ক্রিকেট ফিক্সিং কেন এবং কিভাবে1 min read
Reading Time: 3 minutesমোহাম্মদ আমির সেবার যখন লর্ডসে দাঁড়িয়েছিলেন, দর্শকদের দুয়োতে কান পাতা দায় হয়ে গিয়েছিলো। সেই একই সাদা পোশাকেই হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু এবার আর সেই ২০১০ সালের মত করে ইংলিশরা ভিনদেশী এই পেসারের প্রশংসায় ভাসেনি। অথচ ২০১০ সালে ১৯ বছরের লম্বা চুলের আমির যখন ইংলিশদের নাকের জল আর চোখের জল এক করে দিয়েছিলেন তখন নাস্তানাবুদ হয়েও ইংলিশ ক্রিকেট প্রেমীরা সাধুবাদ জানিয়েছিলো উপমহাদেশের এই সেনসেশনকে।
সাধুবাদ জানিয়েছিলো মোহাম্মদ আসিফকেও। ক্ষণে ক্ষণে যিনি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন আরেক কিংবদন্তী গ্লেন ম্যাকগ্রাকে। সেই পিজিয়নের মতোই মাপা বাউন্স আর দুরন্ত সুইং দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে মোহিত করেছিলেন মোহাম্মদ আসিফ। কিন্তু জুয়ারির পাতা ফাঁদে হারিয়ে গেলেন দুজনেই। আমির ফিরেছেন। তবে আগের সেই সাধুবাদ যেন হারিয়ে ফেলেছেন। ফিক্সিং করে হারিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে প্রবাদপ্রতিম মানুষ হ্যান্সি ক্রনিয়ে। শেষ পর্যন্ত পরপারে গিয়েও হয়ত আফসোস করছেন এই মানুষটা। ফিক্সিং এর চক্রে ক্রিকেট হারিয়েছে শ্রীশান্ত কিংবা আজহারউদ্দিনের মত মানুষকেও।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সত্যিকার অর্থে প্রথম আইকন ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান, কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়া বধের সেই শতক কিংবা পরের ম্যাচেই ইংলিশ পেসারদের গুড়িয়ে দিয়ে ৫২ বলে ৯৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস! একসময় প্রবাদ হয়ে গিয়েছিলো, “আশরাফুলের ব্যাট হাসলেই বাংলাদেশ হাসে।“
একসময় সেই আশরাফুলও হারালেন পথ। এখন আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরলেও আছেন অন্ধকারের বৃত্তে। ৯৮ নাম্বার জার্সিটা বাংলাদেশ দলে এখন আর কেউই পরেনা। খালিই আছে। যেমন খালি আছে ৭৫ নাম্বার জার্সিটা। দলে কেউ নেই, কেউ ভাল করছেনা? তখনও ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের ত্রাতা একজন ছিলো, সাকিব আল হাসান। সামনের এক বছরের জন্য এবার সেই সাকিবও নেই।
ক্রিকেটে ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে জল ঘোলা হবার ঘটনা আসলে একদিন বা দুইদিনের না। এর জন্য রক্তও ঝড়েছে ক্রিকেট পাগল ভারতের মাটিতে। ক্রিকেটে জুয়াড়িদের বাজি ধরাটা বেশ অনেকটা সহজ অন্যান্য যেকোন খেলার তুলনায়। তবে হ্যাঁ, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাজি ধরা হয় ঘোড়দৌড়ে। কিন্তু লাভের অঙ্ক হিসেব করলে ক্রিকেট কোনভাবেই পিছিয়ে থাকবেনা।
ক্রিকেটে দুই ধরণের ফিক্সিং দেখা যায়। স্পট ফিক্সিং এবং ম্যাচ ফিক্সিং। তবে হালের দিনগুলিতে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের চেয়ে জুয়াড়িদের আকর্ষণ স্পট ফিক্সিংয়ের দিকে। স্পট ফিক্সিং এর ক্ষেত্রে পুরো ম্যাচের বদলে একটা নির্দিষ্ট অংশের দিকেই চোখ থাকে জুয়াড়িদের। যেমনটা দেখা গিয়েছিলো মোহাম্মদ আমিরের দুই নো বল, কিংবা আইপিএল ম্যাচে শ্রীশান্তের এক ওভারে ২২ রান দেয়ার ঘটনায়। সাধারণত এই ক্ষেত্রে জুয়াড়িদের পক্ষে বিনিয়োগ করাটা অনেক বেশিই সহজ হয়। যতদিন যাচ্ছে খেলোয়াড়দের সাথে জুয়াড়িদের এমন সংশ্লিষ্টতা ক্রমাগত বাড়ছে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ভারতীয় জুয়াড়ি আগারওয়াল এবং বাংলার ক্রিকেট আইকন সাকিব আল হাসানের মাঝে।
সাকিব আল হাসানের কাছে ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব এবারই প্রথম ছিলো না। কিন্তু প্রথমবার ২০১২ সালে সাকিব আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিট আকসুতে না জানালেও জানিয়েছিলেন বিসিবিকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কাউকেই না জানানোর কারণে আইসিসির বিধি মোতাবেক দুই বছর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা।
সাম্প্রতিক সময়ে জুয়াড়িদের আরেক বড় ভরসার নাম হয়ে গিয়েছেন ক্রিকেটের গ্রাউন্ডসম্যানরা। সম্প্রতি আল-জাজিরার অনুসন্ধানে নাম উঠে আসে এমনই এক ভারতীয় জুয়াড়ির কথা। ডি কোম্পানির অনিল মুনাওয়ার স্বীকার করেছেন তিনটি টেস্ট ম্যাচে তার সম্পৃক্ততার কথা। প্রায় ৬ থেকে ৭ বছর ধরে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই আল জাজিরাকে জানিয়েছেন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ম্যাচেই চাইলে ফিক্সিং করা সম্ভব। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বেশ কিছু খেলোয়াড় তার ‘নিয়ন্ত্রণে’ আছেন বলেই দাবি করেছেন তিনি।
মুনাওয়ার দাবি করেন ২০১৬ সালের ১৬ থেকে ২০ ডিসেম্বরের টেস্ট ম্যাচ পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তিনি আগেই ব্যাটিং সহায়ক পিচের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। এবং তিনজন ইংলিশ খেলোয়াড়ের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। মুনাওয়ার সফলই ছিলেন। ভারত প্রথমে ব্যাট করে ৭৫৯ রানের বিশাল সংগ্রহ করে। সাথে ছিলো করুন নায়ারের ট্রিপল সেঞ্চুরি। আর এতবড় রানের চাপায় পিষ্ট হয়ে সত্যিকার অর্থেই ইংল্যান্ডের কিছুই করার ছিলো না। ম্যাচটা তারা হেরে যায় ইনিংস ব্যবধানে।
এরপর মুনাওয়ার প্রভাব রেখেছিলেন শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়ার গল টেস্টেও। তবে এবার তার নির্দেশনা ছিলো বোলিং সহায়ক পিচের। ফলাফল হিসেবে ম্যাচের ইতি ঘটে মাত্র আড়াই দিনে। ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে উইকেট পতন ঘটে ২১ টি।
এছাড়াও ভারত শ্রীলঙ্কার গল টেস্টেও মুনাওয়ারের নির্দেশনা ছিল পিচ বিষয়ে। ব্যাটিং পিচ ছিলো সে দফায়। ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৬০০ এর ঘরে। মুনাওয়ারের বাজি ছিলো, যে প্রথম ব্যাট করবে তাদের ভাগ্যেই বড় সংগ্রহ জুটবে এবং জয়টাও তাদের পক্ষেই আসবে।
মুনাওয়ার কিংবা আগারওয়ালকে হয়ত আমরা জানি। কিন্তু এর আড়ালেও আরো অনেকেই আছেন এই “জেন্টেলম্যান গেইম” কে কলুষিত করার জন্য। কিন্তু আসলেই কি ক্রিকেট আর আগের সেই জৌলুশ ফিরে পাবে? নাকি সাকিব আল হাসানের মত আরো অনেকে দায়ী হবেন এই জঘন্য অধ্যায়ের মাঝে?