দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক: কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়1 min read
Reading Time: 3 minutesভারত উপমহাদেশ তখন ইংরেজদের দখলে। ইংরেজদের মতোই এই উপমহাদেশের অধিবাসীদের পুরো মন-মানসিকতা দখল করে রেখেছিল হাজার রকম কুসংস্কার। তখনকার সময়ে নারী মানে যেন ঘরে আবদ্ধ করে রাখার আসবাবপত্র। তাদের কাজ শুধুমাত্র ঘর সামলানো। সাথে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথার মত কুসংস্কার তো ছিলই। এখন ভাবুনতো, সে সময় কোন নারী যদি পুরো সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে বলে সে ডাক্তার হতে চায় তবে পুরো সমাজের চোখ রাঙ্গানি কতটা ভয়ানক হতে পারে।
ভালো কিছুর জন্য চিরচেনা প্রথা ভাঙ্গা আবশ্যক। আর সে প্রথা ভাঙ্গতে সব কিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে মশাল একজনকে জ্বালাতে হয়। উপমহাদেশে নারীদের শিক্ষায় উদাহরণ সৃষ্টি করা এমন একটি নাম, “কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়”। যিনি ছিলেন পাশ্চাত্য চিকিৎসা শিক্ষায় ডিগ্রী অর্জন করা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক ও ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুই জন নারী স্নাতকের একজন।
প্রাথমিক জীবন
১৮ জুলাই ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে কাদম্বিনী বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাদের মূল বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদশীতে। কাদম্বিনী বসুর পিতা ব্রজ কিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সাথে তিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্ম সংস্কারক।
নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। অভয়চরণ মল্লিককে সাথে নিয়ে ব্রজ কিশোর বসুর হাত ধরে ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে “ভাগলপুর মহিলা সমিতি” স্থাপিত হয়। বাবার উৎসাহে কাদম্বিনী দেবী ঢাকা ইডেন ফিমেল স্কুল থেকে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি মহিলাদের জন্য প্রথম প্রতিষ্ঠিত “বাংলা মহিলা বিদ্যালয়ে” ভর্তি হন।
১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী দেবী প্রথম মহিলা হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী দেবী ও চন্দ্রমুখী বসু ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুইজন মহিলা হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।
কাদম্বিনী থেকে ডাক্তার কাদম্বিনী
কাদম্বিনীর ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবেন৷ কিন্তু ডাক্তার হবো বললেই তখনকার সমাজ কেন একজন মেয়েকে ডাক্তারি পড়তে দেবে! এমনকি কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রথম দিকে তাকে ভর্তির অনুমতি দেয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।
১৮৮৩ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর তিনি তার চেয়ে ১৭ বছরের বড় বিপত্নীক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ দ্বারকানাথ কাদ্মবিনীর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তাদের বিয়ে অনেকের কাছে বিষফোঁড়ার মত ছিল।
তাছাড়া, মেডিকেলের শিক্ষকরা কাদম্বিনীর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতো৷ যে কারণে কাদম্বিনী ফাইনাল পরীক্ষায় সমস্ত লিখিত বিষয়ে পাস করলেও প্র্যাকটিক্যালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অকৃতকার্য হন৷
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি অর্জন করেন। কাদম্বিনী দেবীকে সম্পূর্ণ স্বাধীন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। পড়াশোনাকালীন ২০ টাকা ছিল তার মেডিকেল থেকে পাওয়া স্কলারশিপ। বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে তিনি মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
কাদম্বিনীর ডাক্তার হওয়া সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। ‘বঙ্গবাসী’ নামে সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল কাদম্বিনী দেবীকে অপমান করেএকটি কার্টুন ছাপলেন। কার্টুনটি ছিল এক নারী তার স্বামীর নাকে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তারা আকারে ইঙ্গিতে কাদম্বিনী দেবীকে “বেশ্যা” বলে আখ্যায়িত করতেও ছাড়ে নি। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন, যে নারী পুরো সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছেন তাকে দমিয়ে রাখা অত সহজ নয়। কাদম্বিনী বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ পালের বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ মামলার রায় কাদম্বিনীর পক্ষে যায়। মহেশ পালকে ৬ মাসের জেল ও ১০০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়।
কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি শুধু ডাক্তার হিসেবে নয় আরো অনেক ক্ষেত্রে প্রথম ছিলেন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়৷ আর ঐ অধিবেশনের জন্য ৬ জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। কাদম্বিনী ছিলেন তার মধ্যে একজন। তাছাড়া তিনি ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি। যে ব্রাহ্ম সমাজ শুধুমাত্র নারী হয়ে ডাক্তার হওয়ার জন্য কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে এত অপবাদ দিয়েছিল, সে ব্রাহ্ম সমাজ ১৯১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে তাকে সভাপতির দায়িত্ব দেয়।
কাদম্বিনী নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন৷ বিহার এবং ওড়িশার নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার ও তার স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯২২ সালে বিহার এবং ওড়িশার নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য তৎকালীন সরকার কাদম্বিনীকে নিযুক্ত করেছিলেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা মেডিকেলের এক কনফারেন্সে তিনি অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। মেডিকেল কলেজে মেয়েরা ভর্তি হতে পারবেনা এই নীতির তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতা মেডিকেল কলেজে তাদের এতদিনকার চলে আসা নিয়ম থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
শেষ জীবন
পাঁচ সন্তানের জননী কাদম্বিনী গাঙ্গুলি হাজারো অপবাদের পরেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন। বিশেষ করে যে নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ থাকতোনা তাদের বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না।
বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ লিখেছেন, “কাদম্বিনী ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন।”
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা অক্টোবর সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কাদম্বিনীর মারা যান। তার মত নারীদের জন্ম হয় শতবছরে একবার। আর তারা সমাজকে দিয়ে যায় আজীবন ঋণী থাকার মত কিছু উপহার। এই মহিয়সী নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক- পূজা ধর