সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির গুপ্তহত্যা1 min read
Reading Time: 4 minutes১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর দুপুর সাড়ে বারোটায় ঘটে গিয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর একটি। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি গুপ্তহত্যার স্বীকার হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডি ডালাসে একটি ক্যাম্পেইন পরিদর্শন করার জন্য মোটরগাড়ির শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। তাকে বহনকারী গাড়ীটি যখন টেক্সাস স্কুলের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই তাঁকে গুলি করা হয়েছিল। সাথে সাথে চালক কেনেডিকে নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘাড়ে ও মাথায় গুলি লাগায় তাঁকে আর বাঁচানো যায় নি। সেইসময় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৬ বছর।
আমেরিকান জনগোষ্ঠী কোনদিনও এ হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলতে পারবে না। যদিও এ গুপ্তহত্যা একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল, তথাপি এটা ছিল পরাশক্তি মার্কিন জাতির জন্য চরম অপমানজনক।
ঐদিনই দুপুর দুইটা পনেরো মিনিটে লি হার্ভে ওসওয়াল্ড নামের এক মেক্সিকান নাগরিককে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং ডালাসের পুলিশ কনস্টেবল জে ডি টিপিটকে গুলি করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। সে ডালাসের লাইব্রেরিতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিল। ঠিক দুই দিন পর অর্থাৎ ২৪শে নভেম্বর, স্থানীয় এক নাইটক্লাবের মালিক এবং পুলিশের সংবাদদাতা জ্যাক রুবি ওসওয়াল্ডকে গুলি করেন। আর সে ঘটনাটি সরাসরি টিভিতে সম্প্রচারও করা হয়।
এখন আসি মূল ঘটনায়। কে এই ওসওয়াল্ড? মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার মতো দুঃসাহস কোথায় পেল? আর কেনোই বা ঘটাল এ হত্যাকান্ড?
লি হার্ভে ওসওয়াল্ডের অতীত
ওসওয়াল্ড ১৯৩৯ সালে ওরলিয়ান্সে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের দুই মাস আগে হার্ট অ্যাটাকে তার বাবা মারা যান। শিশুকাল থেকে ওসওয়াল্ড বিভিন্ন এতিমখানায় বড় হতে থাকে। যখন তার বয়স বারো তখন তার মা তাকে নিয়ে নিউইয়র্কে আসেন। নিউইয়র্কে স্কুল পালানোর অপরাধে তাকে একটি সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। বন্দী অবস্থায় সে সমাজতন্ত্র নিয়ে জানার জন্য খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ওসওয়াল্ড নিজ ভূমি ওরলিয়ান্সে ফিরে যায় এবং ১৯৫৬ সালে মেরিন একাডেমীতে যোগদান করে। সেখানে সে খুব দক্ষ শুটার হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ওসওয়াল্ড মার্কসবাদ নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করে।
১৯৫৯ সালে মাত্র চার বছরের মাথায় ওসওয়াল্ডকে সম্মানসূচক পদবী দিয়ে মেরিন একাডেমি থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যায়। সেখানেও তাকে আড়াই বছরের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তবে তাকে কেজিবি এর নিয়ন্ত্রণে সে দেশে থাকতে দেওয়া হয়। ওসওয়াল্ড সোভিয়েত ইউনিয়নে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ওরলিয়ান্স মেরিন একাডেমি ওসওয়াল্ডকে দেওয়া সম্মানসূচক পদবী ১৯৬২ সালে ফিরিয়ে নেয় এবং তাকে ‘অনাকাঙ্খিত’ বলে আখ্যা দেয়। পরের বছর ওসওয়াল্ড তার রাশিয়ান স্ত্রী এবং ছোট্ট কন্যা সন্তানকে নিয়ে পুনরায় টেক্সাসে ফিরে আসেন।
সেখানে কিছুদিন থাকার পর ওসওয়াল্ড একটি টেলিস্কোপযুক্ত রাইফেল এবং একটি রিভলভার কিনেন। রাইফেল কেনার কয়েকদিনের মধ্যেই ওসওয়াল্ড যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এডউইন এ ওয়াকারকে হত্যার চেষ্টা করে। ওয়াকার ছিলেন কমিউনিজমের কট্টর সমালোচক। এরপর ১৯৬৩ সালে ওসওয়াল্ড ভাবলেন আবার মেক্সিকোতে ফিরে যাওয়া যাক। কিন্তু যাওয়ার পথে কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাঁধা দেয় যার ফলে তাকে আবার টেক্সাসে ফিরে আসতে হয়। সেখানে এসে সে ডালাসের টেক্সাস স্কুলের বুক ডেপজিটরে কাজ শুরু করে।
সাংবাদিক জিরাল্ড পজনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ওসওয়াল্ডের প্রেসিডেন্ট কেনেডির উপর কোন ক্ষোভ ছিল না। বরং প্রেসিডেন্ট যে আন্দোলনে (কমিউনিজম বিরোধী) সাড়া দিয়েছিলেন তা সে মেনে নিতে পারে নি। পজনার আরও বলেছেন, “সে আমেরিকাকে ঘৃণা করত। সে পুঁজিবাদকে ঘৃণা করত। তাই সে যখন সুযোগ পেল এর (পুঁজিবাদের) বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর,সে তাই করল, যা এতদিন চেয়েছিল”।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং গভর্নর হত্যা
হত্যাকান্ড তদন্তকারীদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ওসওয়াল্ড সেদিন একাই লাইব্রেরির ষষ্ঠ তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের একটি জানালা দিয়ে তিনটি বুলেট ফায়ারিং করে। তিনটি গুলিই ঠিকঠাক লক্ষভেদ করেছিল। প্রথম গুলিটি প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে ও দ্বিতীয়টি তাঁর মাথায় লাগে। সাথে সাথে তিনি পাশে বসা স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডির উপর ঢলে পড়েন। আর তৃতীয় গুলিটি একই গাড়িতে থাকা টেক্সাসের গভর্নর জন বি কোনালির পিঠে লাগে। ঐ গাড়িতে তাঁর স্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর অবশ্য চিকিৎসার পর বেঁচে গিয়েছিলেন। উন্মাদ ওসওয়াল্ডকে ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি সিনেমা হলের পেছন থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ড্যান রেদার সিবিএস নিউজের এক প্রতিবেদনে বলেছেন, “২৪ বছর বয়সী ওসওয়াল্ড বামপন্থী রাজনীতির একজন কট্টর সমর্থক, এফপিসিসি (Fair Play for Cuba Committee) এর সক্রিয় সদস্য, রাশিয়া ও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর অন্ধভক্ত এবং একসময়ের রাশিয়ার বাসিন্দা।” তিনি আরও বলেছেন, যখন তিনি ওসওয়াল্ডকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন তখন সে তার দোষ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বলেছিল, “আমি কাউকে গুলি করি নি, না স্যার … আমি শুধু ভাগ্যবানদের একজন।”
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনের শপথ গ্রহণ
লিন্ডন বি জনসন ২.৩৮ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দূর্ঘটনার সময় বি জনসন কেনেডির চেয়ে তিন গাড়ি পেছনে ছিলেন। জ্যাকুলিন কেনেডির গায়ে তখনও রক্তমাখা গোলাপী স্যুটটি দেখা যাচ্ছিল। তিনি সঙ্গী জন এফ কেনেডির কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর ম্যারিল্যান্ডের বেথেসডা নেভাল হাসপাতালে কেনেডির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
“এটা সকলের জন্য একটা দুঃখের সময়। আমরা অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।” এটা ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে লিন্ডন বি জনসনের প্রথম বক্তব্য। তিনি আরও বলেন, “এটা আমার জন্য অত্যন্ত শোকের বিষয়। আমি জানি এই দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য সাড়া পৃথিবী মিসেস কেনেডি ও তাঁর পরিবারের পাশে আছে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তার মানে আমি যা পারি তার সব করব। আমি আপনাদের সাহায্য কামন করছি— এবং ঈশ্বরের।”
১৯৬৩ সালের ২৩ নভেম্বর জনসন নভেম্বরের ২৫ তারিখকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে ঘোষণা করলেন।
লি হার্ভে ওসওয়াল্ডকে হত্যা
নভেম্বরের ২৪ তারিখ, রবিবার সকালে ওসওয়াল্ডকে সমস্ত প্রেসের সামনে দিয়ে ডালাসের পুলিশ হেডকোয়ার্টারস থেকে কাউন্টি জেলে প্রেরণ করা হচ্ছিল। “ডালাস পুলিশ কয়েদীদের নিরাপত্তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন কেননা কিছুক্ষণ আগে পুলিশ হেফাজতে ওসওয়াল্ডকে কোন এক দুর্বৃত্ত গুলি করে। আমরা জানি যে ওসওয়াল্ড ছিল বিংশ শতাব্দীর ঘৃণ্যতম অপরাধী” — কথাগুলো KRLD রেডিওতে বলছিলেন বব হুফাকার নামক এক ব্যক্তি।
জ্যাক রুবি একটি ছোট ক্যালিভার পিস্তল দিয়ে ওসওয়াল্ডের পেটে গুলি করেন। ওসওয়াল্ডেরও মৃত্যু পার্কল্যান্ড হাসপাতালে হয় যেখানে ঠিক দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যু হয়েছিল।
নভেম্বরের ২৬ তারিখে রুবিকে ওসওয়াল্ড হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যু দন্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এ মমলাটির জন্য পুনরায় আদালতে আপিল করা হয়। কিন্তু নতুন কিছু বেরিয়ে আসার আগেই ১৯৬৭ সালে ফুসফুস ক্যান্সারে জ্যাক রুবির মৃত্যু হয়।
জন এফ কেনেডির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
নভেম্বরের ২৫ তারিখে কেনেডির কফিনটি রোটান্ডা থেকে গোলা-বারুদ সজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে করে ক্যাথলিক সেন্ট মেথিউ এর প্রধান গীর্জায় আনা হয়। এসময় পুরো কফিনটি যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা দিয়ে মোড়ানো ছিল। ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, প্রেসিডেন্টকে চিরবিদায় জানানোর জন্য আট লাখেরও বেশি সাধারণ মানুষ পেনসিলভেনিয়া এভিনিউয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। জন এফ কেনেডিকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় এলিংটন ন্যাশনাল সিমেট্রিতে দাফন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি জরিপের মাধ্যমে নতুন এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র খুব স্পষ্টভাবে এটা বলেছে যে লি হার্ভে ওসওয়াল্ড একাই কেনেডি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, তারপরও মাত্র ৩৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক একথা বিশ্বাস করে। তাদের মতে ওসওয়াল্ডের পেছনে আরও ষষড়যন্ত্রকারী ছিল যারা এখনও অপ্রকাশ্য।