জামাল ভূঁইয়া: বাংলার ফুটবলের নতুন দূত!1 min read
Reading Time: 3 minutesমোনেম মুন্নার কথা মনে পড়ে? সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে কি অসাধারণ খেলাটাই দিয়েছেন সেই আশির দশকে। ছয় নম্বর জার্সিতে মোনেম মুন্না হয়ে উঠেছিলেন পুরো দেশের আইকন। ইউনিলিভারের মতো কোম্পানি তাকে করেছিল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। কিডনি জটিলতায় মোনেম মুন্না যখন অবসরে গিয়েছেন তখনো এদেশে ফুটবল জেগে ছিলো। আলফাজ, কাঞ্চন, হাসানুজ্জামান, আমিনুল সহ আরো অনেকেই ছিলেন। কিন্তু আইকনিক হয়ে ওঠা হয়নি কারোরই।
এরপর পেরিয়েছে অনেক দিন। মোনেম মুন্নাও পাড়ি জমিয়েছেন অন্যভুবনে। দেশের ফুটবল পেছাতে পেছাতে যখন অন্ধকারে গিয়ে ঠেকেছে সেইসময় নতুন আরেক আইকন পেল বাংলাদেশ। জার্সি নাম্বার মোনেম মুন্নার মতোই ৬। খেলেনও একই রকম সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে। জাতীয় দলের তৎকালীন কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন, “মোনেম মুন্না ওয়াজ মিস্টেকনি বর্ন ইন বাংলাদেশ।“ তবে আমাদের নতুন এই তারকার জন্ম বাংলাদেশে না। বলছিলাম, জাতীয় দলের বর্তমান অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার কথা। দ্য নেক্সট বিগ থিং ইন বাংলাদেশ ফুটবল।
জামাল ভূঁইয়ার শুরুটা খুব একটা সহজ ছিল না। বাবা ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন ডেনমার্ক। সেখানেই জামালের জন্ম। ফুটবল পাগল জামালের হাতেখড়ি এফসি কোপেনহেগেনের একাডেমীতে। এফসি কোপেনহেগেন এদেশের ফুটবলের পাড়ভক্তদের কাছে অজানা কিছু নয়। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কিংবা ইউরোপা লিগের পরিচিত মুখ এই ডেনিশ ক্লাবটি। শৈশবে জামাল সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন কিংবদন্তী ফুটবলার মাইকেল লউড্রপের সন্তানদের। ফুটবলার হবার সবকিছুই তার অনুকূলে ছিলো। কিন্তু বাদ বাঁধে এক দূর্ঘটনা।
জামাল ভূঁইয়া তখন সতেরো বছর বয়সী। স্থানীয় এক দোকানে দুজনের কথা কাটাকাটি থেকে শুরু হয় গোলাগুলি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে উপস্থিতি ছিলেন জামালও। শরীরে চারটা গুলি নিয়ে জামালকে হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর মাঝে কাটাতে হয় তিনটি মাস। সুস্থ হবার পর অনেক বড় একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হন জামাল, আবার আগের মতো উদ্যম নিয়ে ফিরতে পারবেন তো ফুটবল মাঠে? কিন্তু দেখা যাক না কি হয় ভেবে আবার শুরু হয় জামালের ফুটবল পদযাত্রা।
এফসি কোপেনহেগেন থেকে যাত্রা শুরু আবার। এরপর জামাল ঘুরেছেন আরো কিছু জায়গায়। ফিলিপাইনের স্ট্যানলিয়ন্স এফসিতেও খেলেছেন কিছুদিন। যেবার প্রথম দেশে এসেছিলেন, সেবার ঢাকার জ্যামে বসে মাকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ কি সবসময় এমন? বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে যে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছিল জামালের তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১১ সালে জাতীয় দলে ট্রায়ালের সময়। ট্রায়ালে জামাল টিকতে পারেন নি। কিন্তু আশাহত না হয়ে দেশের হয়ে খেলার তাগিদ থেকে ২০১৩ সালে আবার ঠিকই এলেন। তবে এবার ভুল করলেন না। আগে দশদিন থাকলেন। এরপর ট্রায়াল। সে সময়ের কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের মন জয় করে নিতে সময় লাগেনি জামালের। শুরু হয় বাংলাদেশের ফুটবলে জামালের পথযাত্রা।
২০১৩ সালের নেপালে হওয়া সাফে বাজিমাত করেন জামাল। ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতি থেকে ফিরিয়ে আনেন মোনেম মুন্নাকে। লোডভিক ডি ক্রুইফের মতে তিনি বাংলাদেশের রয় কিন কিংবা নাইজেল ডি জং। শ্রীলঙ্কার কোচ নিকোলা কাভাজোভিজ সরাসরিই বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের নাম জামাল ভূঁইয়া। ২০১৫ সালে জামাল শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে চুক্তিবদ্ধ হন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। শেখ রাসেল হয়ে এখন আছেন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে।
ধীরে ধীরে জাতীয় দলের পোস্টার হয়ে ওঠা জামালের পুরো পথচলা যদিও মসৃণ ছিলো না। ২০১৫ সালে বাছাইপর্বে বাংলাদেশের বাজে পারফর্মের দায় অনেকটা তার উপরেই চাপিয়েছিলেন দেশের মিডিয়া কর্মীরা। জাতীয় সঙ্গীতই যে গাইতে পারেনা সে কেন জাতীয় দলে থাকবে এমন কথাও বলেছেন শীর্ষস্থানীয় কিছু সাংবাদিক।
সকল সমালোচনার উত্তর মাঠে ফেরত দিতে দেরি করেননি জামাল। ২০১৪ সালের কিংস কাপ আর ২০১৫ সালের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সেরা খেলোয়াড়ের নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৬ সালের কেরালা সাফের পর গুঞ্জন উঠে দলের অধিনায়কই হবেন জামাল ভূঁইয়া। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পর সত্যিই অধিনায়ক হলেন এই প্রবাসী ফুটবলার।
পরের গল্পটা তো সবারই জানা। সময়ের সাথে সাথে জামাল নিজেকে পরিণত করেছেন দেশের ফুটবল আইকনে। সদ্য সমাপ্ত শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপের ফাইনালে হারার পরও জামালের জার্সি নিয়ে চট্রগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে সেটা হয়ত এদেশের ফুটবলে এবারই প্রথম।
এখন পর্যন্ত অধিনায়কের আর্মব্যান্ডের মর্যাদা বেশ ভালোভাবেই রক্ষা করেছেন জামাল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ভারত। র্যাঙ্কিংয়ে ভারত আমাদের চেয়ে ৮৩ ধাপ এগিয়ে। ভারতের যুবভারতী স্টেডিয়ামের ৮৮ হাজার দর্শকের স্বপ্ন সুনীল ছেত্রীর হ্যাট্রিক। কিন্তু কিসের কি! বাংলার জামাল দাগালেন কামান। ৪২ মিনিটে বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে ফ্রি-কিক। জামালের জাদুতে বিভ্রান্ত ভারত। বিভ্রান্ত গোলরক্ষক, বিভ্রান্ত পুরো যুবভারতী। সিলেটের সাদ বল যখন জালে ঢোকালেন, তখন দেশে যতটা না সাদের নাম উঠেছে তার চেয়ে বেশি রব উঠেছে জামাল ভূঁইয়ার নামে। ম্যাচ ড্রতে শেষ হলেও জামাল ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফুটবল দলের একটি বিজ্ঞাপন হয়ে থাকবে এই ম্যাচ।
এতকিছুর ভিড়েও অমায়িক জামাল। নিয়মিত ভক্তদের সামনে হাসিমুখে দাঁড়াচ্ছেন। স্বপ্ন দেখছেন দেশকে নিয়ে। হামজা চৌধুরী যেখানে লেস্টার সিটি আর ইংলিশ স্বপ্ন ছাড়তে পারছেন না, সেখানে জামাল রয়ে গেলেন দেশের টানে। বর্তমানে ফিফা র্যাঙ্কে বাংলাদেশ ১৮৪ নাম্বারে। সামনের পথ অনেক কঠিন। কিন্তু তাতে কি? আমাদের জামাল ভূঁইয়া আছে না!