চীনে ২ কোটি মোবাইল সিম কোথায় গেল?1 min read
Reading Time: 3 minutesচীন- প্রযুক্তি, আবিষ্কার আর উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে দেশটি গত দু’দশক শীর্ষস্হান দখল করে রেখেছে। তবে আবিষ্কারের দিক থেকে যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে দেশটি, ততটাই হতে হয়েছে সমালোচনার স্বীকার। গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান শহর থেকে সংক্রমিত ভাইরাস কোভিড-১৯ নিয়ে সারাবিশ্বে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। ভাইরাসটি যতটা ছড়িয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ষড়যন্ত্রের নানা তত্ত্ব। তবে ঘুরে ফিরে অভিযোগের আঙুলটা তোলা হচ্ছে চীনের দিকেই।
চীনকে ঘিরে এসব আলোচনা-সমালোচনার মাঝে অনেক গণমাধ্যমে খবর বের হয় চীন থেকে প্রায় ২কোটি মোবাইল সিম কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশটি করোনাভাইরাসের প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছে এবং এই ভাইরাসে দেশটির এক কোটিরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম এমন দাবি করেছে বলে খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা। সঙ্গতকারণেই তাদের ধারণা চায়না সরকার কোভিড-১৯ এ মৃতের তথ্য গোপন করতে চাচ্ছে।
চীন যদিও দাবি করছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৮৪,৩৬৯ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৪৬৩৬। সংক্রমণের শুরুতেই ১ কোটি লোকের শহর উহানকে লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। যাকে শক্ত কারণ হিসেবে দেখিয়ে চীন দাবি করেছে করোনা সেদেশে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদি অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ১০,৯৫,৬৪৫ জন করোনা রোগীর মধ্যে মারা গেছেন ৬১ হাজারের কিছু বেশী। যুক্তরাজ্য ১,৭১,২৫৩ জন আক্রান্তের মধ্যে মারা গেছেন ২৬,৭৭১। স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা ২,৩৯,৬৯৩ এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪,২৫৩। এসব সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে বলা চলে করোনার উৎপত্তি চীনে হলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় এদেশেই আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা অনেক কম।
আরও পড়ুন- চীন থেকে কেন নতুন সব ভাইরাস ছড়ায়
গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২ কোটি গ্রাহক হারিয়েছে চীনের মোবাইল সিম কোম্পানিগুলো। ধারণা করা হচ্ছে চীনের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ তাদের ব্যবহৃত অতিরিক্ত সিমগুলো বন্ধ করে ফেলেছে। যার প্রধান কারণ হতে পারে ব্যবসায় লোকসান কিংবা চাকরি হারানো।
চীনের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবাদানকারী কোম্পানিগুলার বিস্তারিত তথ্যানুসারে, চীনে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা হঠাৎ করে দেড় কোটিরও বেশি কমে যায়। চীনের সিম কোম্পানি চায়না মোবাইল লিমিটেড বলছে তাদের গ্রাহক ঘাটতি প্রায় ৭০ লক্ষ। চায়না ইউনিকম হংকং লিমিটেড হারিয়েছে ৭৮ লক্ষ গ্রাহক। যা ঘটেছে মাত্র বছরের প্রথম দুই মাসেই।
দ্রুত বিপুল সংখ্যক গ্রাহক হারিয়ে ফেলে বিপাকে পড়েছে চীনের তিন বড় মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান।গ্রাহক হারানোর প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠান তিনটির শেয়ার দরে। আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে এই তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দরপতন ঘটেছে। হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে চায়না টেলিকম শেয়ারদর হারিয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চায়না মোবাইল লিমিটেড হারিয়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং চায়না ইউনিকম হংকং লিমিটেড হারিয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ গত বছরেও চীনের এই তিন মোবাইল ওপারেটরের শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী ছিল।
আরও পড়ুন- চীন যেভাবে করোনাভাইরাস জয়ের পথে
হঠাৎ করে গ্রাহক কমে যাওয়ার বিষয়ে ব্লুমবার্গকে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার লেনদেনের ব্রোকারেজ হাউস ‘সানফোর্ড সি বার্নস্টেইন অ্যান্ড কোম্পানির বিশ্লেষক ক্রিস লেন বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। গত তিন মাসে চীন ছিল অব্রুদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন। এই তিন মাসে বহু বিদেশী কর্মীরা নিজের দেশে ফেরত গেছেন। সেখানে পর্যটকের স্থানগুলো ছিল বন্ধ। একেবারেই পর্যটকশূণ্য ছিল চীন। যে কারণে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, চীনের বহু মানুষ এক এলাকা থেকে গিয়ে অন্য এলাকায় কাজ করেন। ওইসব কর্মীদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইল নম্বর দেয়া হয়। করোনাভাইরাসের কারণে অনেকে নিজেদের এলাকায় চলে গেছেন। সেজন্য প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া নম্বরগুলো বর্তমানে বন্ধ আছে। এসব কারণের মূলত হঠাৎ এতো গ্রাহক হারিয়ে গেছে।’
চীনের তত্ত্ব বিশ্লেষক ট্যাঙ্গ জিনউয়ান ঘটনাটির নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, ই-কমার্সের কারণে মানুষ এখন সিমকার্ডের উপর আরো বেশী নির্ভরশীল হচ্ছে। তিনি বলছেন, “বয়স্ক ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা, ট্রেনের টিকেট কেনা, নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা- মানুষ এখনা যা করতে চায় সবটাই এখন মোবাইলের মাধ্যমে করা সম্ভব। তারা এজন্যই সিমকার্ডের উপর দিনদিন নির্ভরশীল হচ্ছে”।
আরও পড়ুন- করোনাভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কেন বিশ্বাসযোগ্য নয়
তাহলে আকস্মাৎ ২ কোটি সিম বন্ধ হওয়ার পেছনে কি করোনাভাইরাসের সত্যিই কোন যোগসূত্র রয়েছে? ড. সামান্ত হফম্যান অবশ্য অন্য সুরে গান গাইলেন। অস্ট্রেলিয়ান এই বিশ্লেষক বলছেন, “আমি মনে করিনা এই ঠুনকো তথ্য দিয়ে আসলে এতবড় তত্ত্ব উদঘাটন করা সম্ভব”। তিনি বলেন “এ ধরণের জরিপে মনগড়া তথ্য দেওয়া খুব সহজ। ডাটাবেস দিয়ে মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করা সম্ভব। তাই আমি মনে করি এত দ্রুত আমাদের কোনরকম সিদ্ধান্ত না নেওয়াই উচিত”।
হতে পারে ব্যবসায়িক ক্ষতি, শেয়ার বাজারের দরপতনের কারণে অফিসিয়াল ফোন নাম্বারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথবা অভিবাসী কর্মীরা চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তাদের সিমকার্ড বন্ধ করে রাখছে- তত্ত্বগুলো প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ।
অপরদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই কোটি সক্রিয় মোবাইল নম্বর যদি ডিঅ্যাক্টিভেটও করা হয় তাহলেও তো করোনায় মৃতের সংখ্যা কয়েক লাখ হওয়া উচিত। যদি একজন মানুষ একটি মোবাইলও ব্যবহার করেন তাহলেও তাদের দুটি সিম কার্ড থাকার কথা। সেই অনুযায়ী একটি সিম বন্ধ করে দিলেও ৭৫ লাখ মানুষ কমে যায়। এছাড়া যদি ধরে নেয়া হয় যে একজন মানুষ চারটি সিম ব্যবহার করেন তাহলেও মৃত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫০ হাজার।
প্রতিবেদনের শুরুতেই ট্যাবলয়েটটি বলছে, চীনে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নেই এবং দেশটির সরকার গণমাধ্যম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। ট্যাবলয়েটটির এমন যুক্তির কারণে অনেকেই বিশ্বাস করছেন যে প্রতিবেদনটি সত্য হতে পারে।
তবে ড. সামান্তের মত অনেক বিশ্লেষকই বলছেন প্রতিবেদনের গাফিলতির কথা। তাদের মতে হুট করে এত মানুষের মৃত্যুর তথ্য গোপন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ প্রতিবেদনে ছিল না জোরালো কোন প্রমাণ। চীনের বেকারত্বের হার বেড়েছে, বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকর্তাদের বিনা বেতনে চাকরি করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। যা দেশটির অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। একটা দেশ যখন ই-কমার্সে ঝুকে পড়ে তখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মোবাইল সিম গ্রাহক হারানো কোন অস্বাভাবিক বিষয় হতে পারেনা।
লেখক- ঐশ্বর্য মীম
করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাইনফো টিউবের সকল আর্টিকেল পড়তে ক্লিক করুন এখানে- কোভিড- ১৯