featured বাংলাদেশ

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম: সরলমনা কিংবদন্তী এক বিজ্ঞানী        1 min read

অক্টোবর ২৭, ২০১৯ 3 min read

author:

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম: সরলমনা কিংবদন্তী এক বিজ্ঞানী        1 min read

Reading Time: 3 minutes

বাংলাদেশে মৌলিক বিজ্ঞান ও গবেষণা বিস্তারে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আমাদের প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের মৌলিক বিজ্ঞান মহলেও তিনি ছিলেন সর্বাধিক সমাদৃত ও আলোচ্য ব্যক্তি। বিশ্ববিখ্যাত এ গুণী বিজ্ঞানীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহে। ঝিনাইদহ ছিল তাঁর বাবার কর্মক্ষেত্র, তবে পিতৃভূমি চট্টগ্রামে।

শিক্ষাজীবন

প্রফেসর জামাল শিক্ষা জীবনের শুরুটা অতিবাহিত করেন কলকাতায়। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।  তারপর চলে আসেন এপারে, ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে।

প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বৃত্তিসহ বিএসসি সম্মান পাশ করেন এবং পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গণিতে ট্রাইপসে তিন বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন দুই বছরে। এরপর ১৯৬০ সালে মাস্টার্স ও ১৯৬৪ সালে প্রায়োগিক গণিত এবং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের উজ্জ্বল এ নক্ষত্র অর্জন করেছিলেন অতি দুর্লভ ও অত্যন্ত সম্মানজনক ডিএসসি (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি যা কিনা সারা পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞানী অর্জন করতে পেরেছেন।

অধ্যাপনা

১৯৬৩-৬৫, এই সময়কালে প্রফেসর ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। এর দুই বছর পর ১৯৬৭ সালে তিনি কেমব্রিজে আসেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। এর পরের দুই বছর তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) পরিদর্শক অধ্যাপক ছিলেন।

১৯৭৩-৭৪ এই দুই বছর প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৫-৭৮ সময়কালে ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৮-৮৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে।

গবেষণার পরিধি

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে প্রকাশ করেছেন ৫০ এরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ। বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে এসব নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় জামাল নজরুল ইসলামের ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ নামের একটি বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পরপরই গোটা বিশ্বের মহাকাশবিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। বইটির অন্তর্নিহিত রস আস্বাদনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ফলে খুব দ্রুত জামাল নজরুল ইসলামের বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে যায়। এই বইটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ‘ক্ল্যাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামের আরেকটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই বইটিও বিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়। মহাবিশ্ব নিয়ে লেখা প্রফেসর ইসলামের ‘ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স’ গ্রন্থটিও বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানমহলে সমাদৃত হয়েছে। মহাকাশ বিজ্ঞানে তাঁর অবদান আইনস্টাইনের সমতুল্য বলে বিবেচনা করা হয়।

কসমোলজিস্ট প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম মূলত মহাকাশ ও সৌরজগতে লুক্কায়িত রহস্যের সমাধান করতে চেয়েছেন। তিনি চিন্তা করতেন, যদি সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ একই সরলরেখায় চলে আসে তবে পৃথিবীর উপর এর কোন প্রভাব পড়বে কি না। পরে তিনি অঙ্ক কষে আমাদের জানান যে, এটা কখনো সম্ভব নয়।

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজ ও অন্যান্য জগদ্বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাকালীন সময়ে সাহচর্য পেয়েছিলেন অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ফ্রিম্যান ডাইসন, পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, ভারতীয় সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচী, ভারতের বিখ্যাত জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকার, পাকিস্তানের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস প্রমুখ। আর স্টিফেন হকিং তো ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু।

স্বদেশের টানে, স্বদেশের তরে

প্রফেসর নজরুক ইসলাম ত্রিশ বছরের অভ্যস্ত পশ্চিমা ধাঁচের জীবনধারা, গবেষণার অপরিসীম সুযোগ, গুণীজনের সাহচর্য, বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও সেইসাথে লোভনীয় বেতন এ সব কিছু ছেড়ে ১৯৮৪ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। যোগদানকালীন সময়ে তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র তিন হাজার টাকা। তিনি কখনো বিদেশে স্থায়ী হতে চান নি। তিনি বিশ্বাস করতেন বিদেশে থেকে অন্য সব সুবিধা পেলেও দেশের মানুষের কাছে তাঁর যে অবস্থান আর গ্রহণযোগ্যতা সেটা কখনোই বিদেশে পাওয়া সম্ভব না।

দেশে ফিরে এসে অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও প্রফেসর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতর গবেষণাগার— রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স। এখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার জন্য ছাত্রদের বিভিন্ন সহায়তার পাশাপাশি বহু আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছেন। এসব সেমিনারে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি বিখ্যাত গবেষকরা আসতেন। কিন্তু হতাশাজনক ব্যাপার হলো, সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে আজ এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানটি আমরা হারাতে বসেছি।

প্রচলিত জটিলতার গেঁড়াকলে আটকে পড়া

প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত মানব দরদী ও সরলমনা। খুব সহজেই তিনি মানুষকে বিশ্বাস করতেন। আর তাঁর আশপাশের মানুষগুলো এ সুযোগ কড়ায়গণ্ডায় আদায় করেছিল। বিনিময়ে তিনি সেসব মানুষদের কাছে চরম ঠকেছেন। তিনি চট্টগ্রামের নানা সংস্থা ও উদ্যোগে জড়িয়ে যান। সমাজের নানা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, চরমপন্থীদের আক্রোশ, অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি দেখে তাঁর মন কেঁদে উঠত। পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে নিজের বেতনের সব টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন এমন উদাহরণও আছে।

তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এমন একদিন আসবে যেদিন সমাজ থেকে দূর হবে সকল অন্যায় আবিচার, পূর্বদিগন্তে উদিত হবে প্রেরণার নতুন এক সূর্য। সেই স্বপ্ন নিয়েই প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ আমাদের ছেড়ে চলে যান।

 লেখক- নিশাত সুলতানা                                                                    

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *