গ্যালিলিও গ্যালিলি : স্রোতের বিপরীতে চলা এক বিজ্ঞানী1 min read
Reading Time: 4 minutesআধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসেবে খ্যাত গ্যালিলিও গ্যালিলি; যিনি তাঁর মেধা, গবেষণা, লেখা, কর্ম, সাহস ও যোগ্যতার দ্বারা পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তিনি যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ঐ সময়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জ্ঞান চর্চা আজকের দিনের মতো এতটা সহজ ছিল না। তবুও তিনি দমে যাননি, পরিস্থিতি অনুকূল না থাকলেও তিনি বিজ্ঞানের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এই লেখাটির মাধ্যমে এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদের কর্মময় জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
জন্ম ও শিক্ষা
গ্যালিলিও গ্যালিলি ১৫৬৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ইতালির টুসকানিতে অবস্থিত পিসা নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন ৬ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আর তার পিতা ভিনসেনজো গ্যালিলি ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক ও স্কলার এবং মা হলেন গিউলিয়া আমানাতি। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে গ্যালিলিও গ্যালিলির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়, কারণ তার পরিবার ১৫৭৪ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে আবাসস্থল গড়ে তোলে। ১৫৮১ সালে চিকিৎসক হওয়ার লক্ষ্যে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যালিলিও গ্যালিলি ভর্তি হন। কিন্তু এখানে ভর্তি হওয়ার পরে গণিত শাস্ত্রের উপর আসক্ত হয়ে পড়েন। ফলে তাকে চিকিৎসক হওয়ার লক্ষ্য থেকে সড়ে আসতে হয়। এবার তিনি গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের লক্ষ্যে পড়াশোনা শুরু করলেও আর্থিক অনটনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন না করেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে বাধ্য হন।
কর্মজীবন
কর্মজীবনে গ্যালিলিও গ্যালিলি ছিলেন একজন শিক্ষক। যদিও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করতে পারেননি। তবুও তার মেধা ও গবেষণা কর্মের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে না পারলেও ব্যক্তি উদ্যোগে তিনি গণিত শাস্ত্রের উপর প্রচুর অধ্যায়ন করতে থাকেন এবং একটি পর্যায়ে “দ্য লিটল ব্যালেন্স“ নামে একটি গবেষণা কর্ম প্রকাশ করেন। এই গবেষণাকর্ম প্রকাশ হওয়ার পরেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং পিসা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ১৫৮৩ সালে তিনি প্রথম তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নিয়ে হাজির হন বিশ্বের কাছে; সেটি হলো, তিনি পেন্ডুলামের দোলন কীভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তার সূত্র ব্যাখ্যা করেন। তারপর থেকে একের পর এক গবেষণাকর্ম প্রকাশ হতে থাকে। আবার এদিকে তিনি এরিষ্টটলের চিন্তা, চেতনা ও বক্তব্যের ভুল প্রমাণ করতে শুরু করেন। কিন্তু ঐ সময়কালে এরিস্টটলের বিপরীতে কোনো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে এরিস্টটলের বিরুদ্ধচারণ করার কারণেই ১৫৯২ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি পিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পদ থেকে বরখাস্ত হন। তবে তার যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধা বলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ লাভ করেন। আর এখানেই তিনি বলবিদ্যা, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যার উপরে ১৮ বছর শিক্ষকতা করে গেছেন।
গবেষণাকর্ম ও চার্চের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
পৃথিবী এবং সৌরজগৎয়ের বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা কালীন একসময় তিনি জানতে পারেন হল্যান্ডে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। এই সংবাদ জানার পরেই দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ১৬০৯ সালে পূর্বের তুলনায় অনেক উন্নত দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন; যাতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সুচারুভাবে জ্যোতির্বিদ্যাকে অধ্যায়ন করা সম্ভব হয়। এটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করা তার জন্য আসলেই অনেক সহজ হয়ে ওঠে। তিনি বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, যেগুলো বর্তমানে গ্যালিলিয়ান উপগ্রহ হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়াও তিনি সৌর কলঙ্ক সম্পর্কে ধারণা অর্জন করেন যদিও তা তেমনভাবে প্রকাশ করেন নাই। আবার তিনি মন্তব্য করেন, চাঁদের মধ্যেও পৃথিবীর ন্যায় পাহাড়–পর্বত, নদী, উপত্যকা ইত্যাদি রয়েছে। “পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে” টলেমির এই ধারণাকে তিনি অস্বীকার করেন এবং কোপার্নিকাসের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে সবকিছু ঘুরছে। তার এসব ধারণা, গবেষণা ও চিন্তাগুলো তৎকালীন চার্চের মতবাদের বিপরীত হওয়ায় তার সঙ্গে চার্চের ধর্মযাজকদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যেহেতু তখন ধর্মযাজকেরা ক্ষমতাবান ছিল ফলে গ্যালিলিও গ্যালিলিকে নানা ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময়েই তিনি বাধ্য হয়েছেন তার ধারনা ও চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে। এরপরও তিনি শেষ জীবনের দীর্ঘ ৮ বছর গৃহবন্দী হিসেবে কাটাতে বাধ্য হন শুধুমাত্র চার্চের মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ বিরুদ্ধে করে বিজ্ঞানের নতুন জ্ঞান ও ধারণা প্রকাশ করার কারণে।
এত সমস্যা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকেও গ্যালিলি গ্যালিলিও থেমে থাকেননি। তিনি শনির উপগ্রহ, জড়তার সূত্র, পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, প্রাসের গতিপথ নির্ণয়, সরল দোলকের সূত্র, তারকাদের নিয়ে ছায়াপথ গঠিত এমন ধারণা, উন্নত টেলিস্কোপ, হাইড্রোস্ট্যাটিক নীতি, সৌরকলঙ্ক, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো আবিষ্কার ও এগুলো সম্পর্কে ধারণা প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক বিজ্ঞানকে করেছেন সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল। তিনি মূলত “দ্য স্টারি মেসেঞ্জার”; “অপারেশন অফ দা জিওমেট্রিক্যাল এন্ড মিলিটারি কম্পাস“; “ডিসকোর্স অন বডিস ইন ওয়াটার“; “লেটারস অব সানস্পট“; “ডায়ালগ”; ” টু নিউ সাইন্স“ ইত্যাদি তার লিখিত এই বইগুলোর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে তার ধারণা, চিন্তা–চেতনা, আবিষ্কার ও মতবাদ জানিয়ে দিয়ে গেছেন।
মৃত্যু ও স্বীকৃতি
চার্চের ধর্মযাজকদের নির্যাতন সহ্য করেও গ্যালিলিও গ্যালিলি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি যদিও তার বেশকিছু বই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং তাকে করা হয়েছিল গৃহবন্দী। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার পর একসময় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং ৭৭ বছর বয়সে এসে ইতালির ফ্লোরেন্সের কাছে আর্সেট্রি নামক স্থানে ১৬৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন।
গ্যালিলি গ্যালিলিও তার মৃত্যুর আগে তার কাজের স্বীকৃতি না পেলেও মৃত্যুর পরে ঠিকই জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকট থেকে এমনকি চার্চের নিকট থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। চার্চ তার যেসব ধারণা ও বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ও যেসব বই বাজেয়াপ্ত করেছিল সেগুলোর অধিকাংশের উপর থেকেই চার্চের ধর্মযাজকেরা ১৭৫৮ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আর ১৮৩৫ সালে এসে তার সকল কাজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয় ফলে গ্যালিলিওয়ের কর্মময় জীবনের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিংশ শতাব্দীর অনেক ধর্মযাজকেরাই চার্চের পূর্ববর্তী কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং গ্যালিলিও গ্যালিলির গবেষণা ও কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর এভাবেই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় গ্যালিলিও গ্যালিলি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।