঠতম রাজনীতিবিদ হিসেবে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরেও রাজনৈতিক দক্ষতার বলে বারবার সংরক্ষিত আসনে সাংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
২০১৭ সালে নির্বাচনের দু’মাস আগে লেবার পার্টির প্রধান পদত্যাগ করলে সেই চাপ পড়ে তাঁর কাঁধে। সভাপতি হিসেবে লেবার পার্টিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। নির্বাচনী প্রচারণায় তরুণদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পান। তাঁকে নিয়ে সে সময় দেশটিতে জনপ্রিয়তার যে ঢেউ উঠে তা ‘জাসিডামেনিয়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। মাত্র দু’মাসের নেতৃত্বে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই লেবার পার্টি নির্বাচনে জয় লাভ করে। দলের প্রধান হিসেবে ২০১৭ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসেও তিনি সবচেয়ে কম বয়সী সরকার প্রধান।
মানবতাকে সাথে নিয়ে চলা জাসিন্ডা বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিশু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ কন্ঠ বারবার জনগণের মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আর এসব কারণে ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি। ছিলেন টাইমস ম্যাগাজিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও।
ক্রাইস্টচার্চের জঙ্গি হামলার কথা মনে আছে? ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ জুম্মার নামাজ চলাকালে ক্রাইাস্টচার্চের একাধিক মসজিদের অতর্কিত হামলা গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং ৫০জন আহত হোন সে হামলায়। অল্পের জন্য বেঁচে যান বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেট সদস্যরা। বিশ্ববাসী আরো অবাক হয়েছিলো নিউজিল্যান্ড সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ দেখে। জাসিন্ডা তাৎক্ষণিক দেশটির অস্ত্র আইন পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। ছুটে যান নিহতদের স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে। নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছিলেন ইসলাম ধর্মীয় মতে৷ নতুন মসজিদ স্থাপন এবং পুরাতন মসজিদ সংস্করণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এই ঘটনার দায়ে অভিযুক্তকে কোনো কার্পণ্য না করেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।
হামলার পরপরই নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট অধিবেশনে তিনি বক্তব্যের শুরুতেই সবাইকে ইসলামি রীতি মেনে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সম্বোধন করেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। বক্তব্যে তিনি বলেন, মুসলিম গোষ্ঠীর সর্বদা পাশে থাকবে কিউই জনগণ। অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে তিনি একাধিকবার পড়েছেন হিজাব। সম্প্রতি সনাতন ধর্মের জন্মাষ্টমী উৎসবেও মন্দিরে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। ভিন্ন ধর্মের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা বিশ্ব দরবারে সৃষ্টি করেছে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷
২০১৮ সালে জাসিন্ডার মা হওয়ার খবরটিও তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলো বিশ্ব গণমাধ্যমে। ২০১৮ সালের ২২ জুন তার কোলে জন্ম নেয় ফুটফুটে কন্যা সন্তান। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বিশ্বের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকার প্রধানের দায়িত্বে থাকাকালে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
সর্বশেষ করোনা মোকাবেলায় একজন আদর্শ প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় নিউজিল্যান্ডকে সাাফল্য এনে দিয়েছেন জাসিন্ডা আর্ডার্ন। এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা কুড়ানো জাসিন্ডাকে নোবেল বিজয়ীর মঞ্চে দেখতে চাওয়া নিয়েও আছে প্রবল জনসমর্থন। তবে এসব না ভেবে জাসিন্ডা আর্ডার্ন ব্যস্ত দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডের জন্য। একজন জাসিন্ডা আর্ডার্ন আছেন বলেই হয়ত সুখী দেশের তালিকায় নিউজিল্যান্ড খানিক উপরেই থাকছে।
লেখক- ঐশ্বর্য মীম