“এক দেশ দুই নীতি” ও চীন-হংকং সম্পর্কের টানাপোড়ন1 min read
Reading Time: 5 minutesবিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের সাথে যুক্ত রয়েছে এমন কিছু দেশ যেগুলো প্রশাসনিক দিক থেকে চীনের আওতাভুক্ত। যেমন হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান। এই তিনের মধ্যে বর্তমানে হংকং অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। হংকং চীনের অধীনস্ত হলেও এতে চালু আছে “এক দেশ দুই নীতি” পদ্ধতি। আজকে আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ সেই নীতি ও হংকং এর সাথে চীনের বর্তমান সম্পর্কের টানাপোড়েন।
এক দেশ দুই নীতি
প্রাচীনকালে হংকং চীনেরই অংশ ছিল। ১৮৪১ সালে ব্রিটেন প্রথম আফিম যুদ্ধের সময় হংকং নিজ দখলে নিয়ে নেয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৪২ সালে নানকিং (Nanking) চুক্তির ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বীপটি ব্রিটেনের অধীনে আসে। সেই ১৮৪২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দেড়শ বছরেরও বেশি সময় হংকং ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই গোটা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার ভাঙ্গনের সূচনা হয়। তবে সেই সময়টাতেও ব্রিটিশরা কৌশলগত কারণে হংকং এ নিজেদের শাসন অব্যাহত রেখেছিল। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমলে হংকং এ ব্রিটিশরা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ইয়ং প্ল্যান প্রস্তাবসহ বেশ কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তন সাধন করে। যার কারণে হংকং এর জনগণ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন থেকেও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে থাকে। সেই সময়টায় চীনে চলছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। যার কারণে গোটা চীনেই ছিল অস্থিরতা। ১৯৪৯ সালের পর থেকে চীনে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ব্যপক হারে পরিবর্তন আসায় সে সময়টায় গণতন্ত্রপন্থী চীনারা হংকং এর গণতান্ত্রিক শাসনামলের অধীনে আসতে হংকং এ পাড়ি জমাতে শুরু করে। মেইন ল্যান্ড চীন থেকে আগত বিপুল সংখ্যক জনগণ আর শরণার্থীদের দক্ষতা এবং মূলধনের ফলে চাঙ্গা হতে শুরু করে হংকং এর অর্থনৈতিক কাঠামো। সে সময়টায় অনেকগুলো বিদেশী সংস্থা সাংহাই থেকে হংকং এ তাদের সদর দপ্তর স্থানান্তর শুরু করে। যার কারণে হংকং এ শিল্প কারখানার প্রভূত উন্নতি হয় এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় আসে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্রুত বদলাতে থাকে হংকং এর অর্থনীতির পরিধি।
হংকং এর উন্নতির সাথে সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে এর মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। ১৯৮০ এর দশকে হংকং ইস্যুতে চীনাদের সাথে ব্রিটিশদের আলোচনা শুরু হয়। তৎকালীন চাইনিজ নেতা দেং জিয়াওপিং সাংবিধানিক নীতির দ্বারা একক চীন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। যেখানে হংকং তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বহাল রেখে চীনের সাথে যুক্ত থাকবে। তাছাড়া বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে আলাদাভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেও বাধা দেওয়া হবেনা এমন কথাও বলা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে চীন-ব্রিটেন আলোচনা সাপেক্ষে যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে।
এই ঘোষণাপত্রই হংকং এর সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হিসেবে সূচিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের জুনে হংকং এর জন্য মৌলিক নীতি সমূহ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে চীনা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৮৮ সালে এই কমিটি হংকং এর মৌলিক আইন সংক্রান্ত প্রথম খসড়া প্রদান করে। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে যার দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশ করা হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৪ই এপ্রিল চীনের বিশেষ অঞ্চল হিসেবে হংকং এর জন্য মৌলিক আইন গৃহীত হয়।
১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং এর জন্য গৃহীত মৌলিক আইনটি কার্যকর হয়। যার ফলে হংকং ব্রিটিশদের অধীনতা মুক্ত হয়ে হয়ে চীনের বিশেষ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আর এরই মাধ্যমে অভিনব ‘এক দেশ দুই নীতি’ ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। এর মেয়াদ ৫০ বছর। অর্থাৎ ১৯৯৭ থেকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত। কিন্তু এর পরে কি হবে সেটি এখনো কেউ জানে না। বেইজিং থেকে এ ব্যাপারে কোন রকম ইঙ্গিত এখনো দেয়া হয় নি। আরেকটি তথ্য উল্লেখ করা দরকার। মাঝে ১৮৯৮ সালে বৃটিশ সরকার এবং চীনের ছিং (Qing) ডাইনেস্টি “সেকেন্ড কনভেনশন অফ পিকিং” নামের একটি চুক্তি করে। এই চুক্তিতে লন্ডন চীনকে ৯৯ বছর পর ১৯৯৭ সালে হংকং ফিরিয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছিল।
একদিকে চীনের সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, অন্যদিকে হংকং পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। “এক দেশ দুই নীতি” ব্যবস্থায় চীনের কর্তৃত্ব থাকলেও হংকংকে বহুলাংশেই এককভাবে চলার ক্ষমতা দেয়া হয়। হংকং এর প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলো অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
এর ফলে হংকং চীনের অধীনে থাকলেও তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল। হংকং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা এপেক ও ওয়াল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এর সদস্যপদ লাভ করে। হংকং দ্বিপাক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলের সাথে বিমান পরিষেবা পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া হংকং ও চীনের মধ্যকার সীমানা দুটি পৃথক দেশের আন্তর্জাতিক সীমানার মতোই নজরদারি করা হয়। ভিসার মতোই অনুমতি লাগে হংকংবাসী বা চায়নিজদের একে অপরের ভূখন্ডে যাতায়াতের ক্ষেত্রে।
একদেশ দুই নীতির ফলে হংকং যেমন অতীতের অনেক কিছুই বহাল রেখেছে, তেমনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও এনেছে। হংকং থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের রাণীর ছবি যুক্ত টাকা ও ডাকটিকিট বিলুপ্ত করা হয়েছে। হংকং এর প্রধান নির্বাহী নির্বাচনের জন্য আছে বারো সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ কমিটি। অতীতে ব্রিটিশ নাগরিকরা ভিসা ছাড়াই এক বছর হংকং এ কাজ করার সুযোগ পেত। সেই নিয়মটিও বর্তমানে বাতিল করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে হংকং-চীন সম্পর্কে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হংকং এর গণতন্ত্রকামীরা হংকং এর বিদ্যমান স্থানীয় সরকারকে বেইজিং চালিত পুতুল সরকার হিসেবে অভিহিত করে। মাঝে হংকং এ বৃহত্তর গণতন্ত্র চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটিও ব্যর্থতার মুখ দেখেছে এই সরকারের আমলেই। হংকং এর পুলিশ বাহিনীকে বলা হতো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুলিশ বাহিনী। বর্তমানে সেটিও চীনের বাধ্যগত বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
এ অবস্থায় অনেকেই হংকং এর স্বাধীনতা দাবী করছে। ফলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে বৈকি। মধ্যমপন্থীদের মতে দুই পক্ষের সমঝোতার অভাবেই আজ এ দশা। তবে অধিকাংশ হংকংবাসীর দাবী চীন তাদের স্বায়ত্বশাসনের পূর্ণ মর্যাদা দিচ্ছেনা।
আন্দোলনের শুরু যেভাবে
২০১৯ সালের জুনে হংকং এ চীন বিরোধী সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ দেখা যায়। ২০১৮ সালে এক হত্যাকান্ডের জের ধরে পরিস্থিতি এত দূর গড়ায়।
কাহিনী অনেকটা এমন- এক হংকং নাগরিকের বিরুদ্ধে তাইওয়ানে ছুটি কাটাতে গিয়ে অন্তঃস্বত্তা বান্ধবীকে খুন করার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তাইওয়ানের সাথে হংকং এর বন্দী বিনিময় করার কোনো চুক্তি না থাকায় বিচারের জন্য সেই ব্যক্তিকে তাইওয়ানে পাঠানো সম্ভব হয় না। এই প্রেক্ষিতে হংকং থেকে তাইওয়ান ও চীনে অপরাধী প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত একটি বিলের প্রস্তাব করা হয়। কথিত এই অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৯ জুন রাতে হংকং এর প্রায় ৫ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। বেইজিং এর দূর্বল আইন ও মানবাধিকার রেকর্ডের কারণে হংকংবাসী কাউকে সেখানে পাঠানো নিরাপদ মনে করে নি। তারা মতে এই বিল পাশ হলে হংকং এর আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের হস্তক্ষেপ আরো বেড়ে যাবে।
এ ছাড়া হংকং এর রাজনৈতিক নেতারদের বিভিন্ন অযুহাতে চীনে নিয়ে বিচারের মুখোমুখী করা হবে। লাখো মানুষের উত্তাল আন্দোলনের মুখে বিলটি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় হংকং এর চীনপন্থী শাসক ক্যারী ল্যাম। এবং শেষমেশ বিলটি বাতিল করা হয়।
২০৪৭ সালে “এক দেশ দুই নীতি” এর মেয়াদ শেষ হলেও হংকংবাসী মনে করে চীন এখন থেকেই হংকং এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
এদিকে এ বছর গত ১ল জুলাই হংকং এর জন্য চীনা পার্লামেন্টে হঠাৎ পাশ করানো হয় বিশেষ নিরাপত্তা আইন। এই আইন কার্যকর করার মধ্য দিয়ে হংকং এর বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন কার্যত ধূলিস্যাত হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। আর আইনটির বিরোধিতায় আবারো নতুন করে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।
কি আছে নতুন আইনে?
এই আইনে বলা হয়েছে হংকং এর মাটিতে চীনা সার্বভৌমত্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার চেষ্টা সন্ত্রাসবাদী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে চীন বিরোধী বিক্ষোভ আয়োজন, গণপরিবহন ও সরকারি সম্পত্তি ভাংচুর, বিদেশী শক্তির সাথে গোপন আঁতাত সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করা হবে। এসব কর্মকান্ডের জন্য নতুন আইনে আজীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে অর্থদন্ড।
নতুন আইনের আওতায় হংকং এ নতুন একটি নিরাপত্তা দপ্তর স্থাপন করবে চীন। এই দপ্তরের চীনা কর্মকর্তারা আইন লঙ্ঘনকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার কাজ করবে। এই বিচারের ক্ষেত্রে পুরোটা জুড়েই থাকবে চীন সরকারের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ। আর এই আইনের ফলে খর্ব হবে হংকংবাসীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মূলত গত বছরের গণআন্দোলন দেখেই চীন এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এমনটাই বলছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
এই আইন প্রণয়নের প্রতিবাদস্বরূপ তাৎক্ষণিকভাবেই বিক্ষোভ হয়। এতে আটক হয় শতাধিক। আর এই আইনের সমালোচনা করেছে পশ্চিমা দেশগুলোও।
ব্রিটেন একে চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে। এছাড়া পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন হংকং এর সাড়ে তিন লাখ অধিবাসীর ব্রিটিশ পাসপোর্ট রয়েছে। এখনকার আরো ২৬ লাখ অধিবাসী চাইলে পাঁচ বছরের জন্য ব্রিটেনে চলে আসতে পারে। এরপর তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে করার সুযোগ পাবে। একই সুবিধা দিতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়াও।
এছাড়া হংকং ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ। দেশটি বলছে , নতুন এই আইন হংকং এর অধিবাসীদের স্বাধীনতা বঞ্চিত করবে যা চীনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। তবে চীন একে নিজেদের অভ্যন্তরীন ইস্যু বলছে। জাতিসংঘে কিউবাসহ অন্তত ৫০টি দেশ এই ইস্যুতে চীনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এমন অবস্থা আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বরাজনীতিকে নতুন করে দুই মেরুতে বিভক্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর নতুন আইনের ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে হংকংবাসী। চীনের উদ্দেশ্য এখানে সুস্পষ্ট। হংকং এ বিক্ষোভ আর বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব চীন বরদাশত করতে চাইছে না। আর ধীরে ধীরে ভূখন্ডটিকে মূল চীনের সাথে জুড়ে দিতে চাইবে।
মাত্র ২৩ বছরেই কোণঠাসা হয়ে দাঁড়ালো হংকংবাসীর স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা। এরপর হয়ত হংকংকে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করতে আরো বড় ও কঠোর কোন পদক্ষেপ নেবে চীন।
লেখক- মাহের রাহাত