বাংলাদেশ

নিরহংকারী অহিংস বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু1 min read

ডিসেম্বর ১, ২০১৯ 5 min read

author:

নিরহংকারী অহিংস বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু1 min read

Reading Time: 5 minutes

আমরা ছেলেবেলায় প্রথম যে বিজ্ঞানীর নাম শুনেছি তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু। আর বিজ্ঞানে তাঁর কী অবদান সেটাও আমরা সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই শুনেছি। তখন অত শত না বুঝলেও এটা ঠিকই আত্মস্থ করেছিলাম, গাছেরও যে প্রাণ আছে তা জগদীশ চন্দ্র বসুই আবিষ্কার করেছেন। তবে তিনি শুধু উদ্ভিদবিজ্ঞানীই ছিলেন না, একইসাথে পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানেও সমান মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়

জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের মুন্সীগঞ্জ (বর্তমানে বাংলাদেশে) এলাকায়। বাবা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী। তিনি ছিলেন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং বর্ধমানসহ কয়েকটি অঞ্চলের সহকারী কমিশনার।

ছেলেবেলাতেই দেশপ্রেমের বীজ বপন

শিশু জগদীশের হাতেখড়ি মায়ের হাতে। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে ইংরেজি স্কুলে পড়বে, এটা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু ভগবান চন্দ্রের রক্তে দেশপ্রেম মিশে আছে যে! ভগবান চন্দ্র বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাগ্রহণের জন্য সবার আগে চাই মাতৃভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করা এবং দেশপ্রেমকে অন্তরে ধারণ করা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে আগে মাতৃভাষাটা ভালোভাবে শেখাবেন। তারপর না হয় বিদেশী ভাষা শেখা যাবে। এতে করে খুব সহজেই শিশু জগদীশের মনে দেশপ্রেম জেগে উঠবে। সে ভাবনা থেকেই জগদীশ চন্দ্র বসুকে গ্রামের বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তিনি গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানদের সাথে একসাথে মিলেমিশে পড়াশোনা করেছেন। তাদের সাথে খেলাধুলা করেই বড় হয়েছেন মহাবিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। আভিজাত্যের ছোঁয়া কখনও তাঁকে গ্রাস করে নি।

জগদীশ চন্দ্র বসুর উচ্চতর শিক্ষাজীবন

১৮৬৯ সালে গ্রামের স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জগদীশ চন্দ্র পা বাড়ান কলকাতায়। প্রথমে ভর্তি হন কলকাতা হেয়ার স্কুলে। এরপর ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। সেখান থেকে ১৮৭৫ সালে প্রবেশিকা (বর্তমান মাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে তিনি যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়নকালে জগদীশ সেখানকার খ্রিস্টান যাজক ফাদার ইউজিন ল্যাফোন্টের নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেন। ফাদার ছিলেন অত্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী। তাঁর কাছ থেকেই মূলত জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রকৃতি অনুসন্ধান করার মানসিকতা তৈরি হয়। জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৭৯ সালে বিএ পাশ করেন।

উদ্ভিদের স্নায়ুতন্ত্র বিষয়ে বক্তৃতারত বসু (প্যারিস, ১৯২৬) Credit: wikipedia

বিএ পাশ করার পর ভাবলেন এবার চাকরি করতে হবে। সেজন্য তিনি বাবার কাছে আইএসসি (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু বাবা ভগবান চন্দ্র অনুমতি দিলেন না। যদিও তিনি একজন সরকারি চাকুরে ছিলেন, তবুও তিনি চেয়েছিলেন ছেলে দরিদ্র মানুষের উপকারে আসবে এমন কিছু নিয়ে পড়ুক।

তাই বাবার ইচ্ছেতে জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৮০ সালে ডাক্তারী পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেতে পাড়ি জমান।  ভর্তি হন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগে। কিন্তু বেশিদিন সেটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। মেডিসিনের তীব্রতা ও লাশঘরের লাশের দুর্গন্ধে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। ফলে অগত্যা তিনি ডাক্তারী পড়া ছেড়েই দিলেন।

এরপর জগদীশ চন্দ্র বসুর ভগ্নিপতি বিশিষ্ট বিতার্কিক আনন্দমোহন বসুর সুপারিশে ভর্তি হন কেমব্রিজের ক্রাইস্টস কলেজে। অতঃপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যাচারাল সায়েন্সে বিএ (Tripos) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৮৮৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

স্বদেশের টানে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন

জ্ঞান অর্জন তো অনেক হলো, এবার বাবার স্বপ্ন পূরণের পালা। ১৮৮৫ সালে জগদীশ ফিরলেন দেশের মাটিতে। ভারতবর্ষে তখন যতগুলো শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, তাদের মধ্যে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ছিল অন্যতম। প্রেসিডেন্সিতে তখন বাঙালী বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক ছিল হাতেগোনা। এমতাবস্থায়ও ভারতের গভর্নর জেনারেলের অনুরোধে স্যার আলফ্রেড ক্রফট জগদীশ চন্দ্র বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করেন।

গভর্নরের অনুরোধে জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কর্মস্থলে পদে পদে তাঁকে পোহাতে হয়েছিল নানা জটিলতা। প্রেসিডেন্সি কলেজের ততকালীন অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি ছিলেন চরম বাঙালী বিদ্বেষী। টনি সাহেব জগদীশ চন্দ্র বসুর বেতন অন্যান্য ইউরোপীয় শিক্ষকদের বেতনের অর্ধেক করে দিলেন। আর গবেষণা করার সুযোগের তো প্রশ্নই উঠে না। এত অপমানের প্রতিবাদস্বরূপ বসু অর্থকষ্টের বোঝা কাঁধে নিয়ে টানা তিন বছর বিনা বেতনে অধ্যাপনা চালিয়ে যান। তাঁর এমন নিরব প্রতিবাদের সামনে মাথা নত করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। তারা জগদীশ চন্দ্র বসুর বেতন ইউরোপীয় শিক্ষকদের সমতুল্য করতে বাধ্য হয়।

গবেষক জগদীশ

এত প্রতিকূল পরিবেশেও জগদীশ চন্দ্র বসুর অন্তরে লালিত বিজ্ঞানপ্রেম বাস্তবে রূপদান করতে থাকেন। সারা দিন ক্লাস নেওয়ার পর তাঁর ছোট্ট অফিস কক্ষে সীমিত যন্ত্রপাতি দিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। হাজারো বাঁধা উপেক্ষা করে মনোবল না হারিয়ে সামনে এগুতে থাকেন। আর এই কঠিন সময়টাতে যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে তাঁকে সঙ্গ দেন বিশিষ্ট সমাজসেবী স্ত্রী অবলা বসু।

একে একে রচনা করেন অসংখ্য গবেষণা পত্র। আর সেগুলোকে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশ করেন। এত নগন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে ভারতবর্ষের মতো পশ্চাৎপদ একটি দেশে থেকে তিনি এত গবেষণা করেছেন দেখে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যায়। দিকে দিকে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, রয়্যাল ইন্সটিটিউট, লন্ডন, ১৮৯৭ সন। Credit: wikipedia

জগদীশ চন্দ্র বসু তার গবেষণা জীবনে মূলত অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এ তরঙ্গ কোন তারের সাহায্য ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানী হার্জ যে কাজ অসমাপ্ত রেখে মারা যান সেটা বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু সফলভাবে সম্পন্ন করেন। তিনি সর্বপ্রথম পাঁচ মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ আবিষ্কার করেন। এ তরঙ্গ ছাড়া আজকাল রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের কথা চিন্তাই করা যায় না। বিজ্ঞানী মার্কনি জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কৃত বেতার তরঙ্গের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে রেডিও আবিষ্কার করেন।

জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই গবেষণা করেন নি, তিনি উদ্ভিদ নিয়েও বিশেষ গবেষণা করেছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানে তাঁর অসংখ্য অবদানের মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ, উদ্ভিদ দেহের উত্তেজনার বেগ মাপার যন্ত্র রিজোনাস্ট রেকর্ডার অন্যতম। রিজোনাস্ট রেকর্ডার আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই জগদীশ চন্দ্র বসু জনসমক্ষে উদ্ভিদের প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।

বিজ্ঞান লেখক বসু

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র গবেষণা করেই ক্ষান্ত হন নি। সহজ বাংলা ভাষায় নিজের গবেষণা লিখে রেখে গিয়েছেন আগামী প্রজন্মের জন্য। তাঁর লেখা বহু বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো:  Responses in the living and non-living (1902), Plant responses as a means of physiological investigations (1906), Comparative electro physiology (1907), Nervous mechanism of plants (1925), Collected physical papers (1927), Motor mechanism of plants (1928) ও Growth and tropic movements in plants (1929)।

জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। সেই খাতিরেই রবীন্দ্রনাথ জগদীশের কাছ থেকে জানতেন বিজ্ঞানের নানা অজানা তথ্য আর জগদীশ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহিত্যরস আহরণ করতেন। বিজ্ঞানী বসু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ (The story of the missing one)। পরে এটিকে ‘পলাতক তুফান’ নামে সংকলন করে ‘অব্যক্ত’ নামক রচনাসমগ্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ‘অব্যক্ত’ ছোটদের জন্য বাংলায় লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশন। এ বইতে জগদীশ চন্দ্র বসু সরল বাংলায় বিজ্ঞানের নানা জটিল সমস্যা খুব সাবলীল ভাষায় লিখেছেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বাঙালী বিজ্ঞানীদের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু; Credit: wikipedia

কৃতীর কৃতিত্ব

অদম্য ইচ্ছা আর অধ্যবসায় থাকলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে সফল হওয়া যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসু। আর বাঙালিরাও যে গবেষণায় পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের চেয়ে কোন অংশে কম যায় না, বরং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে তাদেরকে ডিঙিয়ে উচ্চাসন গ্রহণ করতে পারে তা জগদীশ চন্দ্র বসু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

যদিও বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর গবেষণা বা আবিষ্কারের জন্য জীবদ্দশায় কোন পেটেন্ট গ্রহণ করেন নি, তারপরও বিজ্ঞানী সমাজ রেডিও তরঙ্গের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অকপটে স্বীকার করেন। তাঁকে বেতার যোগাযোগের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস’ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে বিজ্ঞানী নিউটন, গ্যালিলিও প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সমতুল্য মনে করে। বিজ্ঞানের মহাপুরুষ আইনস্টাইন বলেছেন, “জগদীশ চন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত”।

১৯১৬ জগদীশ চন্দ্র বসুকে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২০ সালে তাঁকে রয়েল সোসাইটির ফেলো করা হয়। তিনি ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। বরেণ্য এ বিজ্ঞানী ১৯২৮ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। তিনি ছিলেন ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। ১৯৩৭ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।

বিশ্ব নন্দিত বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *