ক্যাভিয়ারঃ মাছের ডিম পৃথিবীর সবচেয়ে দামী খাবার 1 min read
Reading Time: 3 minutesখাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু খাদ্য কি শুধুই বেঁচে থাকার জন্য? না, এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে খাওয়া-দাওয়া বিলাসিতারও অন্যতম অনুষঙ্গ। মানুষ কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে শুধুমাত্র বিলাসী খাবারের পিছনে। এমন ভোজনবিলাসী মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
ক্যাভিয়ার হলো তেমনি এক বিলাসবহুল খাবারের নাম। এটি স্টারজিওন নামের এক ধরণের সামুদ্রিক মাছের ডিম। সম্ভবত প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ক্যাভিয়ার সবচেয়ে দামী। সিএনএন এর সূত্রমতে, প্রতি পাউন্ড ক্যাভিয়ারের দাম ৪০০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
ক্যাভিয়ারের সংজ্ঞা
ক্যাভিয়ার হলো আ্যসিপেনসারিডি (Acipenseridae) পরিবারের অন্তর্গত স্টারজিওন (Sturgeon) মাছের ডিম যা সামান্য পরিমাণ লবণ মিশিয়ে কাঁচা পরিবেশন করা হয়। প্রজাতিভেদে ক্যাভিয়ারের আকার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সেইসাথে রঙও বদলায়। ক্যাভিয়ার কালো, ধূসর, বাদামী, হালকা হলুদ, গাঢ় হলুদ বা কমলা প্রভৃতি বর্ণের হয়ে থাকে। তবে কালো বর্ণের ক্যাভিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও চাহিদা সম্পন্ন। তাই এর দামও সবচেয়ে বেশি।
স্টারজিওন মাছের বিস্তার
নেচার বিজ্ঞান সাময়িকীর মতে, বিশ্বের শতকরা ৯০ ভাগ ক্যাভিয়ার আসে কাস্পিয়ান উপসাগর থেকে। এছাড়াও কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগরের কিছু অংশে স্টারজিওন মাছ পাওয়া যায়। আবার কিছু প্রজাতি আছে যেগুলোকে উত্তর আমেরিকার সাগর ও নদীতে পাওয়া যায়। ব্রিটানিকা ডট কম এর মতে, উত্তর গোলার্ধের সাগর, মহাসাগর ও নদীগুলোতে স্টারজিওন মাছ দেখা যায়। তবে বেলুজা স্টারজিওন যেটা ক্যাভিয়ারের জন্য বিখ্যাত সেটি বাস করে কাস্পিয়ান, কৃষ্ণ ও আজব সাগরে আর ডিম দেয় ভলগা, আরাল, বগ, ড্যানবি, ড্যানিএস্টার ও ডন নদীতে।
ক্যাভিয়ার সংগ্রহ
স্টারজিওন এক ধরণের ক্যাট ফিশ। এ মাছের বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। তার মধ্যে বেলুজা (Beluga) স্টারজিওন হলো স্বাদু পানির মাছের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এর দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১৯.৭ ফুট বা ৬ মিটার এবং ওজন ২২০৫ পাউন্ড বা ১০০০ কেজি পর্যন্ত হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ মাছের মোট ওজনের ১২ শতাংশ ডিম থাকে। এই ডিম তথা ক্যাভিয়ার সবচেয়ে সুস্বাদু ও দামী। এর রং কালো। স্টারজিওন মাছ শীতকালে ডিম দেয়। এসময় সে মোহনায় চলে আসে যদিও বছরের অন্যান্য সময় সাগরে থাকে। যখন মোহনায় আসে তখন এ মাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, স্টারজিওন মাছের পেট থেকে ডিম সংগ্রহ করার সময় এ মাছটিকে কেটে ফেলতে হয়। কেননা পরিপুষ্ট হয়ে যে ডিম মাছের পেট থেকে সরাসরি বের হয় সেটি ক্যাভিয়ার নয়। অর্থ্যাৎ সেটা কাঁচা খাওয়া যায় না। এজন্যই স্টারজিওন মাছের কোন কোন প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। তার মধ্যে বেলুজা স্টারজিওন এখন বিলুপ্তপ্রায়।
ক্যাভিয়ার প্রস্তুতপ্রণালী
ডিমগুলোকে খুব সাবধানতার সাথে আলাদা করা হয় যেন গলে না যায় বা একটার সাথে আরেকটা লেগে না থাকে। তারপর এটাকে স্বাদমত লবণ ও চাটনি দিয়ে রসিয়ে নেওয়া হয়। যেহেতু এটি কাঁচা পরিবেশন করা হয় তাই একে খুব সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা হয় যেন অণুজীব প্রবেশ না করে। সাধারণত ক্যাভিয়ারকে দুই থেকে চার ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। তবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য শূন্য থেকে মাইনাস চার ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়।
পরিবেশন
এত দামী খাবারের পরিবেশনটাও আলিশান। লবণ ও চাটনি সহযোগে ২৪ ক্যারেটের সোনার বাক্সে ভরে কাস্টমারের সামনে আনা হয়। সাধারণত প্রতিটি বাটিতে ৫০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত ক্যাভিয়ার থাকে। ছোট ছোট কুকিজাতীয় বিস্কুটের উপর রেখে কেউ কেউ খেতে পছন্দ করেন। আবার কেউ কেউ পার্টিতে হুইস্কি বা ভদকার সাথে অল্প অল্প ক্যাভিয়ার খেয়ে সময় পার করেন।
দরদাম
যে খাবার সোনার বাটিতে করে পরিবেশন করা হয়; যে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা বিলুপ্তপ্রায় মাছকে জীবন দিতে হয় তার দামটাও নিশ্চয়ই আমদের মত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতি ৫০ গ্রাম ক্যাভিয়ারের দাম ১৮০০ মার্কিন ডলার থেকে শুরু। আর যদি ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার চেখে দেখতে চান তাহলে আপনাকে গুণতে হবে প্রায় ৩৫০০০ মার্কিন ডলার। এটি কেবলমাত্র ইরানিয়ান কোম্পানী আলমাস ক্যাভিয়ারে পাওয়া যায়। যদি ডিশ হিসেবে খেতে চান তাহলে আপনাকে ডিশ প্রতি গুণতে হবে মাত্র ২৫০০০ মার্কিন ডলার!
ক্যাভিয়ার এত দামী হওয়ার কারণ
ক্যাভিয়ারের আকাশচুম্বী দামের প্রধান কারণ হলো ক্রেতার অত্যধিক চাহিদা ও স্টারজিওন মাছের অপর্যাপ্ততা। একটা মা স্টারজিওন মাছকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় লাগে প্রায় ১৯ বছর। আর ডিম আসার পর সেটাকে নিষেক হওয়ায় আগেই মানে আনফার্টিলাইজড (Unfertilized) অবস্থায় মাছের পেট কেটে ডিম বের করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়।
ক্যাভিয়ার যেখানে জনপ্রিয়
আমাদের দেশে যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দিন আনে দিন খায় সেখান থেকে তো এটা জানার ইচ্ছেটা খুব স্বাভাবিক যে, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই ক্যাভিয়ার কারা খায়। ইউরোপের দেশগুলোতে ক্যাভিয়ার একটা দৈনন্দিন খাবারের নাম! সেখানে প্রায় প্রতিদিনই এ খাবার খাওয়া হয়। তাছাড়া বিয়ে, জন্মদিন প্রভৃতি বিভিন্ন পার্টিতে ক্যাভিয়ার থাকাটা যেন অত্যাবশ্যক। ষোড়শ শতাব্দী থেকে পশ্চিম ইউরোপের লোকজন নিয়মিত মজাদার এ ডিম খেয়ে আসছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে যারা একটু স্বাস্থ্যবান তাদের কাছে ক্যাভিয়ার প্রধান খাবার হিসেবে বিবেচিত। তারা ভদকার সাথে এটা খেয়ে থাকে। কালজয়ী নাটক ‘হ্যামলেট’ এ স্বয়ং শেক্সপিয়ার ক্যাভিয়ারের কথা বলেছেন।
পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে খুব শীগ্রই হয়ত বিলীন হয়ে যাবে মহামূল্যবান স্টারজিওন মাছ। তখন টাকা কেন কোন কিছুর বিনিময়েও মিলবে না আর ক্যাভিয়ার।