featured বাংলাদেশ

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী: বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার নেপথ্যের সৈনিক1 min read

এপ্রিল ২৯, ২০২০ 4 min read

author:

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী: বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার নেপথ্যের সৈনিক1 min read

Reading Time: 4 minutes

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সবকটি বড় অবকাঠামোর সাথে রয়েছে তার সম্পৃক্ততা। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতুর পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের সুবিশাল কর্মযজ্ঞের নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের গণিত অলম্পিয়াড কমিটির সভাপতি এই মানুষটি একাধারে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সভাপতি হিসেবেও। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) করেছেন অধ্যাপনা। ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আর বর্তমানে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য। এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত এই অসাধারণ মানুষটি এখন আর নেই দুনিয়াতে। তাই তাঁর সব কাজ এখন আমাদের কাছে কেবলই স্মৃতি।

তিনি একাধারে খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। গত ২৮ এপ্রিল ভোর চারটায় ৭৮ বছর বয়সে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব ।

১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী । তাঁর পিতা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মাতা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই আর দুইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় । তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সাথে চলে যান আসামের জোড়াহাটে। ১৯৪৭ এ আবার ফেরত আসেন সিলেটে।

১৯৫৭ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং ১৯৫৯ সালে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকান ঢাকা কলেজে। এরপর ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। একই বছর বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে স্কলারশিপ পেয়ে তিনি ইংল্যান্ড যান। এরপর ১৯৬৮ সালে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে বুয়েটে  পুরোদমে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি এবং ১৯৭৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হন।

২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটের অধ্যাপক ছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের আরেক কৃতি সন্তান স্যার ফজলে হাসান আবেদের অনুরোধে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ গ্রহণ করেন। সর্বশেষে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি ।

একজন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়েও সরকারের বিভিন্ন পরামর্শক প্যানেলে ডাক পড়েছে জামিলুর রেজা চৌধুরীর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সফটওয়্যার রপ্তানি ও আইটি টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবেও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন।

আরও পড়ুন- তাজউদ্দীন আহমদঃ ইতিহাসের অন্তরালে ইতিহাসের নায়ক

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত একজন “আবেদ ভাই”

আরও পড়ুন- প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম: সরলমনা কিংবদন্তী এক বিজ্ঞানী

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সের ফেলো জামিলুর রেজা চৌধুরী বিদ্যুৎ,জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেখভালের দায়িত্বও পালন করেছেন ১৯৯৬ সালে ।

ছোটবেলা থেকেই পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল প্রকৌশলী বাড়ির ছেলে। বাবা ভাই সহ পরিবারের অনেকেই ছিলেন প্রকৌশলী। বড় হয়ে বাবা ভাইদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও বেছে নেন একই পেশা। মেধাবী মানুষটি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতেন গণিত। সংখ্যার প্রতি ছিল প্রবল অনুরাগ। সে ভালোবাসা বড়বেলাতেও এসে কমেনি একরত্তি। অবশ্য যে পরিবারে তাঁর ভাইবোনেরা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, বাবা ম্যাট্রিকুলেশনে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র, রাতের খাবার টেবিলে বসে যাদের গণিত নিয়ে চলত জম্পেশ আলোচনা, সে পরিবারের ছেলের এমন গণিত প্রীতি থাকাটাই বরং স্বাভাবিক। ছোট বেলা থেকেই বাড়িতে আসা বিভিন্ন পত্রিকায় গণিতের ধাঁধা সমাধান করতে ভালোবাসতেন তিনি ।

যানজটে নাগরিক জীবন যখন ভীষণ অতিষ্ট তখন সামনে থাকা গাড়ীর নম্বর নিয়ে দুই সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল রূপে প্রকাশ করার মজার খেলায় মেতে উঠতেন তিনি। আর রোজ সকালে চা খেতে খেতে নিয়ম করে মেলাতেন সুডোকু। অবসরে ম্যাগাজিনের ধাঁধার সমাধান করতেই ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে।

অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মানুষটি ১৯৫২ থেক ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হওয়া ছাত্রদের নাম এক নিঃশ্বাসে বলে দিতে পারতেন। এমনকি অর্ধশত বছর আগের কলেজ সহপাঠীদের রোল নম্বর বলেও চমকে দিতেন পারতেন।

তার হাত ধরেই বাংলাদেশে কম্পিউটার ভিত্তিক পড়াশোনার শুরু হয়। স্বাধীনতার কিছুকাল পূর্বে যখন দেশে হাতে গোনা কিছু কম্পিউটার ছিল তখন জামিলুর রেজা চৌধুরীর তত্ত্ববধানে দেশে প্রথমবারের মতন বুয়েটে কম্পিউটারভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়। তিনিই ছিলেন দেশের প্রথম কম্পিউটার শিক্ষক। উল্লেখ্য, দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এই জামিলুর রেজা চৌধুরীর হাত ধরেই।

তিনি গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু থেকেই এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ মিলে প্রথম আলোয় নিউরনে অণুরণন নামে একটি পাতা চালু করেন। এতে গণিতের বিভিন্ন সমস্যা প্রদান করা হত ও পাঠকেরা সেসবের উত্তর দিয়ে জিতে নিত পুরষ্কার। পরবর্তীতে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট পরিসরে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হয়। এতে ব্যাপক সাড়া মেলে। পরবর্তীতে তারা গণিত উৎসবের পরিকল্পনা করেন। এরপর প্রথম আলো পত্রিকা ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের সহযোগিতায় দেশে সর্বপ্রথম আয়োজন করা হয় গণিত উৎসব। তাদের এসব কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে  অংশগ্রহণ করে।

বিজ্ঞানমনস্ক দেশপ্রেমিক এই শিক্ষাবিদের স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানের যেকোনো একটি শাখায় কোনো বাংলাদেশী যেন নোবেল পুরষ্কার লাভ করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ডাক পেয়েছিলেন আরেক খ্যাতনামা বাংলাদেশী প্রকৌশলী এফ আর খানের কাছ থেকে। কিন্তু যান নি।

এত বড় প্রকৌশলী হয়েও দেশে কেন রয়ে গেলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন অদ্ভুত সুন্দর কথা।

“অনেকবার সুযোগ পেয়েছি, কখনো শিক্ষক হিসেবে, কখনো পরামর্শক হিসেবে। আবার আমার সমসাময়িক প্রায় সবাই বিদেশে চলে গেছেন। সেই মানসিক চাপ অনুভব করতাম। কিন্তু সবসময় মনে হয়েছে, এই দেশকে কিছু দিতে হবে। অনেকটা বিনা পয়সায় পড়েছি। এ দেশেরও তো প্রাপ্য আছে”। 

এখন পর্যন্ত দেশ বিদেশে বিভিন্ন কাজের জন্য সম্মানিত এই মানুষটির এখনো অব্দি ৬৯ টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলো ছিল মূলত বহুতল ভবন নির্মাণ, স্বল্প খরচে আবাসন, ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের নকশা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে ইমারত রক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশল নীতিকে কেন্দ্র করে । ১৯৯৩ সালে তার হাত ধরেই দেশের ইমারত বিধি আইনের সূত্রপাত।

তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ জুটেছে অসংখ্য সম্মাননা ও পুরষ্কার। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক পাওয়ার অভিজ্ঞতা যেমন আছে তেমনি তার ঝুলিতে আছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি। সবশেষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে পান রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক। ঐ বছরেই জাপান সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানজনক ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন’ খেতাব প্রদান করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ঘোষিত হন এই বরেণ্য প্রকৌশলী।

দেশের বিভিন্ন খাতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া এই সাধাসিধে মানুষটা দেশের প্রতি সবসময়ই ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। দেশকে দিয়ে গেছেন অনেককিছু।

শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশা কিংবা নীতিনির্ধারণী কাজ সবকিছুতেই সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। সফলতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন বহুবার। কেবল স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত থাকেন নি। কাজ করেছেন নিরলসভাবে আর দেশকে দিয়েছেন নিজের সবটুকু। এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেও জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন নিরহংকার,সদালাপী আর সুবক্তা। এই অসাধারণ মানুষটির মৃত্যুতে যেন এক কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটল। আর বাংলাদেশ তার এক সূর্যসন্তান কে হারালো।

লেখক- মাহের রাহাত 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *