চীন যেভাবে করোনাভাইরাস জয়ের পথে1 min read
Reading Time: 4 minutesচীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে ১৫০টিরও বেশি দেশে। করোনার আতঙ্ক যেন দাবানলের মতোই পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করছে। সব কিছু এত দ্রুত লয়ে ঘটছে যে ঘন্টাখানেক আগের তথ্য মুহুর্তেই পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পেজে কিংবা তাদের ওয়েবসাইটে মিনিটে মিনিটে নতুন তথ্য সবরাহ করে যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত চীনের বাইরে আরো ৬টি দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারের মাত্রা অতিক্রম করেছে। দেশগুলোর মধ্যে আছে ইতালি (আক্রান্ত- ৪১,০৩৫; মৃত্যু- ৩,৪০৫), স্পেন (আক্রান্ত- ১৯,৯৮০; মৃত্যু- ১,০০২), ইরান (আক্রান্ত- ১৯,৬৪৪; মৃত্যু- ১,৪৩৩), জার্মানি (আক্রান্ত- ১৬,২৯০; মৃত্যু- ৪৪), যুক্তরাষ্ট্র (আক্রান্ত- ১৪,২৫০; মৃত্যু- ২০৫), ফ্রান্স (আক্রান্ত- ১০,৮৯১; মৃত্যু- ৩৭১)।
এত অস্থিরতার মধ্যে আশার কথা হচ্ছে চীন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। স্থানীয়ভাবে নতুন করে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত ২ দিনে শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছে চীন। চীনের স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে কেবল চীনের বাইরে থেকে আসা নাগরিকেরাই।
ভাইরাস দমনে চীনের কর্তৃত্ববাদী সরকার মানবাধিকার আমলে না নিয়ে যেমন কঠোর হয়েছে, অন্য দেশগুলো তেমন কঠোর হবে কিনা সেটি সময়েই বলে দেবে। কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের দেশে চীনের সরকার ও স্বাস্থ্য কমিশন যেভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করলো তা ইতিহাসের পাতায় যথাযথ সন্মান দিয়েই লেখা হবে।
১.
করোনাভাইরাসের শুরুটা মোকাবিলায় চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং কিছু রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন সার্সের মতো নতুন একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। লি ৩০ ডিসেম্বর তার সহকর্মীদের সতর্ক করে বার্তা পাঠান। লিয়ের বার্তা প্রাদেশিক সরকারের কানে পৌছালে তারা সেটি গুরুত্বের সাথে না নিয়ে উল্টো “সামাজিক শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত” করার অভিযোগে লির থেকে মুচলেকা আদায় করে তাকে সতর্ক করেন।
এর মধ্যে অজানা কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উহানে বাড়তে থাকে। উহানের প্রাদেশিক সরকার পরিস্থিতি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানায়। কিন্তু তত দিনে যা দেরি হওয়ার হয়ে গেছে। করোনাভাইরাস সাথে নিয়ে উহান থেকে হাজার হাজার মানুষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো চীনে। কেন্দ্রীয় সরকার জানুয়ারির ২৩ তারিখে উহান শহর পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করে। উহান শহরের ৫ কোটির বেশি মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে “হোম কোয়ারিন্টিনে” থাকতে বাধ্য করে।
২.
কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে করোনাভাইরাসের তীব্রতা ও ভয়াবহতা বুঝে দ্বিতীয় কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ভুল করে নি। সেই সাথে “সময়” তাদের পক্ষে কাজ করেছে। যে সময় উহান লক ডাউন করা হয় সেসময় “চীনা বর্ষপূর্তি” উপলক্ষে চীনের বড় শহরগুলো এমনিতেই ফাকা হয়ে পড়েছিল। তাই অন্য শহরের দিকে বাড়তি নজর দেয়ার দরকার পড়েনি।
এরপর পরিস্থিতি বুঝে সরকার অতি দ্রুততার সাথে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সরকার শুরুতে চীনা নববর্ষের ছুটি বিভিন্ন প্রদেশ ভেদে অন্তত ১০ দিন বর্ধিত করে। ছুটির মেয়াদ শেষ হলে ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফেরা নাগরিকদের আবার ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক “হোম কোয়ারিন্টিন” নিশ্চিত করে সরকার। এই অর্থে সব শহরই লক ডাউন হয়ে যায়। এতে উহানের বাইরে করোনাভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়।
৩.
সময়ের সাথে সাথে চীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ মিলিয়ে যায় (কিংবা তারা চুপ হতে বাধ্য হয়)। চীনের সাধারণ জনগণ উহানের আক্রান্তদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সবাই একতাবদ্ধ হয়। চীনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী উহানে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ায়।
উহানে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলা নতুন আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে তড়িঘড়ি করে উহানে ১০০০ থেকে ১৩০০ শয্যার দুটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়। যার একটি নির্মাণে সময় লাগে মাত্র ৬ দিন, আরেকটি নির্মাণে লাগে ১৫ দিন।
এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টার, স্টেডিয়াম অত্যন্ত দ্রুততার সাথে অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারে পরিণত করা হয়। যার সুফল পেতেও সময় লাগেনি।
৪.
চীন সরকার প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা সামগ্রী উহানের পাশাপাশি সারা দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেই সাথে করোনাভাইরাস নির্ণয়ের টেস্ট এবং আক্রান্তদের যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করবে বলে ঘোষণা দেয়। এতে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। মানুষ নিজ থেকে সচেতন হয়ে ভাইরাস টেস্ট করাতে হাসপাতালে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে গুয়ানদং শহরের কথা। এই শহরে ৩,২০,০০০ হাজার মানুষ করোনাভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করান। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ০.৪৭% মানুষ করোনায় আক্রান্ত ছিল।
সিটি স্ক্যান এবং পিসিআর টেস্টের পর করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে এমন সবাইকে হয় হাসপাতালে পাঠানো হতো, না হয় আইসোলেশন সেন্টারে।
৫.
চীন সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে। মূহুর্তের মধ্যেই ভালো-মন্দ যেকোন তথ্য বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখন, কোথায় কী ভুল হচ্ছে সেটি যেমন তদারকি করতে পারছিল, তেমনি সাধারণ জনগণ সব তথ্য জানতে পেরে আতংকিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় থাকতে পেরেছে।
চাইনিজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ওয়েইবো, ইউচ্যাটে সাধারণ জনগণের জন্য সার্বক্ষণিক তথ্য হালণাগাদ করা হতো।
এছাড়া প্রযুক্তির কারণে চীনের স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় বিন্দু মাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি। চীন তাদের প্রায় ২২ কোটি শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা অত্যন্তভাবে করতে পেরেছে। প্রযুক্তি নির্ভর পেশায় যারা আছেন তাদেরও কাজ-কর্ম চালিয়ে নিতে কোন বেগ পেতে হয়নি।
৬.
চায়নার সকল মানুষ ঘরে থাকলেও খাবারের সাপ্লাই চেইনে কোন ব্যাঘাত ঘটতে দেয় নি সরকার। বিভিন্ন সুপার সপের অ্যাপ দিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাবার এবং গৃহস্থালি দ্রব্যাদি কোন ঝামেলা ছাড়াই অর্ডার করতে পারতো। আর চীনের কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে বিপদের সময় পণ্যের দাম বাড়াবে এমন সাহস আছে কার?
করোনাভাইরাস সব দেশের শক্ত পরীক্ষা নিবে এটি নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই বুঝতে পেরেছেন। গত প্রায় দুই মাসে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রাদেশিক সরকার, প্রাদেশিক সরকার থেকে রুট লেভেলের কর্মীদের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। মুহুর্তেই রুট লেভেলের সমস্যা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পৌছেছে আর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ রুট লেভেল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। করোনার মুখোমুখি দাঁড়ানো দেশগুলো অন্য কিছুতে চীনকে অনুসরণ না করলেও চীনের করোনাভাইরাস প্রতিরোধ মডেলটি অনুসরণ করতে পারে।
abdullah
U have written exellent