ক্রিপ্টোকারেন্সি- ভবিষ্যতের একমাত্র লেনদেনের মাধ্যম?1 min read
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রার মান ও ধরণ ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। প্রাচীন যুগেএকটি সময়ে মুদ্রার প্রচলন ছিলো না। তারপর একটি সময়এসে, মুদ্রার প্রচলন শুরু হলো; এরপর আস্তে আস্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। কিন্ত বর্তমান সময়ে এমন একটি লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা পূর্ববর্তী লেনদেন ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ নতুন ও বেশ চমকপ্রদ; আর এটি হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কী?
ক্রিপ্টোকারেন্সি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। একটি হলো ক্রিপ্টো আর অপরটি হচ্ছে কারেন্সি। এই ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। আবার একে সাংকেতিক মুদ্রা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এটি পিয়ার টু পিয়ার ব্যবস্থা; এতে দুই পক্ষেরমধ্যে অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে, তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না। তাই কে, কার কাছে এই অর্থ লেনদেন করছে, তা এই দুই পক্ষ ব্যতীত অন্য কেউ জানতে পারে না। এমনকি পরিচয় গোপন রেখেও লেনদেন করা যায়।
এই মুদ্রার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই, অনলাইনের মাধ্যমে এই মুদ্রা লেনদেনের পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।আর এই ধরনের মুদ্রা বিনিময়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ক্রিপ্টোগ্রাফি নামক একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে এমন ভাষা বা সংকেত ব্যবহার করে কোড লেখা হয়, তা লেনদেনকারী এই দুই পক্ষ ব্যতীত অন্য কেউ বুঝতে সক্ষম হয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোপনে ও নিরাপদে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফি পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিলো। গাণিতিক তথ্য ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। মূলত অর্থ লেনদেনকে আরো নিরাপদ করার লক্ষ্যেই ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রযুক্তির সাহায্যে ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভব ঘটেছে। আমেরিকান ক্রিপ্টোগ্রাফার ডেভিড চম ১৯৮৩ সালে এই ক্রিপ্টোগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করে, ডিজিটাল উপায়ে অর্থ আদান প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন।
তখন তিনি তার বিষয়টির নাম দেন ই-ক্যাশ। ১৯৯৫ সালে তিনি ডিজি ক্যাশের মাধ্যমে ক্রিপ্টোগ্রাফিক ইলেকট্রনিক পেমেন্টের প্রাথমিক ফর্ম বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং পরবর্তীতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এনক্রিপটেড কি গুলো ইনপুটের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে অনেকটাই সক্ষম হোন। তবে প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি হচ্ছে বিটকয়েন, যা আবিষ্কার করেন সাতোশি নাকামোতো। এটি ছিলো প্রথম স্থায়ী ও সফল ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা২০০৯ সালে সফলভাবে প্রকাশ পায়। তারপর থেকেই এই ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক ভাবে সাড়া ফেলে।
বিভিন্ন ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি
২০০৯ সালে বিটকয়েন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই ক্রিপ্টোকারেন্সি জগতে বিভিন্ন ডিজিটাল মুদ্রা সংযুক্ত হওয়া শুরু করে। বর্তমানে ইন্টারনেটে এক হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে। বিনিময় মূল্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা এবং বেশ জনপ্রিয় কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো- বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপল, লাইট কয়েন, মনেরো,ড্যাশ, বাইট কয়েন, ডোজকয়েন ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে বিটকয়েনই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই এই বিটকয়েন ডিজিটাল মুদ্রাটির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কীভাবে কাজ করে
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার মতো সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মুদ্রা ছাপায় না। ‘মাইনিং’ নামের একটি জটিল গণনা পদ্ধতিতে একেকটি ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত এক বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সব ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতিটি লেনদেন পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ব্লকচেইন’। এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাধারণ লেনদেনসহ বন্ড, স্টক ও অন্যান্য আর্থিক সম্পদের কেনাকাটাও করা যায়।”
আর দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরনের বিকেন্দ্রীকৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে নিরাপদে অর্থ পরিশোধ করা যায়। আমানতকারীর নাম গোপন রেখে এবং ব্যাংকে না গিয়েই অর্থ জমা রাখা যায়।”
অনলাইনে ব্রোকারদের কাছ থেকেও বিভিন্ন ডিজিটাল মুদ্রা ক্রয় করা যায়। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো অনলাইনে ‘ক্রিপ্টোগ্রাফিক ওয়ালেট’ নামক নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সির সুযোগ-সুবিধা
ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন যেহেতু সরাসরি গ্রাহক এবং প্রাপকের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে, তাই বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কারণ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যখন লেনদেন করা হয়, তখনঐ সেবাদানকারী তৃতীয় পক্ষকে বাড়তি ফি প্রদান করতে হয়, এছাড়াও বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হয়। আর তৃতীয় পক্ষ তথা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করলে যতটা দ্রুত অর্থ বিনিময় করা যায়, তার চেয়েও বহুগুণ দ্রুত সময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ বিনিময় করা সম্ভব হয়। সর্বনিম্ন চার্জ প্রদান করার মাধ্যমে আপনি নিজেই খুব সহজে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন।
ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর বিনিময় মূল্য ওঠা-নামা করে, তাই ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করে ব্যাপক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর পরিচয় গোপন করে এবং কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হয় এই ক্রিপ্টোকারেন্সি মাধ্যমে, যা অন্য কোনে মাধ্যমে করা অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। এমনই নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা আপনি এই ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে উপভোগ করতে সক্ষমহবেন।
ক্রিপ্টোকারেন্সির অসুবিধা
ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে যেহেতু পরিচয় গোপন করে অর্থ লেনদেন করা যায়, তাই এটি অনেক সময়ই গ্রাহক কিংবা প্রাপকের জন্য নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে আসে। এছাড়াও সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকে না এই লেনদেনের ব্যাপারে, তাই অবৈধ অর্থ লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
আর এই কারণে অনেক দেশেই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার যেহেতু্মু দ্রার মূল্য উঠানামা করে তাই অনেক সময়ই আপনার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিছু সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সঠিক এবং যথাযথভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা এই ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা সহজেই উপভোগ করতে পারি।