করোনা ইস্যুতে মুখোমুখি চীন এবং ট্রাম্পঃ গন্তব্য কোথায়! 1 min read
Reading Time: 3 minutesকরোনাভাইরাস যেন লাগামহীন এক ঘোড়া। কোনভাবেই আয়ত্তে আসছেনা ভয়াবহ এই ব্যাধি। দিনের পর দিন করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে করোনার যেখানে উৎপত্তি, ঠিক সেখানেই একেবারে নিভে গিয়েছে। একমাত্র দেশ হিসেবে চীনই কেবল এর বিস্তার ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। অপরপক্ষে এই ভাইরাসের সবচেয়ে বড় শিকার এই মুহুর্তে চীনেরই “শত্রুপক্ষ” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে বেইজিং যখন নিজেদের সারা বিশ্বের রোল মডেল করতে চাইছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিনিয়ত একে চাইনিজ ভাইরাস আখ্যা দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিচ্ছেন।
বেইজিংকে ঘিরে সারা বিশ্বেই প্রপাগন্ডা ছড়িয়েছে জোরেশোরে। করোনা মোকাবেলায় চীনের এহেন সাফল্য সন্দেহ জাগাচ্ছে অনেক দেশের মাঝে। আর ঠিক সেসময়ই মার্কিন মুল্লুকে চলছে বড় এক ঝড়। পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যাপক রদবদল ঘটাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
বেইজিং এর সাফল্যের বিপরীতে গণমাধ্যমের সামনে প্রতিদিনই হাজির হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর প্রতিবারই এসে সমাধানের চেয়ে চীন বিরোধী বক্তব্যেই বেশি উৎসাহী দেখাচ্ছে তাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং চীনের জার্মান দূতাবাসের সাবেক কূটনীতিক ক্লস ল্যারেসের মতে, চীন এই বৈশ্বিক দূর্যোগকে নিজেদের একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসবেই দেখছে এই সময়ে। সারা বিশ্বে নিজেদের ভূমিকা আরো জোরদার করতে এবং নিজেদের সরকার ও দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে করোনাকেই বড় সুযোগ মেনে কাজ করছে তারা। চীনের দাবী তাদের নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা এবং দেশব্যাপী নেয়া পদক্ষেপের কল্যাণেই করোনা থেকে নিরাপদ তাদের দেশ।
যদিও বর্তমান রাজনীতির মঞ্চে এটিই সবচেয়ে স্বাভাবিক। চীনের স্থলে আমেরিকা থাকলে একই নীতি হয়ত তারাও অনুসরণ করতো। তবে চীন বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই নষ্ট করে তুলছে, যেখানে অন্য আর সব দেশ বর্তমানে অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধানেই বেশি জোর দিচ্ছে।
মুখোমুখি চীন এবং ট্রাম্প
ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে আসার পর থেকে বেশিরভাগ সময়েই চীন আমেরিকা সম্পর্ক ছিল উত্তপ্ত। উত্তেজনার মূল কারণ ছিল চীনের সাথে মার্কিনীদের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন এই বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ওবামার সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকালে ২০১৬ সালে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, বেইজিং মার্কিন অর্থনীতিকে রীতিমতো ‘ধর্ষণ’ করে চলেছে। তিনি চীনকে মার্কিন শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় চোর বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন।
২০১৮ সালের শেষ দিকে এসে ট্রাম্প সরাসরি চীনের সাথে এক বাণিজ্য যুদ্ধে নেমে পড়েন। কিন্তু তাতে ট্রাম্প যে খুব বেশি সুবিধা করতে পেরেছেন তাও বলা চলেনা। চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই নিজেদের মাঝে চলা এই অসুস্থ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরতে পারেনি বরং ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি দুইপক্ষ একটি বাণিজ্য চুক্তিতে সাক্ষর করে।
কিন্তু সেই সুসময়ের আয়ু ছিল কেবল ২ সপ্তাহ। জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখেই ট্রাম্প নতুন করে চীন ভ্রমণকারীদের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
ষড়যন্ত্রের যত গুঞ্জন
বিভিন্ন সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের ব্যাপারে তার মানসিক বৈরিতা দমন করতে পারেননি। একাধিকবার গণমাধ্যমের সামনে কোভিড-১৯ কে ‘চায়না ভাইরাস’ কিংবা ‘উহান ভাইরাস’ বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি। আর এ নিয়ে তোপের মুখে পড়লেও তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিল না মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
এদিকে মার্কিন প্রশাসনও প্রেসিডেন্টের এহেন আচরণের বাইরে খুব বেশি কিছুই করছে না। একাধিক সিনেটর এরইমাঝে এই ভাইরাসকে চীনের করা ষড়যন্ত্র হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, উহানের বাজার নয় বরং ল্যাবরেটরি থেকেই সুকৌশলে বাইরে এসেছে কোভিড-১৯। এপ্রিলের ১৫ তারিখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ল্যাব সংক্রান্ত চীনের দাবি তদন্ত করে দেখছে এবং চীনকে পাল্টা হুশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন তদন্তে করোনা ভাইরাসের “ইচ্ছেকৃত ছড়িয়ে পড়া” প্রমাণিত হলে চীন তার জন্য দায়ী থাকবে। অন্যদিকে সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেই বলেন, করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে চীনের “সরাসরি কথা” বলা দরকার।
নিশ্চয়ই চীনের করোনাভাইরাস নিয়ে বেশ কিছু দিক বিশ্বের সামনে তুলে ধরা বাকি। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে চীন যেখানে প্রায় থামিয়ে ফেলেছে এই মহামারী সেখানে বাকি বিশ্ব এখনো ব্যস্ত এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। তবে মার্কিন মুল্লুকের এই দাবী সত্যিকার অর্থে কতটা সত্য তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
ইটের বিপরীতে পাটকেল
ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিষয় এলে চীনও খুব একটা নীরব ভূমিকায় নেই। চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জিয়াও লি জিয়ান তার টুইটারে দাবি করেছেন, তাদের বিশ্বাস মার্কিন সৈন্যবাহিনীর হাত ধরেই উহানে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেছে।
সাংবাদিকদের ইস্যুতে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে একেবারে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে। দুই দেশই পরস্পরের গণমাধ্যমগুলোর নিজেদের দেশে চলাচল সীমিত করে রেখেছে। একইসাথে কমিয়ে ফেলা হয়েছে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট কর্মীর সংখ্যাও। এছাড়াও চীনের প্রয়াত চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং মহামারী সতর্কতা জানানোর পরেও চীন প্রশাসনের দূর্বল অবস্থান নিয়ে বর্তমানে বেশ সরব রয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যম।
চীনের বৈশ্বিক আস্থা
শুরুর দিকে চীনের ধীরে চলো নীতির কারণে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও সময়ের সাথে সাথে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থামাতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তোয়াক্কা না করলেও বর্তমানে সারা বিশ্ব চীনের দেখানো লকডাউনের পথেই হাটছে। আর চীন অতি সম্প্রতি নিজ দেশে লকডাউন অনেকটাই উঠিয়ে ফেলেছে। ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনের মাঝে।
ভাইরাস মোকাবেলার পাশাপাশি বিশ্বের সামনে অন্য আরেক রূপও দেখাচ্ছে চীন। সারাবিশ্বের বিপুল চাহিদার মাস্ক, পিপিই সহ চিকিৎসা উপাদানের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। এমনকি চীনের এই সাহায্য গিয়ে পৌঁছেছে স্বয়ং ট্রাম্পের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর এরই ফলে চীন হয়ে উঠছে এক বৈশ্বিক আস্থার নাম। বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক শক্তি এবং দাতা দেশ হিসেবে মার্কিনীদের চেয়ে এখন চীনের নামই আসছে বেশি।
বিশ্ব শাসন করবে কে?
অন্য সব পরাশক্তি দেশের মতো চীনেরও প্রতিশ্রুতির বিপরীতে পর্যাপ্ত সাহায্য না দেয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন সারা বিশ্বের চাহিদা যেভাবে পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে চীন রোল মডেল তো বটেই, অনেকাংশেই দানবীরের বেশে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই না করোনা সংকট শেষ হলে চীনই বিশ্বের একক শাসক হিসেবে উঠে আসবে। যদিও এই ক্ষেত্রে সম্ভাবনা অনেক বেশি তবুও ট্রাম্প প্রশাসন যদি বেইজিং এর প্রতি পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বদলে সহমর্মিতা প্রদর্শন করে তবে পরিস্থিতি হয়ত মার্কিনীদের অনুকূলেও থাকতে পারে। কিন্তু এতদিন ধরে চীনের প্রতি ক্ষিপ্ত ট্রাম্প কতটা সহযোগি মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ