কাশ্মীরে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন?1 min read
Reading Time: 3 minutesকাশ্মীর নিয়ে সমস্যা কেবল আজ থেকে নয়। ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের বেশ আগ থেকেই শুরু হয়েছিল এই কাশ্মীর দ্বন্দ্ব। উল্লেখ্য যে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। অতীত নিয়ে কথা বলার আগে জানা প্রয়োজন ভারতের সংবিধান কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ৩৭০ ধারা’র মাধ্যমে। কিন্তু সেই ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে বর্তমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপি সরকার। এই ৩৭০ ধারা যোগ হয়েছিল ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে। এই বিধানে কাশ্মীরকে একটা আলাদা সংবিধান ও পতাকার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা হয় এই ধারার মাধ্যমে। তবে বিজেপির নির্বাচনী ওয়াদাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ইশতেহার ছিল এই ধারা বাতিল করা এবং বিজেপি তাদের ইশতেহার অনুযায়ী কিছুদিন আগেই এই ধারাটি বাতিল করে দিয়েছে।
যেভাবে ৩৭০ ধারাটি ভারতের সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছিল
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে যখন ভারত বর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তখনই জুনাগড়, হায়দরাবাদ এবং জুম্ম-কাশ্মীর নামক তিনটি অঞ্চলকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল তারা স্বাধীন হতে পারবে অথবা ভারত ও পাকিস্তানের যে কোন একটির সাথে সংযুক্ত হতে পারবে। তৎকালীন হিন্দু রাজা হারি সিং চাচ্ছিলেন ভারতের সাথে সংযুক্ত হতে। অপরদিকে জুম্মু ও বালতিস্তান এর মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবী ছিল পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তির। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী জম্মু এবং কাশ্মীরে প্রবেশ করার চেষ্টা শুরু করে। ফলস্বরূপ মহারাজা হারি সিং তৎকালীন সময়ে জহরলাল নেহেরু এবং প্যাটেলের সহযোগিতা কামনা করেন। ভারত তখন প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ দাবী করে “ইনষ্ট্রুমেন্ট অব একসেশন” অর্থাৎ ভারতের সাথে সংযুক্ত হওয়ার দলিলে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। মহারাজা হারি সং এই সমঝোতার দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরকে সহায়তা করার জন্য জম্মু এবং কাশ্মীরে চলে আসে। ফলে প্রথমবারের মত করে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ভারত এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ থেমে যায়। তবে যুদ্ধ থামলেও পাকিস্তান কাশ্মীর থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই অস্বীকৃতির মাধ্যমে কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই সংঘাত চলাকালীন সময়েই ১৯৪৯ সালে জহরলাল নেহেরু জুম্মু কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেন এবং ৩৭০ ধারার খসড়া দেয়া হয় জুম্মু কাশ্মীর সরকারকে। কিছু অদলবদল করার পরে ১৯৪৯ সালে গণপরিষদে এটা পাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে ৩৭০ ধারা অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পায় কাশ্মীর। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে জুম্মু এবং কাশ্মীরের আলাদা সংবিধান গঠিত হয় এবং সংবিধানে এই অঞ্চলকে ভারতের অভ্যন্তরীণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এরপর ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তির মাধ্যমে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখাকে যুদ্ধবিরতি হিসেবে দুই দেশ সমর্থন করে। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহর মাঝে কাশ্মীর চুক্তি নামে আরেকটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল যেখানে ৩৭০ ধারার উপরে পুনরায় জোর দেয়া হয়েছিল।
৩৭০ ধারা বিলুপ্তি করন
২০১৫ সালে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে একত্রে সরকার গঠন করলেও ২০১৮ সালে এই জোট ভেঙে দেয়া হয় এবং রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অণুচ্ছেদ ৩৭০ ধারাকে রক করার প্রস্তাব তোলেন সংসদে। এই প্রস্তাব পাশ হওয়ার সাথে সাথে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাও বিলুপ্ত করা হয় অর্থাৎ কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়া হয়।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে কাশ্মীরে ৩৮ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনাবাহিনী অবস্থান করছে এবং সেখানকার ইন্টারনেট, টেলিফোন এবং মোবাইল সেবা তুলে নেয়া হয়েছে। জুম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর সহ আশেপাশের এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে সেই অঞ্চলের শান্তি ও শৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে এজন্যই এমনটা করা হচ্ছে। এমনকি স্কুল ও কলেজগুলোও অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতার জন্য জুম্মু এবং কাশ্মীর অঞ্চল থেকে সকল বহিরাগতদের সরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার বিস্তার ঘটাতেই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ। লেখক ও মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দার বলেন ‘কাশ্মীরের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরি, সম্পদের মালিকানাসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হতো। এখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বিভিন্ন জাতি–ধর্মের লোক যাবে। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদের প্রভাবে রাশ টেনে হিন্দুত্বের বীজ বপন করা।’
পর্যটনের জন্য বিখ্যাত ভূস্বর্গ বলে আখ্যায়িত এই কাশ্মীরে বর্তমানে নেই একজনও পর্যটক। এমতাবস্থায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের আরো অবনতি হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে একটাই, ইতিহাস জুড়ে এত চেষ্টা প্রচেষ্টার পর ২০১৯ সালে এসে কাশ্মীর কি তবে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল? এ বিষয়ে বলা হচ্ছে যে, কাশ্মীর সমস্যার যতটুকু সমাধান হয়েছিল ৩৭০ ধারা বাতিলের সাথে সাথে ইতিহাস আবারও ফিরে এলো কাশ্মীরে।