বিশ্ব

ভারত-পাকিস্তান: কারগিল যুদ্ধ1 min read

আগস্ট ৯, ২০২০ 5 min read

author:

ভারত-পাকিস্তান: কারগিল যুদ্ধ1 min read

Reading Time: 5 minutes

১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই মাস জুড়ে প্রায় ৫০ দিন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।  জম্মু-কাশ্মীরের উত্তরে অবস্থিত লাদাখের কারগিল এলাকার লাইন অফ কনট্রোল (LOC) ও এর আশেপাশের কিছু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই যুদ্ধ। পাকিস্তান এই যুদ্ধকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করে এটিকে “যুদ্ধ সমতুল্য পরিস্থিতি” বলে অভিহিত করেছিল।

১৯৪৭ সালের আগে অখন্ড ভারতে কারগিল ছিল লাদাখের বালকিস্তান অঞ্চলের অংশ। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের   পর “লাইন অব কন্ট্রোল” এর মাধ্যমে বালকিস্তানকে বিভক্ত করা হয়। যার দরুণ কারলিগ অঞ্চলটি ভারত অধ্যুষিত লাদাখ প্রদেশের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর কারগিল৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ষোলো হাজার ফুট৷

লাল রঙে চিহ্নিত এলাকাগুলো পাকিস্তানিরা দখল করে; Photo: imgkid.com

কারগিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট

পাকিস্তানী সেনা এবং কাশ্মীরি মুক্তিকামীরা “লাইন অফ কনট্রোল” পার হয়ে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকার মাধ্যমেই মূলত সংঘর্ষের শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার জানিয়েছিল এই কাজটি কাশ্মীরের মুক্তিকামী বা মুজাহিদদের। কিন্তু পরবর্তীতে এই ঘটনার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের যুক্ত থাকারও অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

শীতকালে বরফ আচ্ছাদিত এই এলাকার বৈরি পরিবেশের কারণে ভারতীয় সেনারা দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত তাদের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যেত। গরমকালে পরিবেশ ঠিক হলে আবার এসব ক্যাম্পে তারা ফিরে আসতো। পাকিস্তানি সেনারা এই সুযোগটি নিয়ে শীতকালে দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত ভারতের এসব ক্যাম্প দখল করে।

এই পাহাড়ের ঠিক পাশেই ছিল ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ন্যাশনাল হাইওয়ে, যেটি ভারতের শ্রীনগর ও লেহ এলাকাকে সংযুক্ত করতো। পাকিস্তানি সেনাদের দখল করা পাহাড়ের উঁচু অবস্থান থেকে এই হাইওয়েতে চলাচল করা যানবাহনকে খুব সহজেই টার্গেট করে হামলা চালানো যেত। পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের এই রাস্তার চলাচল বন্ধ করে দেয়া। তাদের ধারণা ছিল এতে ভারত চাপে পড়ে কাশ্মীরের এই অঞ্চল ছেড়ে দিবে।

১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী লাহোর সফর করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে একটি চুক্তি করেন

এদিকে পুরো ঘটনাটি ঘটেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের অনুমতি ব্যতিরেকে। তিনি এই ঘটনার কিছুই জানতেন না। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান পারফেজ মোশাররফ ছিলেন সব কিছুর পেছনে। তাই প্রাথমিকভাবে যুদ্ধের সকল দায় গিয়ে পড়ে কাশ্মীরের মুক্তিকামী যোদ্ধাদের উপর।

সেনাপ্রধান পারফেজ মোশাররফ জানতেন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া পুরো পাকিস্তান বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সরকারি কোন উড়োজাহাজ, যুদ্ধবিমান ব্যবহারেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। তাই পুরো যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্য ছিল পাঁচ হাজার। অন্যদিকে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর সংযোগে ভারত সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার।

তবুও পারভেজ ধারণা করেছিলেন, ভারতকে পরাজিত করা কঠিন কিছু হবে না। কারণ মুজাহিদদের পক্ষে কারগিলের সেই ১৬-১৮ হাজার ফুট উঁচু অবস্থান থেকে ভারতের বিশাল সেনাবাহিনীকে কাঁবু করা কঠিন কিছু ছিল না। তার ধারণাটি একদম অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু ভারতের বায়ু সেনা ও সেনাবাহিনীর চৌকস দল পাশার দান উল্টে দিতে বেশি সময় নেয় নি।

মূল যুদ্ধ

১৯৯৯ সালের ৩ মে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে চূড়ান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। পাকিস্তান বাহিনীর একটা ছোট অংশ কারগিলে প্রবেশ করে ভারতের ক্যাম্প দখল করেছে- ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে এমন খবর গেলে তাদের একটি দল সে স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানীরা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ভারতের প্রথম আঘাতের বিপক্ষে জোরালো জবাব দেয়। এতে ভারতের পাঁচ সেনা মৃত্যুবরণ করে। এরপর যুদ্ধ বিকটরূপ ধারণ করে। পাকিস্তানের পরপর আক্রমণে ভারতীয় সেনারা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে।

৯ মে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দখলকৃত একটি ঘাঁটি বিধ্বস্ত করে দেয় ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানি সেনাদের সবচেয়ে বেশী অনুপ্রবেশ ছিল কারগিলের দ্রাস, মোস্কো সেক্টরে। খবর পেয়ে ভারতীয় সেনার একটি বড় দল সেখানে উপস্থিত হয়।

পাকিস্তানি সেনারা যে উঁচুতে অবস্থান নিয়েছিল তাতে ভারতীয় বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। পরে ইসরায়েন উন্নত অস্ত্র দিয়ে ভারতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে এই যুদ্ধে

২৬ মে পাকিস্তানিদের উপর বোমা হামলা চালায় ভারত। কারগিল যুদ্ধে ভারত আকাশপথকে ভালোভাবেই ব্যবহার করতে পেরেছিল। তারা ৩২ হাজার ফুট উপরে বিমানযোগে পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটি চিহ্নিত করেছিল। কারগিল যুদ্ধ জেতার জন্য ভারত প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ সেনা সেখানে পাঠিয়েছিল। বিমানের অভাব থাকলেও ভারতের এমআই১৭ নামের একটি বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম হয় পাক বাহিনী। এতে ভারতের চারজন বায়ুসেনা নিহত হয়।

১ জুন, কারগিলের প্রধান সড়কে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। ভারত পাকিস্তান সরকারকে যুদ্ধ সমাপ্ত করার অনুরোধ করে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ তাতে আগ্রহ না দেখালে ভারত সেনারা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। কারগিল বিজয়ের উদ্দেশ্যে বিধ্বংসী প্রস্তুতি নিতে থাকে তারা। ৯ জুন যুদ্ধ জয়ের প্রথম সোপান হিসাবে ভারত কারগিলের দুইটি সেক্টর পাক বাহিনীর দখলমুক্ত করে ফেলে।

এছাড়া ভারত তার সম্পূর্ণ নৌবাহিনীকে পাক বাহিনীর উপর লেলিয়ে দেয়। কারগিল যুদ্ধের সাথে সাথে তেল আমদানিতেও তাই হিমশিম থেকে হয় পাকিস্তানের।

এদিকে যুদ্ধ প্রবল আকার ধারণ করলে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য তো করেই নি বরং যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানকে ভারত থেকে তাদের সেনাদের সরাতে বলেন। অবিশ্বাস্যভাবে সেই মুচলেকায় সই করেন নওয়াজ মোশাররফ এবং সাথে সাথেই সেনাবাহিনীকে দেশে ফেরা আসার আদেশ দেন।

বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাক সেনাবাহিনী এবং কাশ্মীরি মুক্তিকামীরা। সামান্য সেনা নিয়ে ভারতের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনীকে কাবু করেও যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসাটা মেনে নিতে পারেনি তারা। এজন্য পাকিস্তানে আজও নওয়াজ শরিফকে কূটনীতিক সম্পর্কে ব্যর্থ এক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়।

ভারতীয় বাহিনী একের পর এক সেক্টর দখল করে এগিয়ে যাচ্ছিল। ১২ জুলাই পাকসেনদের হেয় করার জন্য যুদ্ধ শেষের আগেই বিজয় ঘোষণা করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ২৬ জুলাই, ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত এই যুদ্ধে তাদের জয় ঘোষনা করে৷

একটি পাহাড় নিজেদের দখলে নিয়ে বিজয়ীর বেশে ভারতীয় সেনারা

ফলাফল ও ক্ষয়ক্ষতি

১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, “লাইন অফ কনট্রোল” এর দক্ষিণ ও পূর্বাংশ ভারতের দখলে চলে যায়৷
পারভেজ মোশাররফ তার জীবনী গ্রন্থ ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’-এ বলেন-

‘ভারতের স্বীকৃতি অনুসারে এ যুদ্ধে প্রায় ৬০০ জন নিহত এবং ১৫০০ লোক আহত হয়। তবে আমাদের কাছে আসা তথ্য অনুসারে প্রকৃত হতাহত সংখ্যা ভারতের স্বীকৃত হতাহতের অন্তত দ্বিগুন হবে। অপ্রত্যাশিতভাবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভারতের কফিনের সংকট দেখা দেয়। এ নিয়ে একটা কেলেঙ্কারীর ঘটনাও পরে ফাঁস হয়ে পড়ে। আমাদের সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের স্বল্পতা সত্ত্বেও আমাদের সৈন্যরা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে। ভারতীয় হতাহতের সংখ্যাই প্রমাণ করে পাকিস্তান সৈন্য ও অফিসারদের যুদ্ধ দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব।’

ভারতীয় সূত্রমতে, তাদের পক্ষে নিহত হন ৫২৭জন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিবেদনে জানায় যে কারগিল যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০০জন৷ তবে এই যুদ্ধে আসলেই কতজন নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো  তথ্য পাওয়া যায়নি।

ভারতের সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে তাদের অপারেশনের নাম দিয়েছিল “অপারেশন বিজয়” আর ভারতের এয়ার ফোর্স তাদের অপারেশনের নাম দিয়েছিল “অপারেশন সাফেদ সাগর”। এই যুদ্ধের পর থেকে প্রতি বছর ২৬ জুলাই ভারত “কারগিল বিজয় দিবস” হিসেবে পালন করে। অন্য দিকে তৎকালীন পাকিস্তানী তথ্যমন্ত্রী মুশাহিদ হুসেন এই যুদ্ধে পাক সেনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বাস্তবতা মেনে নিলেও, জোর গলায় বলেছিলেন যে, এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্বল দিকগুলি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তারা৷ তবে আজও কারগিল যুদ্ধের পরিণাম ও বাস্তবিক চিত্র নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রহস্যের জাল রয়েই গেছে।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *